চলচ্চিত্রে নদীর রাজত্ব ও হালদা

১ ডিসেম্বর মুক্তি পেতে যাচ্ছে তৌকির আহমেদের চতুর্থ চলচ্চিত্র ‘হালদা’। এই হালদা মূলত খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি নদী। সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া এই নদীটি আবার একটি কারণে দেশের তো বটেই, সম্ভবত পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই অনন্য। নদীটি মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র, এবং সম্ভবত পুরো দক্ষিণ এশিয়াতে এটিই একমাত্র নদী যেখানে রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন হয়।

এই হালদা নদী ও তার আশেপাশের মানুষের জীবনযাত্রাকে কেন্দ্র করেই তৌকির আহমেদ তার ‘হালদা’ বানিয়েছেন। স্থানীয় সাংস্কৃতিক উপাদান হিসেবে তাতে আছে নৌকাবাইচ, বলি খেলা ইত্যাদির দৃশ্য। চরিত্রগুলোও হালদা তীরেরই মানুষজন। তারা হালদার উপর নির্ভর করেই জীবনধারণ করেন। অর্থাৎ হালদা ভালো না মন্দ হয়েছে, তার জন্যে অপেক্ষা করতে হলেও, এটা নিশ্চিতভাবেই বলে দেয়া যায় যে- ‘হালদা’ একটি নদীকেন্দ্রীক চলচ্চিত্র।

ঢাকার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র জাগো হুয়া সাভেরা ছিল নদীকেন্দ্রীক চলচ্চিত্র

এমন নদীকেন্দ্রীক চলচ্চিত্র নির্মাণ ঢাকায় খুব জনপ্রিয় নয় বটে, তবে নতুন নয় একেবারেই। বরং এটি ঢাকার চলচ্চিত্রের সবচেয়ে পুরনো প্রবণতাগুলোর একটি। ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পরে ঢাকায় দ্বিতীয় যে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছিল, সেটিই ছিল এমন একটি নদীকেন্দ্রীক চলচ্চিত্র। ১৯৫৯ সালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ থেকে এ জে কারদার বানিয়েছিলেন ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ (ডে শ্যাল ডন)। চলচ্চিত্রটি ২০১৬ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয় কান ক্ল্যাসিকস ইভেন্টে।

‘জাগো হুয়া সাভেরা’-রও আগে কাজ শুরু হয়েছিল ‘আসিয়া’-র। মূলত এফডিসি প্রতিষ্ঠার পর যে চারটি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুমোদন পায়, তার মধ্যে প্রথম কাজ শুরু হয়েছিল এটির। কিন্তু নানা জটিলতায় মুক্তি পায় সবার শেষে। এই চলচ্চিত্রেও নদীর দুর্দান্ত চিত্রায়ন হয়েছিল। তবে এটি ঠিক নদীকেন্দ্রীক চলচ্চিত্র ছিল না। এই প্রবণতার পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র মুক্তি পায় বছর ছয়েক পরেই, ১৯৬৫ সালে। এবার হুমায়ুন কবীরের ‘নদী ও নারী’ উপন্যাস থেকে একই নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন সাদেক খান।

স্বাধীনতার পরের প্রথম নদীকেন্দ্রীক চলচ্চিত্র ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম

স্বাধীনতার পরে এই প্রবণতার চলচ্চিত্র প্রথম মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। সেটার পরিচালক আবার দুই বাংলার দিগ্বিজয়ী ক্ষ্যাপাটে পরিচালক- ঋত্বিক কুমার ঘটক। কাহিনি হিসেবে নেয়া হয় জেলেপাড়ার ছেলের লেখা জেলেদের উপাখ্যান- অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম’। ঋত্বিকের বানানো একই নামের এই চলচ্চিত্রটিকে ঢাকার সেরা চলচ্চিত্রের সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও রাখতেই হবে।

মাঝে দুই দশকের একটা বিরতি। এরপর আবারও এই প্রবণতার গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মিত হতে শুরু করে। মাঝে তুলনামূলক লম্বা বিরতি পরেছিল বলেই হয়তো, এবার প্রায় একই সাথে নির্মিত হলো চারটি চলচ্চিত্র। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনায় মানিকের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ থেকে আবারো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন গৌতম ঘোষ। ১৯৯৬ সালেই মুক্তি পেল দুটি- দক্ষিণাঞ্চলের জেলেদের নিয়ে লেখা সেলিনা হোসেনের একই নামের উপন্যাস থেকে আখতারুজ্জামানের ‘পোকা মাকড়রে ঘর বসতি’ আর তানভীর মোকাম্মেলের দেশভাগকে উপজীব্য করে নিয়ে নির্মিত ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’। দুই বছর বাদে তানভীর মোকাম্মেল মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মাণ করেন ‘নদীর নাম মধুমতি’।

দক্ষিণাঞ্চলের জেলেদের উপরে আখতারুজ্জামান নির্মাণ করেন পোকা মাকড়ের ঘর বসতি

এরপরের দশক থেকে এই প্রবণতার চলচ্চিত্র আরো বেড়ে গেছে। ২০০৪ সালেই মুক্তিযুদ্ধের দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, যে দুটো ঠিক নদীকেন্দ্রীক না হলেও, দুটোতেই পুরো ঘটনা ঘটেছে নদীর বুকে নৌকার উপরে- হুমায়ুন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’ (২০০৪) এবং তৌকির আহমেদের ‘জয়যাত্রা’ (২০০৪)। পরের বছরেই তানভীর মোকাম্মেল বানালেন ‘কর্ণফুলীর কান্না’ (২০০৫)। মূল উপজীব্য অনেকটাই রাজনৈতিক বা রাজনীতি-ঘেঁষা হলেও, এটিও আসলে কর্ণফুলী পাড়ের মানুষের গল্পই। পাহাড়ি আদিবাসীরাই তো আসলে কর্ণফুলী পাড়ের মানুষ।

ঠিক তার পরের বছরে, ২০০৬ সালে আসকার ইবনে শাইখের পদ্মা তীরের মানুষদের নিয়ে লেখা একই নামের উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বাদল খন্দকার- ‘বিদ্রোহী পদ্মা’। ২০১১ সালে রাবেয়া খাতুনের মধুমতি তীরের তাঁতিদের নিয়ে লেখা একই নামের উপন্যাস থেকে শাহজাহান চৌধুরী নির্মাণ করেন ‘মধুমতি’। এমন উদাহরণ আছে আরো। আর নদীকেন্দ্রীকতার পাশাপাশি নদীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বা দৃশ্যায়ন আছে, সেটা বিবেচনা করলে, লিস্টিটা কেবল বড়ই না, বেশ ভারিও হয়ে উঠবে।

তানভীর মোকাম্মেল মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মাণ করেন নদীর নাম মধুমতি

সোজা কথায়, ঢাকার চলচ্চিত্রের শুরুতে নদীমাতৃক বাংলাদেশকে চলচ্চিত্রে রূপায়ণের যে ক্ষীণ কিন্তু সম্ভাবনাময় ধারার সূত্রপাত ঘটেছিল, সেই ধারা এখন বেশ পরিপুষ্ট হয়ে উঠছে। অবশ্য একটা উল্টো দৃশ্যও আছে। শুরুর দিকে এই প্রবণতার চলচ্চিত্র কম হলেও, মূল ধারার চলচ্চিত্রগুলোতে নদীর দৃশ্যায়ন বেশ গুরুত্ব পেত। সে গুরুত্ব এখন কমে গেলেও, মূল ধারার বাইরের চলচ্চিত্রগুলোতে নদী ঠিকই গুরুত্ব ধরে রেখেছে। সেই সাথে দিনদিন বাড়ছে নদীকেন্দ্রীক চলচ্চিত্রের সংখ্যাও। আর সব বাদ দিলেও, চলচ্চিত্রে দেশ ও দেশীয় সংস্কৃতির সঠিক উপস্থাপনকে বিবেচনায় নিলে, এটিকে বেশ সুলক্ষণ হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত।