কেস–১ : ঢাকা অ্যাটাক
বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে ঢাকা অ্যাটাক চলছে। সোয়াট অফিসার আশফাক হোসেন স্ত্রীর কপালে পরম মমতায় আলতো করে চুমু খেলেন। সাথে সাথে দর্শক সারির অন্তত তিন জায়গা থেকে ইঙ্গিতপূর্ণ সিটি বেজে উঠল। বেচারারা হয়তো শুরু থেকে অপেক্ষায় ছিলেন; কিন্তু কোনোভাবেই পুরো সিনেমায় সিটি বাজানোর মতো কোনো দৃশ্য, সংলাপ বা ঘটনা কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না। যেই একটা চুমুর দৃশ্য পাওয়া গেল, সে চুমু যেমনই হোক, মমতার হোক আর আদরের হোক, কামনার হোক আর ভরসার হোক, সে সব কিছুই জরুরি নয়। ঘটনা হলো, একটা ছেলে একটা মেয়েকে চুমু খেয়েছে। বাজাও সিটি।
কেস–২ : ডুব
মধুমিতা সিনেমা হলে ডুব সিনেমাটি চলছে। স্ত্রী মায়ার সাথে ঝামেলা হয়েছে জাভেদ হাসানের। বাসা থেকে বের হয়ে গেছেন। এসে উঠেছেন নয়াপাড়া ফিল্ম সিটির বাংলোতে। মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। এর মধ্যেই দেয়াল টপকে চলে এলো নিতু। যেন অস্বাভাবিক কিছুই হয়নি, এমনটাই হওয়ার কথা ছিল; এমন ভাব করে বারান্দায় গিয়ে ফস্ করে একটা সিগারেট ধরালেন সে।
দর্শক সারি থেকেও মন্তব্য ছোঁড়া শুরু; না, সেগুলোর উদ্দেশ্য নিতু নয়। নিতুর মধ্যে যে নারীকে দর্শকরা কল্পনা করে নিয়েছে, সে নারীর উদ্দেশ্যে তারা ছুঁড়ে দিতে লাগলো অশ্রাব্য সব গালাগাল।
বিশ্লেষণ
কেবল সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে নয়, সিনেমার দর্শকদের মান বিচারেও দুটো হলই দেশ সেরা। তাহলে উপরের ঘটনা দুটোর সূত্র ধরে দেশের বর্তমান সিনেদর্শকদের রুচি সম্পর্কে একটা ধারনা লাভ করা যেতে পারে।
সে ধারনা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। দর্শক যদি কপালে চুমু খাওয়াকে লালসার চোখে দেখে, কিংবা সিনেমা দেখতে এসে উচ্চস্বরে অশ্রাব্য গালাগাল দিতে শুরু করে; সেটা সিনেমা দর্শকদের বিকলাঙ্গ মন-মানসিকতার বহি:প্রকাশ। এ ধরনের ঘটনা অপরাপর রুচিশীল দর্শক ও হলের পরিবেশ, এবং সর্বোপরি দেশের সিনেমা শিল্পের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর।
সমস্যাটা কি পুরনো?
সমস্যাটা পুরনোই বটে। ঢাকায় বাংলা চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরুর সময়কালে রামরাজত্ব ছিল লাহোরের উর্দু ও বোম্বের হিন্দি সিনেমার। সেগুলোতে এখনকার মতোই যৌন সুড়সুড়ির মাধ্যমে দর্শকদের প্রলুব্ধ করা হতো।
ঢাকায় বাংলা সিনেমার রাজত্বের শুরু রূপবান দিয়ে। সেই সিনেমায় অবশ্য সচেতনভাবে যাত্রাটির সকল স্থূল উপকরণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে অবশ্য সেই সচেতনতা শতভাগ রক্ষিত হয়নি। এমনকি স্থূল উপকরণ যুক্ত করা হয়েছিল স্বাধীনতা পরবর্তী বেশ কিছু মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্রেও।
এই স্থূলতা থেকে আমাদের চলচ্চিত্র আর কখনোই বের হয়ে আসেনি; বের হতে পারেনি দর্শকরাও। মাঝে তো পুরো চলচ্চিত্র শিল্পই অশ্লীলতার পাকে আটকে বিষম বিপাকে পড়ে গিয়েছিল। এখনো ঘুরে ফিরে ওই একই ফরম্যাটে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প চলছে; কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।
উত্তরণ কি সম্ভব?
উত্তরণ অসম্ভব নয়, তবে সহজসাধ্যও নয়। কারণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কলাকুশলীদের শেখানো-পড়ানোর জন্য ইন্সটিটিউট গড়া যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ খোলা যায়, কর্মশালা-সেমিনার করানো যায়। কিন্তু দর্শকদের জন্য কি তেমন আয়োজন সম্ভব?
আবার নির্মাতা ও কলাকুশলীদের প্রয়োজনে নানা বিধি-নিষেধের নিগড়ে বাঁধা যায়। তাদের সৃষ্টিকে প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণও করা যায়। কিন্তু দর্শকের রুচি বা মনোজগতের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করা কি আদৌ সম্ভব?
ফিল্ম সোসাইটিতে সম্ভাবনা
দর্শকের রুচি বা মনোজগতের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য কোনো আয়োজন কখনো ছিল না, এমনটি বলা যাবে না। যেমন বলা যেতে পারে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কথা। এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য রুচিশীল দর্শক তৈরি করা। সে উদ্দেশ্যেই চলচ্চিত্র সংসদগুলো বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পাশাপাশি এ বিষয়ে অধ্যয়নও করে থাকে।
এসব কর্মসূচী যে একেবারেই ফলপ্রদ হয়নি, তাও নয়। সম্প্রতি সমাজের মধ্যবিত্তরা আবারও হলে ফিরতে শুরু করেছেন, এর পেছনে চিল্ড্রেন’স ফিল্ম সোসাইটির শিশু চলচ্চিত্র উৎসব, রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব বা ঢাকা ইউনিভার্সিটি ফিল্ম সোসাইটির আমার ভাষার চলচ্চিত্র উৎসবগুলোর অবদান যে একেবারেই নেই, তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এত দিনের পথচলাতেও ফিল্ম সোসাইটিগুলো গণমানুষের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারেনি। পারবে কি সামনে?
কিংবা অন্য কোনো উদ্যোগ
ফিল্ম সোসাইটিগুলো এই সংকট থেকে উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বটে, তবে এটাই একমাত্র ভরসা হওয়া উচিত নয়। অন্তত সেই প্রচেষ্টা আসা দরকার ইন্ড্রাস্ট্রির কাছ থেকেও। আসা দরকার সরকারের পক্ষ থেকেও।
সরকারের পক্ষ থেকেও যে উদ্যোগ নেই, তা নয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগ দীর্ঘদিন কেবল নাটক নিয়েই মেতে ছিল। ইদানিং তারা চলচ্চিত্র নিয়েও কাজ করছে। গত কয়েক বছর ধরে দেশব্যাপী আয়োজন করছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব।
এমন সরকারি উদ্যোগ আরো প্রয়োজন। আর সবচেয়ে বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন ইন্ড্রাস্ট্রি সংশ্লিষ্ট মানুষদের। কারণ এই সংকটের জের কিন্তু দিনশেষে তাদেরই টানতে হচ্ছে, হবে।
আশাটুকু থাক
ভালো দর্শকশ্রেণী তৈরি করতে না পারলে ভালো সিনেমাগুলো মুখ থুবড়ে পড়তেই থাকবে। যেমনটা পড়েছিল আশির দশকে ঘুড্ডি, নব্বইয়ের দশকে পালাবি কোথায়-এর মতো দুর্দান্ত গল্পের সিনেমাগুলো।
তবুও আশা রইল, এই সংকট থেকে উত্তরণের আরো উদ্যোগ নেওয়া হবে। সে সবের সুফল পাওয়া যাবে সিনেমা হলে, বক্স অফিসে। এ আশাটুকু না থাকলে আমাদের চলচ্চিত্র নিয়েই আশাবাদী হওয়া যাবে না।