শৈশবে তার হাতে খড়ি এস.এম. সুলতানের হাত ধরে। স্বপ্নের শুরু হয়েছিল সেখানেই। নিজের সৃষ্টির স্বপ্নে বিভোর শিল্পী মাহবুব জামাল শামীম পাড়ি জমান ঢাকা শহরে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু করেন চারুকলা ইন্সটিটিউটে। হ্যাঁ, সেই ইন্সটিটিউট এখন অনুষদে রূপ পেয়েছে। সেখানেই বেড়ে ওঠা এই শিল্পীর। যার হাত ধরে ভাস্কর্য পেয়েছে নতুন রূপ। তৈরি হয়েছে নতুন গল্প, যশোরের ‘চারুপীঠ’ আর আজকের পহেলা বৈশাখ।
ভাস্কর আবদুর রাজ্জাক ও হামিদুজ্জামান খান ছিলেন তার অনুপ্রেরণা। চিত্রকর না হয়ে পথ হেঁটেছিলেন ভাস্কর হবার পথেই। কিন্তু সেখানে বাঁধা পড়ে চিন্তায়। কোন এক রাতে আঘাত আসে গৌরবের অপরাজেয় বাংলায়। আনোয়ার জাহানের স্বাধীনতা স্মৃতি ভাস্কর্যে। সেখান থেকেই মাহবুব জামাল নতুন করে শুরু করেন পথচলা। ভাবলেন, আমি যদি স্থুল ভাস্কর্য করি তবে কে ভেঙ্গে ফেলবে এক নিমিষে? ইটের গাথুনিতে তার ভাস্কর্যের পায়ের দিক হবে প্রসারিত। ঠিক যেমন থাকে পিরামিডে। ঘন আর সুবৃহৎ আকৃতির ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে ব্যস্ত হন তিনি। স্থুলতায় সৌন্দর্যের সৃষ্টি এমনই এক চিন্তায় শুরু করেন তার স্নাতকোত্তর পড়াশুনার পাঠ। যেখানে তার কল্পনায় ছিল আকাশ জোড়া ভাস্কর্য নির্মাণের স্বপ্ন।
মাহবুব জামাল চেয়েছেন তার ভাস্কর্য থাক প্রকৃতির মাঝে, মানুষের স্পর্শে। প্রকৃতির মাঝে সে দাঁড়িয়ে থাকবে ঘন, প্রশান্ত ও নগ্ন হয়ে। থাকবে না কোন বেইজমেন্ট। লম্বায় নয় বরং চওড়া করতে চেয়েছেন তার ভাস্কর্য গুলোকে। যেগুলোকে টেনে নেয়া যাবে অনেকদূর। যতদূর তিনি চাইবেন। মিশরীয় ভাস্কর্যের জ্যামিতিক ফর্ম আর ভারতীয় ভাস্কর্যের শান্ত-সুমোহিত ফর্ম নিয়ে খেলা করেন তিনি। সেখান থেকেই সৃষ্ট তার অন্য চেহারার ভাস্কর্য গুলি। হরাইজন্টাল ভাবে ছড়িয়ে দিতে চান অনেক দূরে, মানব দেহকে।
বাংলার লোকজ দূর্গার ফর্ম তাকে অনুপ্রাণিত করে, যেখানে দূর্গা ভার্টিকেল ফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। অসুর রয়েছে তার হরাইজন্টাল স্থানে। আর দূর্গার দশ হাত? সেটিই তো বৃত্তের ফর্ম। সেসব ফর্ম থেকেই তিনি বিনির্মাণ করেন একাত্তরের বাংলা নামের ভাস্কর্য।
১৯৮৫ সালে মাহবুব জামাল শামীমের হাত ধরে প্রথম যাত্রা করে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এরপর আজ সেই মঙ্গল শোভাযাত্রার গল্প তো কেবল বাংলার ইতিহাস, বিশ্ব দরবারে গৌরবের ইতিহাস।
দীর্ঘদিনের পথচলায় এই প্রথম মাহবুব জামাল শামীম করছেন তার একক প্রদর্শনী করছেন এই শহরে। ‘Jungle of Humanity’ শিরোনামে। যার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় রয়েছে ART Con নামক এজেন্সী। শুরু হয়েছে গত ১০ নভেম্বর।
শহরে তার ক্যানভাসের ছবি এবং ভাস্কর্যের প্রদর্শনী হলেও ঢাকা শহরে এই প্রথম প্রদর্শীত হচ্ছে তার কাজ। সেখানে রয়েছে তার ভাস্কর্য, পেইন্টিং, চারকোল কিংবা প্যাস্টেল রঙে করা কাজ। আরও রয়েছে তার ইন্সটলেশন, করছেন প্রথমবার, আনুষ্ঠানিক ভাবে। নাম দিয়েছেন তার বাঙ্গালনামা। মাহবুব জামাল তার বাঙ্গালনামায় তুলে ধরেছেন বাঙ্গালীর গল্প। যে বাঙ্গালী এক শংকর জাতি। ছড়িয়ে গেছে বিশ্বজুড়ে। যদি সেই বাঙ্গাল কোথাও একদিন বসে কারোর দুয়ারে, মাহবুব জামাল চান তার একটু আতিথেয়তা হোক। এই দেশে তো বাংলার মানুষ নিশ্বাস নিতে পারেনা। সর্বত্র যে শুধু মানুষ আর মানুষ। ঠাঁই কোথায় এই অপরিকল্পিত নগরের জীবনে? তাই তো ইন্সটলেশনে আমরা দেখতে পাই দেয়াল জুড়ে বিশাল মানুষ। সেই চওড়া ফিগার। আর কাউকে ঠাঁই দেয়ার ইচ্ছে নেই যেন। একটু খানি প্রকৃতিও না। মাটিতেও ছড়িয়ে আছে মানুষ। তাদের উপর দিয়ে হেঁটেই উপভোগ করতে হবে এই ইন্সটলেশন। যেন মানুষ মানুষকে দাবিয়ে রাখছে। আর মাঝখানের আগ্নেয়গিরির লাভার মত উদগিরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্ব জুড়ে। পাখির মত ডানা মেলে।
মাহবুব জামাল সেই ঢাকা শহরকে চিনতেন, যেখানে ছিল পাখির ডাক। ঝিঁঝি পোকা কিংবা ঝিলের জল। আকাশজোড়া মেঘ। আজকের যেই ঢাকা শহর সেই শহরের রূপান্তর দেখেছেন তিনি। তখন ভেবেছিলেন, এই উঁচু দালান গুলি বুঝি আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন। কিন্তু সেই উচু দালান তো আজ গলার ফাঁস। কেন এমন হল না? শিল্প যেমন পরিকল্পিত ঠিক তেমন কেন নয় এই নগরের পরিক্লপনা? কেন প্রকৃতি আর নগরের গল্প একসাথে মিলে ঠাঁই পেলনা এই শহরে? সেখানে থেকেই এই ইন্সটলেশন। নগরের দালান গুলোর মাঝে তিনি খুঁজে পেয়েছেন মানুষের অবয়ব।
শিল্পকলা একাডেমীতে চলছে এই প্রদর্শনী। আগামী কাল যার শেষদিন।