জেমসঃ আমাদের নাগরিক বাউল

পুরো নাম ফারুক মাহফুজ আনাম। যাকে আমরা জেমস নামেই চিনি। ভক্তদের কাছে তিনি আবার ‘গুরু’। যে নামেই তাকে চেনানো হোক না কেন, বাংলাদেশি রক মিউজিক শোনেন কিন্তু জেমসকে চেনেন না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

উত্তরবঙ্গের এই ছেলের জন্ম নওগাঁর পত্নীতলায়। যদিও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মচারী, যিনি পরবর্তীতে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। গানের জন্য বাবার সাথে অভিমান করে ঘর ছাড়েন। ঠাঁই জোটে চট্টগ্রামের আজিজ বোর্ডিংয়ে। আর এই আজিজ বোর্ডিং ঘিরেই গড়ে ওঠে তার গানের জগত। প্রথম ব্যান্ড ‘ফিলিংস’-এর জন্মও সেখানেই।

১৯৮৭ সালে ফিলিংসের প্রথম অ্যালবাম “স্টেশন রোড” বাজারে আসে। পরের বছরই প্রকাশ পায় তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘অনন্যা’। পরবর্তীতে এই ফিলিংস ব্যান্ডের নাম পরিবর্তন করে ‘নগর বাউল’ রাখা হয়।

শুরু থেকেই জেমস সমসাময়িক রক শিল্পীদের থেকে নিজেকে নিয়ে একটু আলাদা করে ভেবেছেন। ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় জুড়েই ব্যান্ডের সাথে যুক্ত থাকলেও ব্যাক্তি জেমসকেই তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। তাই একটু খেয়াল করলে দেখবেন, নগর বাউল বা ফিলিংস বলতে আপনি আসলে শুধু জেমসকেই চেনেন।

মঞ্চ কাপাচ্ছেন জেমস

বাংলাদেশের সংগীতে শিল্পী জেমসের সবচেয়ে বড় অবদানটা বোধহয় রক মিউজিকের গ্রহণযোগ্যতা তৈরির ক্ষেত্রে। ৮০-৯০ এর দশকে এই দেশে রক সংগীতের জনপ্রিয়তার ধরণ এমন ছিলো না। প্রতি সপ্তাহে শহরের নানান প্রান্তে সব মিলিয়ে ৮-১০টা কনসার্ট হবার মতো পরিবেশ বা যথেষ্ঠ দর্শককুল কোনটাই ছিলো না। রক সংগীতের পরিধি তখনো গুটিকয়েক শহুরে কিশোর-কিশোরীর গল্প-আড্ডা-ভালো লাগার মধ্যেই আবদ্ধ। আর সেই সময় এধরনের সংগীতের সমালোচনাও ছিলো প্রচুর। প্রবীণেরা তখনো এত সহজে ব্যান্ড সংগীত গ্রহণ করেনি। অপসংস্কৃতির চর্চা বলে বারবার প্রশ্নবিদ্ধও করা হয়েছে তার কাজকে।

কিন্তু এখানেই জেমস অনন্য করে তুলেছেন নিজেকে। তিনি তার গানের মাধ্যমে নতুন এক ভাষা তৈরি করেছেন যা গ্রহণ করে নিয়েছিলো দেশের সবাই। কনসার্ট উন্মাদনার শুরুও তার হাত ধরেই। ‘সুন্দরীতমা আমার’, ‘মান্নান মিয়ার তিতাস মলম’, ‘লেইস ফিতা লেইস’, ‘দুঃখিনী দুঃখ করোনা’, ‘বাংলাদেশ’, ‘মীরাবাঈ’ এরকম গানগুলো পাড়ায় পাড়ায় বেজেছে প্রত্যেকটি উৎসবে। ‘আমি তারায় তারায় রটিয়ে দিবো’ এর সুর-কথার সাথে শুধু শহুরে নিয়মিত রক শ্রোতারা মাথা দোলায়নি, মাথা দুলিয়েছে দেশের সকল বয়সের সকল অবস্থানের মানুষ। এলাকার যেসব মুরুব্বিরা ‘ব্যান্ড মানেই চিল্লাচিল্লি’ এই আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, তারাও একসময় “ভোরের তারা রাতের তারা মাকে জানিয়ে দিস/ অনেক কেঁদেছি/ আর কাঁদতে পারি না।” –এই কথাগুলোর সাথে ঠোঁট মিলিয়েছেন।

আগেই বলেছি, জেমস তার ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় জুড়ে নিজের সলো ক্যারিয়ারের প্রতিই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। তিনি শুধু একটি বড় ব্যান্ড দলের স্বপ্ন দেখেননি। জিম মরিসন, এরিক ক্লাপটন, মার্ক নফলারদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের মতো একজন প্রতিষ্ঠিত সলো রক আর্টিস্ট হবার স্বপ্নই তিনি দেখেছেন, এবং সারাজীবন সেই স্বপ্নকেই তাড়া করেছেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার চেয়ে সফল কেউ অন্তত এই দেশে নেই। এজন্যই তিনি শুধু বাংলা গানেই আটকে থাকেননি। বলিউডেও হয়েছে তার তুমুল জনপ্রিয়তা। ‘ভিগি ভিগি’, ‘চল চলে’, ‘আলবিদা’, ‘বেবাসি’ গানগুলো মাতিয়েছে পুরো বলিউড। বলিউড টপচার্টের শীর্ষে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ছিলো ‘ভিগি ভিগি’ গানটি।

জেমসের আরেকটি অসাধারণত্বের জায়গা হলো তার গানের কথা। সেই সময়কার সেরা সব গীতিকার আসিফ ইকবাল, লতিফুল ইসলাম শিবলি, বাপ্পি খান, দেহলভি, মারজুক রাসেল, গোলাম মোরশেদ, প্রিন্স মাহমুদ জুয়েল-বাবুদের তার জন্য আলাদা করে গান লিখতে হতো। গানগুলো তাই বেঁচেও রয়েছে বহুদিন। আজও যারা কিশোর বয়সে নতুন করে পা দিচ্ছে তারা ২০-২৫ বছর আগে বের হওয়া জেমসের গান শুনছে। গানগুলোর মাদকতা এত সময় পরেও এক বিন্দুও কমেনি।

তাই সব মিলিয়ে জেমস শুধুমাত্র একজন শিল্পী হয়ে আটকে থাকেন নি। লম্বা কোঁকড়ানো চুল, কালো আলখেল্লা, হাতে গিটার, চোখ-মুখের কাঠিন্য এসবকিছু নিয়ে তিনি একজন রকস্টার। সম্ভবত আমাদের একমাত্র রকস্টার। তিনি নিজেই একটি ব্র্যান্ড, একটি আইকন।