রূপবান। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পগাঁথাগুলোর একটি। সেই কবে পাকিস্তান আমলে রূপবানের যাত্রা সারা দেশের মানুষকে আক্ষরিক অর্থেই মোহিত করেছিল। গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো রূপবানের গল্পে এতটাই মজেছিলেন, বছরের পর বছর যাত্রাদলগুলোকে গ্রামের পর গ্রামে কেবল রূপবানই মঞ্চস্থ করতে হয়েছিল। এমনকি এখনো রূপবানের যাত্রার আবেদন একেবারে ফুরিয়ে যায়নি।
সেই রূপবানের যাত্রা থেকে প্রথম চলচ্চিত্র বানানো হয় ১৯৬৫ সালে, ‘রূপবান’ নামে। তখনো লাহোর-করাচির উর্দু ছবি আর বোম্বের হিন্দি ছবির দাপটে ঢাকাই বাংলা ছবির একেবারে নাজেহাল দশা। কাশ্মির যুদ্ধের ফলে হিন্দি ছবি আসা বন্ধ হলো বটে, কিন্তু তার পুরো ফায়দা তুলতে লাগল উর্দু ছবি। পরিচালক সালাহউদ্দিন তখন চিন্তা করলেন, রূপবান যাত্রার কাহিনি নিয়ে সিনেমা বানানোর। সবাই তার এই ভাবনাকে স্রেফ পাগলামি বলে উড়িয়ে দিলেও তিনি পিছু হটেননি।
১৯৬৫ সালের শেষ দিকে মুক্তি পেল রূপবান। এই এক ছবি দিয়ে ঢাকার সিনেমার চেহারা বদলে গেল! সিনেমা হলগুলোতে মানুষের ঢল নামল। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস সিনেমা হলগুলোতে টানা চললো চলচ্চিত্রটি। গ্রামের থেকে দলে দলে মানুষ আসতে লাগল কাছের শহরে বা গঞ্জে, যেখানে একটা সিনেমা হল আছে। স্রেফ একবার রূপবান দেখার জন্য। টিকেট না পেয়ে দল বেঁধে হলের কাছেই রাত কাটাতে লাগল পরদিন সিনেমা দেখার জন্য।
রূপালি পর্দায় রূপবানের সেই শুরু। কিন্তু সেটাই শেষ নয়। এরপর রূপবানকে নিয়ে আরো বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। পরের বছরই রূপবানকে নিয়ে বানানো হয় আরও দুটি চলচ্চিত্র। সফদার আলী ভূঁইয়া নিজেই সে বছর রূপবানকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন- ‘রহিম বাদশাহ ও রূপবান’। এই সফদার আলী ভূঁইয়া কেবল লোকসাহিত্যের ভীষণ অনুরক্তই ছিলেন না, তিনি নিজে গীতিকাও লিখতেন। এরপরেও তিনি লোককাহিনি নিয়ে আরো বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মান করেছিলেন।
বছরের প্রায় একই সময়ে রূপবানকে নিয়ে আরো একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। ইবনে মিজান পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটির নাম ছিল ‘আবার বনবাসে রূপবান’। এটি ছিল তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। আগের চলচ্চিত্রটিও অনেকটা একই ঘরানার ছিল- ‘একালের রূপকথা’ (১৯৬৫)। পরে এই ইবনে মিজান ঢাকার রূপকথা-লোককথাভিত্তিক চলচ্চিত্র ধারার অন্যতম প্রধান নির্মাতা হয়ে ওঠেন।
এছাড়াও সে বছরের মাঝামাঝিতে সালাহউদ্দিনের ‘রূপবান’-এর উর্দু সংস্করণ মুক্তি পায়। বাংলা ও উর্দু রূপবান হুবুহু একই হলেও, দুটি আসলে ছিল পৃথক দুটি চলচ্চিত্র। শুটিংয়ের সময়েই সালাহউদ্দিন প্রতিটা শট দুই ভাষায় আলাদা করে শুট করেছিলেন। ফলে একই সাথে একই কাহিনি নিয়ে বানানো দুই ভাষার দুইটি চলচ্চিত্রের শুটিং হয়ে যায়। বাংলা রূপবানের ব্যাপক সাফল্যের পর, পরের বছর দুই পাকিস্তানে মুক্তি দেয়া হয় উর্দু রূপবান। অবশ্য বাংলা রূপবানের তুলনায় উর্দু রূপবান ব্যবসাই করতে পারেনি।
বছর দুই পরে, ১৯৬৮ সালে আবারও রূপবানের কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। নাম ‘রূপবানের রূপকথা’। পরিচালক ই আর খান। তারপর দীর্ঘ বিরতি। আবারও রূপালি পর্দায় রূপবানকে দেখার জন্য দর্শকদের অপেক্ষা করতে হলো প্রায় দুই দশক। অবশেষে ১৯৮৫ সালে গুণী পরিচালক আজিজুর রহমান আবারো রূপবানকে রূপালি পর্দায় নিয়ে আসলেন। এবার আর সাদাকালোয় নয়, রঙিন বেশে। নামই দিলেন ‘রঙিন রূপবান’। যেন এই দীর্ঘ অপেক্ষাকে সার্থক করতেই।
কেবল বাংলাদেশেই নয়, রূপালি পর্দায় রূপবানের উপস্থিতি ছাড়িয়ে গেছে দেশের গণ্ডিও। সীমান্তের ওপারে কলকাতাতেও জনপ্রিয় এই যাত্রাপালার কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। ১৯৯২ সালে ‘রূপবান কন্যা’ নামের চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন হারুনর রশিদ। অবশ্য এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা নিয়ে বেশ জল ঘোলা হয়েছিল। মূলত সালাহউদ্দিনের ‘রূপবান’-এর রিমেক হলেও তাই চলচ্চিত্রটির শুরুতে লেখা হয়েছিল বাংলাদেশের জনপ্রিয় লোকগাথা অবলম্বনে। আর সালাহউদ্দিনকে দেয়া হয়েছিল চিত্রনাট্য ও সংলাপের ক্রেডিট। এছাড়াও কলকাতায় রূপবানকে নিয়ে আরো একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, ‘রূপবান’ নামে। সেটি পরিচালনা করেন জিল্লুর রহমান।
রূপবানকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে নতুন শতকে এসেও। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম চলচ্চিত্র প্রযোজনা শুরু করে প্রথম বছরেই রূপবানকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। ২০০৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সেই ছবিটি যৌথভাবে পরিচালনা করেন ছটকু আহমেদ ও আকন্দ সানোয়ার মোরশেদ। আজকের রূপবান নামের সেই চলচ্চিত্রটি অবশ্য ঠিক রূপবান পালাটির কাহিনি নিয়ে নয়, বরং রূপবান পালায় রূপবান চরিত্রে অভিনয় করা এক যাত্রার নায়িকাকে কেন্দ্র করে।
সালাহউদ্দিনের রূপবান-এর পরে এই যাত্রার কাহিনি নিয়ে আরো আধ ডজনেরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও, ব্যবসায়িক সাফল্যে তার একটিও প্রথমটির ধারেকাছে আসতে পারেনি। নির্মাণের মুন্সিয়ানায় বা গল্প বলার দক্ষতাতে তো নয়ই। তবে ঢাকার চলচ্চিত্রে খেরোখাতায় পরের এই রূপবানগুলোরও গুরুত্ব আছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যাত্রাপালার এই জনপ্রিয় কাহিনিটি কী ভীষণ প্রভাবশালী, কী ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, এই চলচ্চিত্রগুলোই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। তা নইলে কী আর একই যাত্রার কাহিনির উপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা আধ ডজন ছাড়িয়ে যায়! তাও আবার ৪০ বছরের ব্যবধান জুড়ে!