ব্লু-হোয়েল গেইম: মরণফাঁদ নাকি গুজব!

সারাটা জীবন জেনে এসেছি ব্লু-হোয়েল বা নীল তিমি নাকি কারো ক্ষতি করে না। অথচ বিশ্বের গণমাধ্যমের দাবি অনুযায়ী, ব্লু হোয়েল গেইম (ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ) নামক এক ভার্চুয়াল নীল তিমিই নাকি কেড়ে নিয়েছে দেড়শোর মতো তরুণ প্রাণ। আঘাত হানার জন্য গেইমটি বেছে নিয়েছে কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণের টালমাটাল সময়টিকে। নিজেকে নিয়ে প্রতিনিয়ত হতাশায় ভোগা টিনেজারটি নিজের অজান্তেই নাকি অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় ঢুকে যায় ব্লু-হোয়েল চ্যালেঞ্জ নামক ব্যাডভেঞ্চারে।

বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী যেমন ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে এক একজন উপনেতার অধীনে কাজ করে, ব্লু-হোয়েল গেইমের কার্যক্রমও কিছুটা তেমনই। ব্লু-হোয়েলের প্রতিযোগীরা ছোট ছোট অনলাইন কমিউনিটি বা ভার্চুয়াল গ্রুপে একজন ভার্চুয়াল নেতা বা অ্যাডমিনের অধীনে ৫০ দিনের চ্যালেঞ্জ নামক সাইকোলজিক্যাল ম্যানিপুলেশনে অংশ নেয়। ৫০ দিনের এই মিশনের প্রতিদিনই অন্তত একটি করে আত্মবিধ্বংসী চ্যালেঞ্জ সম্পন্ন করে প্রমাণ হিসেবে ছবি অ্যাডমিনের কাছে আপলোড করে। এই ছবি দেখে গ্রুপ অ্যাডমিন সদস্যকে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ দেন। রাতে একা হরর মুভি দেখার মতো সহজ কাজ দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীতে নিজের হাত কাটা, একটি প্রাণী হত্যা করে তার ছবি পোস্ট করার মতো কার্যক্রমকে অ্যাডভেঞ্চারের মোড়কে মুড়িয়ে শুরু হয় আত্মধ্বংসের যাত্রা। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় বিভোর অনেক টিনেজাররা সেটি বুঝতেই পারেন না। সময়মতো ফেরাতে না পারলে যার শেষ হয় আত্মহত্যায়।

গেইমটি প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৬ সালের মে মাসে, একটি রাশিয়ান পত্রিকা দাবি করে, দেশটির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভিকের একটি গ্রুপের কিছু অ্যাডভেঞ্চারমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য কয়েকজন শিশু আত্মহত্যা করেছে। রাশিয়ান পুলিশ ঘটনার সত্যতা স্বীকার না করলেও এই সংবাদটিই পুরো রাশিয়া এবং পরবর্তীতে বিশ্ব জুড়ে বিশাল প্যানিক ছড়িয়ে দেয়।

ইউকে সেফার ইন্টারনেট সেন্টারসহ বেশ কয়েকজন ইন্টারনেট এক্সপার্ট বলছেন, এ ধরণের কোন গেইমের অস্তিত্ব আসলে নেই। কিন্তু, বাস্তবতা হলো, ভারত, পাকিস্তান, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ বিশ্বের ১৯টির মতো দেশে টিনেজাররা এই গেইমের প্রভাবে আত্মহত্যা করেছে বলে সেদেশের গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ফেইসবুক, টুইটার, রেডিট, কোরাসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে গেইমটি নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। এরই মাঝে ব্রিটেনসহ বিশ্বের নানা দেশের স্কুলে গেইমটি নিয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ইতিমধ্যে এই গেইমটি বন্ধের ব্যাপারে শুনানিও হয়ে গেছে। সর্বশেষ বাংলাদেশে গত ৫ অক্টোবর রাতে হলিক্রস স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর এক কিশোরী এই গেইমের কারণে আত্মহত্যা করেছে বলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলি বলছে। সুতরাং, বিষয়টিকে মোটেও হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ এই মুহূর্তে নেই।

বাংলাদেশের কিশোরী স্বর্ণার সুইসাইড নোট

ঘর পোড়ার এই টাইমে আলু পোড়া খেয়ে গেছে অনেক গেইম কোম্পানি। ব্লু হোয়েল নাম দিয়ে তারা খুলেছে অন্তত ডজনখানেক অন্য গেইম। সেগুলোর অধিকাংশই ডাউনলোডও হয়েছে মিলিয়নের উপরে।

ফিলিপ বুদেকিন নামক ২১ বছর বয়সী এক রুশ তরুণ এই গেইমের ডেভলপার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহি:স্কৃত মনোবিজ্ঞানের এই ছাত্র দাবি করেছেন, সমাজের অর্থহীন জঞ্জাল সাফ করার জন্য তিনি এই গেইম ২০১৩ সাথে আবিষ্কার করেছেন। বুদেকিন বর্তমানে ১৬ জন রুশ স্কুল বালিকাকে আত্মহত্যার প্ররোচনার দায়ে গ্রেফতার হয়ে রুশ জেলের ঘানি টানছেন।

ব্লু হোয়েলের জেরে জেলে আছেন বুদেকিন

বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়াতে জাতীয় আইটি ব্যক্তিত্বরা বলছেন, সরকারের উচিত এই গেইম ব্লক করা। এদেশের তথ্য-প্রযুক্তিতে তাদের অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেই বলা যায় টেকনিক্যালি, এটি সম্ভব নয়।

গুগল প্লে-স্টোরে নেই, অ্যাপ স্টোরে নেই, এর ডেভেলপার বুদেকিনও জেলে! তারপরও কীভাবে ছড়াচ্ছে এই মরণখেলা?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একে অপরকে না চিনলেও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা মস্তিস্ক বিকৃত অ্যাডমিনরাই এই গেইমটি বাঁচিয়ে রেখেছেন। এসব অ্যাডমিনরা কেউ বুদেকিনের বেতনভুক্ত নন, এমনি তারা একে অপরকে দেখেননি কখনো। কিন্তু, আদর্শিক জায়গায় এসব সাইকোপ্যাথরা নিজেদের এক মনে করছেন এবং অন্য সহযাত্রীর অসমাপ্ত মিশন শেষ করার দায়িত্ব নিচ্ছেন এবং এরাই অনলাইনে গেইমটি বাঁচিয়ে রাখছেন। তাই, একটি লিংক বা একটি কমিউনিটি বন্ধ করে কর্তৃপক্ষের তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার কিছু নেই।

সিদোরভ, ব্লু-হোয়েল চ্যালেঞ্জের এই অ্যাডমিনকে গত জুনে রাশিয়া থেকে গ্রেফতার করা হয়

সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, একজন সিরিয়াল কিলার যেভাবে তার পরবর্তী শিকার খুঁজে বের করে, এই গেইমের অ্যাডমিনরাও অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর মধ্যে থেকে সাইকোলজিকাল ম্যানিপুলেশন করা যাবে এমনদের খুঁজে বের করে। ব্লু-হোয়েল গেইমের প্রাথমিক কয়েকটি ধাপ শেষ হওয়ার পরেই তারা ভালনারেবলদের শনাক্ত করে পরের ধাপে এগিয়ে দেয়।

অনলাইনে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে অ্যাকটিভ কিশোর-কিশোরীদের মধ্য থেকে নিসঙ্গ, হতাশাগ্রস্থ ও অধিক কৌতূহলী-  এই তিন ধরণের টিনেজারদের টার্গেট করা হয় ব্লু-হোয়েলের শিকার হিসেবে।

ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনে আসক্ত সন্তানদের বাবা-মায়েদের এখন দায়িত্ব বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। মান্ধাতার আমলের প্যারেন্টিং ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে নিজেদেরকে বদলে ফেলা উচিত এসময়ের বাবা-মায়েদের। এ প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীরা বড্ড অভিমানী, তাই তাদের সাথে হতে হবে বন্ধুর মত সহজ। সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের বিচরণের খোঁজ-খবর রাখুন। দেখুন, সে হতাশাগ্রস্ত, নিসঙ্গ, নাকি কৌতূহলী? সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। তাতে আত্মবিধ্বংসী নয়, বরং আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হবে আপনার সন্তানের।

ব্লু-হোয়েলের ডেভেলপার ফিলিপ বুদেকিন চেয়েছিল এই অ্যাপ দিয়ে সমাজের সেইসব জঞ্জাল সাফ করতে, যাদের জীবনের কোন মূল্য নেই। লক্ষ্য করুন, বুদেকিনও কিন্তু এই গেইমের অংশগ্রহণকারীদের জঞ্জাল ও মূল্যহীন বলছে, যারা তার ফাঁদে পা দিয়ে আত্মাহুতি দিচ্ছে। তাই, যুদ্ধটা ব্লু-হোয়েল গেইমের বিরুদ্ধে না, যুদ্ধটা আসলে নিজের সাথে। এরকম সাইকোপ্যাথ আরো আসবে, আরো গেইম আসবে, কিন্তু সুরক্ষার সূত্রটা একই। নিজের সম্ভাবনার কথাটা জানতে পারা। প্রতিটি জীবনই তার নিজের কাছে, বাবা-মায়ের কাছে ও সমাজের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ প্রাণের রয়েছে অসীম সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনায় বাধা আসবে, হতাশা আসবে। জীবন বুদেকিনের তৈরি জঞ্জাল নয়, নয় কোন আত্মঘাতী গেইমের ধাপ। একুশ শতকের জন্য জন্য নিজেকে ধাপে ধাপে তৈরি করার মাঝেই আসল অ্যাডভেঞ্চার, যে এটি পার হতে পারবে সেই রিয়েল উইনার।