রাজা রায়চৌধুরী। ওরফে কাকাবাবু। তার এক পা খোঁড়া। তাতে কী! এক পা নিয়েই তাবত অপরাধীদের সাক্ষাৎ যম তিনি। তার সামনে পরলে তাদের সবাইকেই নাস্তানাবুদ হতে হয়। কারণ তার বুদ্ধি আর মনের জোর। সাথে বাহুবলেও নিতান্ত কম নন। আর তার বন্দুকের টিপ তো যাকে বলে অব্যর্থ।
না, তিনি রক্তমাংসের কোনো সত্যিকারের মানুষ নন। কিন্তু বাঙালি রহস্য-রোমাঞ্চ পাঠকদের কাছে তারচেয়ে কমও নন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই অমর চরিত্রে বাঙালি পাঠক মজে আছে সেই কবে থেকে! আর এমন পাঠকনন্দিত রোমাঞ্চকর চরিত্র রূপালি পর্দায় আসবে না, তাও কী হয় নাকি! কাগজ-কলম ছেড়ে রূপালি পর্দায় কাকাবাবুর আনাগোনার শুরু তাই সেই আশির দশকের শেষ থেকেই।
সে অভিষেকের কারিগরও রীতিমতো পোক্ত একজন পরিচালক। দুই বাংলা মিলিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ পরিচালকদের তালিকা করলে, তপন সিংহের নাম তাতে রাখতেই হবে। ১৯৫৫ সালে উপহার দিয়ে শুরু, এরপর থেকে একের পর এক দুর্দান্ত চলচ্চিত্র তিনি বাংলার দর্শকদের উপহার দিয়ে গেছেন।
১৯৭৯ সালে তপন সিংহ চলচ্চিত্রায়িত করেন সুনীলের কাকাবাবু সিরিজের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’। তাতে কাকাবাবুর চরিত্রে অভিনয় করেন সমিত ভঞ্জ। বাংলা শিশুতোষ চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এ এক অনবদ্য সংযোজন হয়ে আছে। সেই আশির দশকের নন-টেক জমানায়, স্পেশাল ইফেক্ট ছাড়াই তিনি দর্শকদের যে চালচ্চিত্রিক ইফেক্ট উপহার দিয়েছিলেন, তা সত্যিই অতুলনীয়। সাথে কাকাবাবু চরিত্রে সমিত ভঞ্জের অভিনয় তো বটেই, বিশেষভাবে নজর কেড়েছিল সন্তু চরিত্রে অরুনাভ অধিকারীর অভিনয়ও।
মাঝে ষোল বছরের বিরতি। তারপর আবার কাকাবাবুকে নিয়ে চলচ্চিত্র। ১৯৯৫ সালে সুনীলের ‘কাকাবাবু হেরে গেলেন’ থেকে একই নামের চলচ্চিত্র বানালেন পিনাকী চৌধুরী। এবার পরিচালক নন, তারকা কাকাবাবু স্বয়ং- সব্যসাচী চক্রবর্তী। তবে তারচেয়েও বড় তারকা অভিনয় করলেন খলনায়ক অসীত ধর চরিত্রে- সৌমিত্র চক্রবর্তী। শুধু তারকাখ্যাতিতেই নয়, অভিনয়দ্যূতিতেও তিনি এগিয়ে সব্যসাচীর চেয়ে। ফলে অসীত ধরের সামনে কাকাবাবুকে যেন খানিকটা ম্লানই মনে হলো।
হয়তো সে জন্যেই পিনাকী যখন ছয় বছর বাদে আবারো কাকাবাবুকে নিয়ে সিনেমা বানালেন, তাতে আর রইলেন না সৌমিত্র। কিংবা খলনায়ক বদলে যাওয়াতেও অভিনেতার বদল ঘটতে পারে। মোদ্দা কথা, ২০০১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘এক টুকরা চাঁদ’-এ রইলেন একা সব্যসাচী। অবস্থা তথৈবচ। চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করা আরেকজন অবশ্য পরে তারকা হয়েছেন, তবে ঠিক তাদের কাতারের নন। চলচ্চিত্রটিতে সন্তু চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন হালের টলিউড নায়ক সোহম চক্রবর্তী।
এর ঠিক এক যুগ বাদে আবারো রূপালি পর্দায় কাকাবাবু। এবার সৃজিৎ মুখার্জির হাত ধরে। বানানোও হলো বড় পরিসরে, বিশাল আয়োজন করে। ২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া সে চলচ্চিত্রটির জন্য তিনি বেছে নিলেন ‘মিশর রহস্য’ উপন্যাসটিকে। কাজেই শুটিং করতে ছুটে যাওয়া হলো মিশরেও। ফলাফল- এক ঝাঁ-চকচকে চলচ্চিত্র, যেখানে কাকাবাবু চরিত্রে অভিনয় করলেন কলকাতার দাপুটে নায়ক প্রসেনজিৎ।
কাকাবাবুকে নিয়ে বানানো চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে সেরা না হলেও, বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সূত্রের সফল প্রয়োগে ‘মিশর রহস্য’ ব্যবসা বেশ ভালোই করে। ফলাফল, এই একই জুটি আবারো হাজির হয়েছে কাকাবাবুকে নিয়ে। এবার আয়োজন আরো বড়। কাহিনি হিসেবে নেয়া হয়েছে কাকাবাবুর তৃতীয় উপন্যাস- ‘পাহাড়চূড়ায় আতঙ্ক’। তা থেকে বানানো চলচ্চিত্রটির নাম দেয়া হয়েছে ‘ইয়েতি অভিযান’।
এবার কেবল আয়োজনই বড় হয়নি, বড় করা হয়েছে বাজারও। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি মুক্তি দেয়া হয়েছে বাংলাদেশেও। সেজন্য খানিকটা সুযোগ দেয়া হয়েছে ঢাকার দুই শিল্পীকেও। একজন অবশ্য আগে থেকেই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত নায়ক- ফেরদৌস। সাথে একটি চরিত্র দেয়া হয়েছে বিদ্যা সিনহা সাহা মিমকেও। ওপারের ট্রেইলারে অবশ্য তার মুখও দেখা যায়নি, কেবল একবার হাতটুকু দেখা গেছে। তবে ফেরদৌসের মুখ একবার দেখা গেছে, পাহাড়চূড়ার কোনো একটা স্থাপনার একটা জানালার ওপাশে।
তবে এপারের জন্য বানানো ট্রেইলারে তাদের অনেকগুলো দৃশ্য জুড়ে দেয়া হয়েছে। সে বদৌলতেই বোঝা গেছে, ওপারের ট্রেইলারে যে মিমের হাত একবার দেখা গেছে। এখন বিষয়টাকে চালচ্চিত্রিক আগ্রাসন হিসেবে দেখবেন, নাকি কাকাবাবুকে যে আমরাও সিনেমা হলের বড় পর্দায় দেখতে পাচ্ছি সেই প্রাপ্তিতে তৃপ্ত হবেন, সেটা আপনার বিবেচনা।
তবে এটুকু জেনে রাখতে পারেন, এখনো পর্যন্ত সেরা কাকাবাবু তপন সিংহই বানিয়েছেন।