মঞ্চ থেকে রূপালি পর্দায় আসা ৬ গল্প

সাহিত্যকর্ম থেকে, মানে গল্প-উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ বেশ জনপ্রিয়। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও বিখ্যাত ও জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়ে আসছে সেই সাদা-কালো যুগ থেকেই। সে যুগ পেরিয়ে এই ধারা অব্যাহত আছে ঝলমলে ঝা চকচকে রঙিন যুগেও। আর সে ধারায় কেবল গল্প-উপন্যাস থেকেই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি, নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু মঞ্চসফল তথা জনপ্রিয় নাটক থেকেও। সেই ধারার অন্তত ৬টি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রের কথা বলা যায়।

অবশ্য যাত্রাপালা থেকে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোও এই বিবেচনায় আসার যোগ্য তো বটেই, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সেগুলোর গুরুত্বও অপরিসীম। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে, ঢাকার চলচ্চিত্র যখন কেবল হাঁটি হাঁটি পা পা করে যাত্রা শুরু করেছিল, তখনকার বাংলা চলচ্চিত্রকে উর্দু চলচ্চিত্রের দোর্দণ্ড প্রতাপের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। আর সে লড়াইয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে প্রথম সাফল্যের মুখ দেখিয়েছিল একটি যাত্রাপালার চলচ্চিত্রায়িত রূপ- রূপবান। আবার আশির দশকে আরেক যাত্রাপালার চলচ্চিত্রায়ন- বেদের মেয়ে জোসনা ঢাকার চলচ্চিত্রে যে রেকর্ড গড়েছিল, তা অক্ষুণ্ণ আছে আজো।

তবে এই তালিকায় কেবল মঞ্চনাটক থেকে বানানো চলচ্চিত্রগুলোকেই বিবেচনা করা হয়েছে। যাত্রাপালা থেকে বানানো চলচ্চিত্রের গল্প না হয় আরেক দিনের জন্য তোলা থাকুক।

১. মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬)

মুখ ও মুখোশ মূলত আবদুল জব্বার খানেরই লেখা মঞ্চনাটক ডাকাত-এর চলচ্চিত্ররূপ

আবদুল জব্বার খান অনেকটা জেদের বশেই ঢাকার প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন মূলত নাট্যাঙ্গনের লোক। নিজে নাটক লিখতেন এবং পরিচালনাও করতেন। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পাওয়া মুখ ও মুখোশ মূলত তারই লেখা মঞ্চনাটক ডাকাত-এর চলচ্চিত্ররূপ।

২. ধারাপাত (১৯৬৩)

ধারাপাত নির্মাণ করা হয় আমজাদ হোসেনের একটি মঞ্চসফল নাটক থেকে

ধারাপাত নির্মাণ করা হয় আমজাদ হোসেনের একটি মঞ্চসফল নাটক থেকেঢাকার চলচ্চিত্রের শুরুর দিকের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকার সালাহউদ্দিনও ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব। পরে তিনি চলচ্চিত্রে আগ্রহী হন। যে নদী মরুপথে (১৯৬১) এবং সূর্যস্নান (১৯৬২) নির্মাণের পরে তিনি নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সালাহউদ্দীন প্রোডাকশন্স প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম ছবি ধারাপাত। ছবিটি তিনি নির্মাণ করেন আমজাদ হোসেনের একটি মঞ্চসফল নাটক থেকে।

৩. ১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন (১৯৬৬)

কেবল হাস্যরসকে ভিত্তি করে চলচ্চিত্র, যাকে বলে বিশুদ্ধ কমেডি ফিল্ম ঢাকায় খুব বেশি নির্মিত হয়নি। এই স্বল্পসংখ্যক চলচ্চিত্রের মধ্যে সেরাটিকে বেছে নিতে বললে অনেকেই এই চলচ্চিত্রটিকে বেছে নেবেন। অথচ চলচ্চিত্রটির পরিচালনা করেছেন এমন একজন, যার মূল পরিচয় সম্পাদক বা এডিটর। চলচ্চিত্রটিতে অন্যতম একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন খান জয়নুল। চলচ্চিত্রটির কাহিনিকারও তিনি। আর সেই কাহিনি লেখেন তারই জনপ্রিয় মঞ্চনাটক শান্তি নিকেতন অবলম্বনে।

৪. নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৭)

নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাহিনি রচনা করা হয়েছে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে লেখা পাঁচটি নাটক থেকে

বাংলাদেশের ইতিহাসভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলা। একই সাথে এই চলচ্চিত্রটিতেই প্রথম বারের মতো বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনার উপস্থাপন করা হয়, বেশ কৌশলে যদিও। মূলত সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই বাঙালির স্বাধীন চেতনার প্রতীক এই ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন পরিচালক খান আতাউর রহমান। আর সে জন্য তিনি কাহিনি রচনা করেন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে লেখা পাঁচটি নাটক থেকে। এই পাঁচ সিরাজউদ্দৌলার নাট্যকাররা হলেন- অক্ষয় মৈত্র, রমেশ্চন্দ্র মজুমদার, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মোঃ নেজামতুল্লা ও সেকান্দর (সিকান্দার) আবু জাফর।

৫. চাকা (১৯৯৩)

মোরশেদুল ইসলাম সেলিম আল দীনের চাকা-কে একই নামে চলচ্চিত্রায়িত করেন

স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নাট্যকার সেলিম আল দীন। তিনি কেবল একজন শক্তিশালী নাট্যকারই নন, তার নাটকগুলোও বেশ দুরূহই বটে। এই দুরূহতা দুই অর্থেই; সেগুলো সম্যক উপলব্ধি করাটা যেমন দুরূহ, মঞ্চস্থ করাটাও তেমনি। অথচ প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে মোরশেদুল ইসলাম তার তেমনই এক নাটক চাকা-কে (১৯৯১) একই নামে চলচ্চিত্রায়িত করেন। চলচ্চিত্রটি জার্মানির মানহাইম-হাইডেলবার্গ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে একটি সম্মাননা পুরস্কারও লাভ করে।

৬. কীত্তনখোলা (২০০০)

সেলিম আল দীনের বিখ্যাত নাটক কীত্তনখোলা থেকে নির্মাণ করা একই নামের এই চলচ্চিত্র

সেলিম আল দীনের আরেক বিখ্যাত নাটক কীত্তনখোলা (১৯৮৬)। নাটকটি থেকে আবু সাইয়ীদ ২০০০ সালে নির্মাণ করেন একই নামের এই চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র মোট ৯টি ক্যাটাগরি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেয়।