জাস্টিস লীগ তো কমিকপ্রেমি সবারই মোটামুটি দেখা হয়ে গেছে। জ্যাক স্নাইডারের টুইটে “UNITE THE SEVEN” স্লোগানে পোস্টার দেখা গেলেও, দর্শকরা ৭ম জাস্টিস লীগ সদস্যকে দেখতে পায়নি সিনেমার পোস্ট ক্রেডিট সিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেও। তাই কে হতে পারে এই ৭ম জন তা নিয়ে নানান গল্পে মেতে আছে পুরো কমিক দুনিয়া। সবচেয়ে বেশি বোধহয় আসছে গ্রিন ল্যানটার্ন এর নাম। IGN এর র্যাংকিং এ সর্বকালের সেরা ডিসি সুপারহিরোদের তালিকায় গ্রিন ল্যানটার্নের অবস্থান ৪ নম্বরে। কিন্তু সিনেমার জগতে বারবার তার নামের প্রতি অবিচারই করা হয়েছে। বন্ড ডিরেক্টর মার্টিন ক্যাম্পবেলের হাত ধরে ২০১১ সালে প্রথম বড় পর্দায় আসে এই সুপারহিরো। হাল জর্ডানের চরিত্রে রায়ান রেনল্ডসের মতো বড় নাম থাকলেও দর্শকরা সেই সিনেমায় খুঁজে পায়নি তাদের চিরচেনা কমিক হিরো গ্রিন ল্যানটার্নকে। জ্যাক স্নাইডারের জাস্টিস লীগে ৭ম সদস্য হিসেবে গ্রিন ল্যানটার্নকে দেখার জন্য তাই মুখিয়ে ছিলেন কমিক প্রেমিরা।
কিন্তু তাতে গ্রিন ল্যানটার্নের মতো ডিসি কমিক জগতের এত বড় এক সুপারহিরোর কিইবা আসে যায়? জাস্টিস লীগের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম সাত জন সুপারহিরোর একজন তিনি। তার হাতের আংটিটি কমিক জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রগুলোর একটি। প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তির জোরে যা চান তার প্রায় সবই তৈরি করতে পারেন এই পাওয়ার আংটির দ্বারা। ইন্টার গ্যালাকটিক পুলিশ ফোর্স গ্রিন ল্যানটার্ন কর্পসের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্যও তিনি। অন্য সব সুপারহিরোর মতো খুব কষ্টের অতীত হয়তো তার নেই, কিন্তু খুব সাধারণ হাল জর্ডানই যে সামান্য এক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অসাধারণ এক সুপারহিরো চরিত্রে বদলে গেলেন, এটিই তাকে অন্য সব সুপারহিরো থেকে আলাদা করে তুলেছে। আজ আলোচনাটা এই চরিত্র নিয়েই।
ডিসি কমিক্স প্রথমবারের মতো গ্রিন ল্যানটার্নকে কমিক বইয়ের পাতায় নিয়ে আসে ১৯৪১ সালে। গ্রিন ল্যানটার্নের শুরু হয়েছিলো লেখক বিল ফিঙ্গার ও শিল্পী মার্টিন নডেলের হাত ধরে। প্রথম গ্রিন ল্যানটার্ন ছিলেন অ্যালেন স্কট। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৩৮টি ইস্যু প্রকাশিত হয়েছিলো ভলিউম-১ এ। আমরা এখন গ্রিন ল্যানটার্ন বলতে যা বুঝি, ভলিউম-১ এ গল্পে এত ডালপালা ছিলো না। গোল্ডেন এইজ গ্রিন ল্যানটার্ন, অ্যালেন স্কট মূলত তার আংটির সাহায্যে মোকাবেলা করতেন নিউ ইয়র্ক শহরের সাধারণ অপরাধীদের।
ভলিউম-২ এর প্রথম ইস্যু প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালের আগস্টে। জন ব্রুম ও গিল কেইন এবার বেশ আঁটসাঁট বেঁধেই বসলেন গ্রিন ল্যানটার্নকে নিয়ে। তৈরি হলো সিলভার এইজ গ্রিন ল্যানটার্ন, হাল জর্ডান। কোস্ট সিটিতে তার জন্ম। তার বাবা মার্টিন জর্ডান ছিলেন ফেরিস এয়ারক্রাফটের একজন টেস্ট পাইলট। ছোটবেলায় হাল নিজের চোখের সামনেই বাবাকে প্লেইন ক্র্যাশে মৃত্যবরণ করতে দেখেন। বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি নিজেও সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বাবার পথেই হাঁটা শুরু করেন। ফেরিস এয়ারক্রাফটে যোগ দিলেন টেস্ট পাইলট হিসেবে। অফিসের বস, ক্যারল ফেরিস এর প্রতি ভালোলাগার গল্পটাও এই ভলিউমেই শুরু হয়।
অন্যদিকে মিথলজির আদলে তৈরি করা হয় গ্রিন ল্যানটার্ন কর্পস। ইন্টার গ্যালাকটিক মিলিটারি বা পুলিশ ফোর্স হিসেবেই তাদের পরিচয়। এরই এক সদস্য আবিন সুর, তার স্টারশিপ নিয়ে ক্র্যাশ ল্যান্ড করে ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমিতে। মৃত্যুপথযাত্রী আবিন সুর নিজের শূণ্যস্থান পূরণের জন্য নতুন কাউকে খুঁজতে নিলে পাওয়ার রিং বেছে নেয় হাল জর্ডানকে। ভয়কে জয় করার প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তির জন্যই হালকে বেছে নেয় রিং। হাল জর্ডান প্রথম মানুষ হিসেবে হয়ে উঠেন গ্রিন ল্যানটার্ন কর্পসের একজন সদস্য। স্পেইস সেক্টর ২৮১৪ কে দেখে শুনে রাখার দায়িত্ব পরে তার উপর।
মরিয়ার্টি ছাড়া তো শার্লক হয়না। তেমনি সুপারহিরো হতেও নিখুঁত ভিলেন লাগবেই। গ্রিন ল্যানটার্ন কমিক্সে এই কমতিটাও ছিলো না। IGN র্যাংকিং-এ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কমিক বুক ভিলেন দের মধ্যে ১৫তম সিনেস্ট্রোর জন্মও এই ভলিউমেই। কর্পসে প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় হালের মেন্টর হিসেবে ছিলো এই সিনেস্ট্রো। পরে আস্তে আস্তে তার চরিত্রের অন্য আরেক রূপ বেরিয়ে পরে হালের সামনে। হাল জানতে পারে, নিজের হোম প্ল্যানেট করুগার-কে সম্পূর্ণ নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। গ্রহের সবাইকে আস্তে আস্তে নিজের ক্রীতদাস বানিয়ে ফেলছে। এসব জানতে পেরে হাল তা গার্ডিয়ান এবং কর্পসের বাকিদের জানায়। সিনেস্ট্রোও ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। কর্পস থেকে গার্ডিয়ানরা তাকে বের করে দিলে, সেও প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠে। হাল-সিনেস্ট্রোর চিরশত্রুতার শুরু এখান থেকেই।
ভলিউম-৩ এর শুরু হয় ১৯৯০ সালে। জেরার্ড জোনস ও প্যাট ব্রড্রিক এবার স্টোরিলাইন সাজান একটু অন্যভাবে। আবারো হাল জর্ডানকে মূল চরিত্রে রেখেই শুরু হয় স্টোরিলাইন। তবে এবার হালের নিজের শহর, কোস্ট সিটি ধ্বংস হয়ে গেছে এমন একটা অবস্থা থেকে গল্প শুরু হয়। হালকে দেখা যায় শোকে পাগলপ্রায় হয়ে যেতে। নিজের সকল শক্তি দিয়ে শহরটিকে আবার গড়ে তোলার জন্য উন্মাদের মতো হয়ে যায় হাল। পাওয়ার রিং এর এই যথেচ্ছ ব্যবহার গার্ডিয়ান দের নজরে এড়ায় না। তারা হালের রিং নিয়ে নিতে চাইলে ক্রোধে পুরোপুরি অ্যান্টাগনিস্ট চরিত্রে রূপান্তরিত হয় সে। পুরো গ্রিন ল্যানটার্ন কর্পস ধ্বংসের জন্য উঠে পরে লাগে হাল।
গার্ডিয়ানদের গ্রহ ও গ্রিন ল্যানটার্ন কর্পসের হেডকোয়ার্টার ‘ওয়া’’ এর পথে তার অভিযানে সে অসংখ্য গ্রিন ল্যানটার্নকে হত্যা করে। হত্যা করে চিরশত্রু সিনেস্ট্রো কেও। শেষমেশ গার্ডিয়ানদের হত্যা করে ওয়া এর দখল নিয়ে নেয় হাল জর্ডান। ওয়া এর সেন্ট্রাল পাওয়ার ব্যাটারির দখল নিয়ে সে হয়ে ওঠে অকল্পনীয় শক্তির অধিকারী। সুপারভিলেইন প্যারালাক্স-এ রূপান্তরিত হয় হাল জর্ডান। এরপর কাইল রেনার নামের এক তরুণ ছাত্রকে নতুন প্রোটাগনিস্ট চরিত্র হিসেবে নিয়ে আসা হয়। তাকেই নতুন গ্রিন ল্যানটার্ন হিসেবে গল্প এগোতে থাকে।
তবে গ্রিন ল্যানটার্ন চরিত্রে আরো অনেকেই এসেছে নানান সময় গল্পের প্রয়োজনে। জন স্টুয়ার্টের কথা আলাদা করে কমিক প্রেমিদের মনে থাকার কথা। ডিসি অ্যানিমেটেড ইউনিভার্সের দর্শকদের কাছে গ্রিন ল্যানটার্ন মানেই জন স্টুয়ার্ট। তাছাড়া ডিসির ইতিহাসে জন স্টুয়ার্টই প্রথন কৃষ্ণাঙ্গ সুপারহিরো। গাই গার্ডনার, সাইমন ব্যাজ নামের দুটি চরিত্রও কিছু ইস্যুতে গ্রিন ল্যানটর্নের হিসেবে গল্পে ছিলেন।
লেখক জিওফ জনস ও শিল্পী কার্লোস পাচেচোর তত্ত্বাবধানে ভলিউম-৪ শুরু হয় ২০০৫ সালে। তারা আবার প্রোটাগনিস্ট হাল জর্ডানকে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করেন। প্যারালাক্সকে ভয়ের একটি পরজীবী সত্ত্বা হিসেবে পাঠকদের সামনে নিয়ে আসেন তিনি। সেই সাথে মৃতপ্রায় কোস্ট সিটিতে ফিরিয়ে আনেন হাল জর্ডানকে। আস্তে আস্তে শহরকে গড়ে তোলায় মনোযোগ দেয় হাল। ইউনাইটেড স্টেইট এয়ার ফোর্সে পাইলট হিসেবেও আবার যোগ দেয় সে। জনস শুধু যে হালকে ফিরিয়া আনেন তাই নয়, সিলভার এইজ গ্রিন ল্যানটার্ন যুগের অনেক ভিলেনকেও ফিরিয়ে আনেন তিনি। হেকটর হ্যামন্ড, শার্ক ও ব্ল্যাক হ্যান্ড এর সাথে আবার লড়তে দেখা যায় গ্রিন ল্যানটার্নকে। ২০১১ এর মে মাসে এই ভলিউম শেষ হয়।
কিন্তু পঞ্চম ভলিউমের জন্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় নি ল্যানটার্ন ভক্তদের। ৪ মাস পর, সেপ্টেম্বরেই নতুন ইস্যু নিয়ে হাজির হন সেই জিওফ জনস। একদম আনকোরা ভাবে শুরু করেন তিনি এবার। চতুর্থ ভলিউমের শেষেই তারা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, এ পর্যন্ত ডিসি ইউনিভার্সে গ্রিন ল্যানটার্ন সম্পর্কিত সকল স্টোরিলাইনকে পিছনে ফেলেই পঞ্চম ভলিউম শুরু করবেন তারা। হলোও তাই। ‘The New 52’ নামের নতুন স্টোরিলাইনে হাল জর্ডানকে পাওয়া গেলো আগের চেয়ে ৫ বছর কম বয়সী হিসেবে। নতুন করে আবার সিনেস্ট্রো কেও নিয়ে আসা হলো। ২০১৬ সালে এই ভলিউম শেষ হয়। এখন ‘Hal Jordan and the Green Lantern’ এবং ‘Green Lanterns’ নামের দুটি আলাদা কমিক্স সিরিজ চলছে।
গ্রিন ল্যানটার্ন কর্পসের শপথ টা দিয়েই লেখাটা শেষ করি।
“In brightest day, in blackest night,
No evil shall escape my sight.
Let those who worship evil’s might
Beware my power, Green Lantern’s Light.”