১.
‘হাসিমুখ থেকে আবার হাসিমুখ, নাগরিক কোলাহল থেকে নাগরিক উপকূল, জানালা থেকে জেব্রা ক্রসিং, শহুরে দেয়াল থেকে ধূসর খেয়াল, ইচ্ছে ফড়িং, রঙহীন ফড়িং বা যান্ত্রিক ফড়িং’-এ সবই ভাবনার নতুন আমেজে আমাদের সামনে ফুটে উঠেছে শিরোনামহীন ব্যান্ডের বদৌলতে। এই নগরের হয়ে, নগরকে আপন মনে ধারণ করে, নগরের আনন্দ-বেদনা-বিরহ-হতাশা বুকে বয়ে বেড়িয়েছে এই ব্যান্ড দল। যান্ত্রিক এই শহরকে বিভিন্ন ভঙ্গিতে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে, বিভিন্ন মননে দেখার যে ঐকান্তিক শক্তি তা এই ব্যান্ড দলের অন্যতম গীতিকার জিয়াউর রহমান জিয়ার ছিল। শিরোনামহীনকে বলা যায় এই নগরের বা শহরের নাগরিক কবিয়াল। কবিতার ছন্দ ও সুরের গাঁথুনিতে ব্যান্ড দলটি যেভাবে এই নগরকে উপস্থাপন করেছে তারা তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
প্রথম অ্যালবাম জাহাজী’র ‘হাসিমুখ’ গানটিতে উঠে আসে রাস্তা, নীরবতা, এবং নাগরিক ও তার আনন্দধারার কথা।
”প্রতিটি রাস্তায় প্রতিটি জানালায়
হাসিমুখ, হাসিমুখে আনন্দধারা
……………………………………
হারিয়ে যেতে চাই, তোমাদের রাস্তায়,
অনেক অজানা ভীড়ে স্বচ্ছ নিরবতায়,
রোদ উঠে গেছে চেনা এই নগরীতে নাগরিক জানালা
হাসিমুখে একাকার।
আনন্দ উৎসব চেনাচেনা সবখানে,
এরই মাঝে আমাদের ছুটে যাওয়া দরকার।”
শিরোনামহীন-এর পাঁচটি অ্যালবামের চারটিতেই এই শহরকে নিয়ে গান ছিল। শহরের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর একে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করার প্রয়াসে তারা সব সময় ছিল অটুট। যান্ত্রিক শহর বা নগরীকে নিয়ে আমাদের দেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে এতো বেশি গান আর কেউ লিখেনি।
‘পাখি’ গানে উঠে আসে নাগরিক কোলাহল, শহুরে দেয়াল, ব্যস্ত জনপথ, ব্যস্ত মানুষের কথা।
”কিছু সুর তুমি এনে দাও পাখি নাগরিক কোলাহলে
তুমি গান গাও, তুমি শীষ দাও এই শহুরে দেয়ালে
তুমি ভুলে যাও এই শহরের যত ব্যস্ত জনকথা
আমি এসেছি তোমার কাছে এনে দাও স্বাধীনতা।”
২.
নগর তথা শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ মেঠোপথ, গ্রামীণ জনপদ, প্রকৃতিকেও উপস্থাপনে তাদের সহজাত ভিন্ন আঙ্গিক ছিল চোখে পড়ার মতো। স্থাপত্য, দালান, ট্রাফিক, রাজপথ, কোলাহলকে নিজেদের গানে ধরে রাখার এক অদ্ভুত দ্যোতনাময় খেয়াল এ ব্যান্ড দলটির মধ্যে লক্ষ্য করা যায়।
‘শহরের কথা’ গানে উঠে আসে অদ্ভুত সব ভাবনার কথা। সেই ভাবনাগুলো ঘুরে ফিরে আসে যানজট আর দালান-কোঠার দাপটে ঢেকে যাওয়া আকাশ, গানের শরীরে নির্লিপ্ত শহরের ছবিতে।
”রাস্তায় একফালি নিঃশ্বাস
অন্ধ শহরে ছুটে চলা বাস
হাউজিং জ্যামে আকাশ অল্প
শহর মানেই গ্রামের গল্প।”
একঘেঁয়ে প্রেম ভালোবাসাকে পাশ কাটিয়ে একটি ব্যান্ড দলের নিরন্তর নগরীর প্রতি দায়বদ্ধতার চিরন্তন প্রচেষ্টা আমাদের মনে করিয়ে দেয় একটি সুন্দর নগরী গড়ে তোলার জন্য আমাদের সবারই যেমন সুদৃষ্টি প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চেষ্টাও। মজার ব্যাপার হল, একাধিকবার একাধিক গানে নগরীর উপস্থাপনশৈলী শ্রোতাদের মনে কোনো ধরনের বিরক্তি আনেনি বরং প্রতিবারই নতুন কিছুর স্বাদ পেয়েছেন শ্রোতারা।
‘আবার হাসিমুখ’ গানে উঠে আসে নাগরিক ঢেউয়ে উপচে পড়া মানুষ, বুকের ভেতরে ডানা ঝাপটানো পাখির আর্তনাদ, রোদ্দুরে ছুটে চলা ঝলমলে দিন, প্রজাপতির উড়ে বেড়ানোর কথা।
”বৃষ্টি ভেজা সুখ-দুখ, খোলা জানালায় হাসিমুখ
উড়ছে কিছু প্রজাপতি-মেঘ মনের জানালায়।
জানালায় ছিল রোদ্দুর, মেঘ ভেসে গেল বহুদূর
নগরের প্রিয় চিরকুট-সব জীবন ছেড়ে পালায়।
তুমি চেয়ে আছ তাই আমি পথে হেটে যাই,
হেটে হেটে বহুদূর, বহুদূর যেতে চাই।”
৩.
বৃষ্টিস্নাত এই শহরের রূপ কি? বৃষ্টির আনন্দ-বেদনার রং কি? এই সবই ব্যান্ড দলটি তুলে আনে ‘বৃষ্টিকাব্য গানে’। যান্ত্রিক ফড়িংয়ের সাথে রিক্সার পেইন্টিংয়ের মেলবন্ধন, অসহায় রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাওয়া, কাশফুল বনে ছুটে যাওয়া, রিমঝিম বৃষ্টিতে উত্তাল মনের আস্ফালন- সবই যেন এক একটি ফ্রেমে বাঁধানো ছবি।
”আজ জানালার বাইরে একঝাঁক বৃষ্টি রিমঝিম রিমঝিম
বইছে বাতাস, কাশফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে
রাস্তার সিগন্যালে কন্ডাকটর জেব্রা ক্রসিং
অনেকদিন হেরে যাওয়া মন দিলো ধুয়ে!
রাজপথে ছুটে যায় যান্ত্রিক ফড়িং আর রিক্সায় আঁকা পেইন্টিং
নাগরিক বৃষ্টির ছাতে রবীন্দ্রনাথ অসহায়
তাই কন্ডাকটর জেব্রা ক্রসিং।”
কিশোরীর সুনিপুণ হাতে সুতোয় বোনা সবুজ গ্রাম, রং তুলিতে আঁকা বাংলার অবিরাম মুখচ্ছবি, রিমঝিম বৃষ্টি, কুয়াশার চাদরে ঢাকা শহর, সূর্যের রংয়ে আঁকা রাজপথ-এ সবই আমাদের বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। শিরোনামহীন নিজেদের নিপুণ গঠনশৈলীর মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ’ গানে তুলে ধরেছেন।
”যখন এক চোখে ঘুম ঘুম, এক চোখে নীল রাত
আমায় ভাবিয়ে যায়
যখন এক হাতে রোদ্দুর এক হাতে গোলাপ
সবুজ ছুঁয়ে ভাবায় আমায়
একদিকে নীল নীল, এক দিকে কাশফুল, দুচোখ যেখানে শেষ
এক প্রান্তে সবুজ, এক প্রান্তে লাল,
আমার বাংলাদেশ।”
৪.
১৯৯৬ সালে গড়ে উঠা এই ব্যান্ড দল গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের উপহার দিয়েছে অসংখ্য গান, অসংখ্য সুর, অসংখ্য আনন্দ-বেদনার লাল-নীল কাব্য। ‘হাসিমুখ’, ‘ক্যাফেটেরিয়া’, ‘বন্ধ জানালা’, ‘পাখি’, ‘ইচ্ছে ঘুড়ি’, ‘জাহাজি’, ‘বাংলাদেশ’, ‘বুলেট কিংবা কবিতা’, ‘শহরের কথা’, ‘আবার হাসিমুখ’, ‘শনশন যদিও কাশবন’-এইসব গান আমাদের কানে বাজবে প্রতিনিয়ত, এই সব সুর আমাদের বার বার আবেগতাড়িত করে তুলবে।
গানে গানে নগরের প্রতি শিরোনামহীন-এর দায়বদ্ধতাই আমাদের মনে করিয়ে দেয় নগরের জনপথ, নৈসর্গিক সৌন্দর্য, চেনা-অচেনা আরও কতশত নাগরিক ছবি। নগরের এ সব ছবি ও ভাবনার সম্মিলন আমাদের মুগ্ধ করে প্রতিনিয়ত। মুগ্ধতার এমন সম্মোহনে আমাদের সবার মাঝে টিকে থাকবে এই নগর, টিকে থাকবে নাগরিক কবিয়াল শিরোনামহীন।