একটি চলচ্চিত্রকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, রিভিউ করা যায়। জনগণের সম্মতির অর্থাৎ পয়সা খরচ করে দেখতে যাওয়ার বিষয়টা সংশ্লিষ্ট থাকায় নির্মাতাদের একধরণের জবাবদিহিতার দায়ও থাকে। সে জবাব নির্মাতা পেতে পারেন বক্সঅফিসে, আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মঞ্চে। কিন্তু দর্শক আসলে কি দেখেছে সেটি যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে চলচ্চিত্র হিসেবে ‘ডুব’ কতটুকু প্রত্যাশা পূরণ করেছে দর্শকের সেটা বিবেচনার প্রয়োজন আছে।
আসুন না, দেখে নেওয়া যাক ইতি ও নেতির হিসেবের ছকে বছরের সবচেয়ে আলোচিত সিনেমা ডুবকে।
+/ ইতিবাচকতা:
ডুবের সিনেমাটোগ্রাফি দুর্দান্ত! শেখ রাজিবুল ইসলামকে ধন্যবাদ দুর্দান্ত দৃশ্যগুলোর জন্য। এরিয়েল শট বা লং শটে প্রকৃতির দৃশ্য “বিউটিফুল বাংলাদেশ”কে ফুটিয়ে তুলেছে। অবশ্য নিম পাতার ফাঁকে বা কৃষ্ণচূড়ার মাথার উপর দিয়ে তোলা দৃশ্যের বারংবার ব্যবহারে মনে হয়েছে, নির্মাতা ফারুকী হয়তো ভেবেছেন, ভাল জিনিস যত বেশি দেওয়া যায় ততোই ভাল।
ভালো অভিনয় করেছেন ইরফান খান (সেটা অবশ্য তার কাছে প্রত্যাশিতই)। যদিও চেষ্টা করে বাংলা বলার ত্রুটি থেকে তিনি মুক্ত হতে পারেননি। কলকাতার পার্ণো ছিলেন সাবলীল এবং দারুণ অভিনয় করেছেন তিশা (যদিও সিনেমায় তার প্রেজেন্সের কারণে দর্শকের মাঝে মাঝেই মনে হবে জাভেদের অন্য সন্তানেরা কোথায়, তাদের বাবা কি তাদেরও ছেড়ে যাননি)!
ডুবে ব্যবহৃত চিরকুটের করা গানটি এবং সিনেমায় গানটির প্লেসমেন্ট ছিল খুবই ভালো।
-/নেতিবাচকতা:
এত্ত ভালো দৃশ্যায়নের পরেও প্রত্যাশা পূরণ করেনি ‘ডুব’ কারণ নির্মাতা সিনেমার শুরুই করেছেন মিথ্যাচার দিয়ে! বহুদিন ধরে ঢাক গুড় গুড় করে সিনেমার রিলিজের আগে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নিজেই বলেছেন, বুসানে থাকা অবস্থায় তিনি হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর খবর পান এবং মৃত্যু পরবর্তী দাফন নিয়ে যে জটিলতা শুরু হয় তা থেকেই এই সিনেমার গল্পটির প্রেরণা পাওয়া! অথচ ছবির শুরুতে ডিসক্লেইমার- ‘এই চলচ্চিত্রের সকল চরিত্র কাল্পনিক এবং জীবিত বা মৃত কারো সাথেই কোন সম্পর্ক নেই’! এটা বলে তিনি আসলে কাকে প্রবোধ দিতে চাইলেন সেটা বোধগম্য না! দর্শক তো ট্রেলার দেখেই বুঝেছে, এটা কার জীবনের গল্প থেকে নেয়া!
অকারণ এই মিথ্যাচারের মানে কি! বললেই হতো- ‘সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত!’ কী ক্ষতি হতো তাতে! ইরফানের ক’দিন আগের সিনেমা ‘তলওয়ার’ও তো নয়ডার ডাবল মার্ডার কেস থেকে নেওয়া! বলছেন বায়োপিক না! মানলাম, কিন্তু ইন্সপায়ার্ড না এটাও মানতে হবে দর্শককে? কেন?
সিনেমার আরেক স্ববিরোধিতা হচ্ছে, গল্প বলায় একটা গা ছাড়া ভাব! একজনের গাড়ি থেকে নীতুর বেরিয়ে আসা, একটা পেপার কাটিং এবং তা নিয়ে তুমুল কলহের জেরে দাম্পত্য সম্পর্কের টানাপোড়্ন, ক্ষমা চাওয়া এবং স্যরি বলে বেড়াতে যাওয়ার পরেও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অবনতি কি নিয়ে সেটা কিন্তু শুধু সিনেমাটির দর্শকের কাছে পরিস্কার না। হুমায়ূন আহমেদের গল্প, এটা দর্শক জানে বলেই কি এই ছাড়! কারণ নির্মাতা জানেন যে, দর্শক জানে পুরো সিনেমায় ‘স্যার’ বলে সম্বোধিত হওয়া জাভেদের দ্বিতীয়বার বিয়ে হবেই, এবং সেটা মেয়ের বান্ধবীর সাথেই। সুতরাং, একটি দাম্পত্যের ক্রমান্বয়ে ক্ষয়ে যাওয়া আর মেয়ের বান্ধবীর প্রেমে পড়ার মতো সিরিয়াস ইস্যু তিনি দর্শককে দেখানোর প্রয়োজনই বোধ করেননি। আস্ত ‘গান্ধি’ বানিয়েছেন ‘সল্ট মার্চ’ ছাড়াই।
এদিকে নতুন পরিবারে জাভেদের বয়ে বেড়ানো ক্ষত কিংবা ফেলে আসা পরিবার নিয়ে ভাবনার গল্প না এগিয়েই ক্যামেরা প্যান করে শুরু হলো মিলাদ। মেরে দিলেন জাভেদকে! এখানেও তিনি দর্শকের ভরসায় রইলেন কারণ দর্শক জানে নায়ক মারা যাবেই। তাহলে প্রথমে কাল্পনিক ঘোষণা দিয়ে, গল্প এগিয়ে নেয়ার ভার দর্শকের হাতে ছেড়ে দেয়াটা তার চালিয়াতি বই আর কিছু নয়!
সিনেমায় দর্শককে ধরে রাখতে হলে হয় সাসপেন্স তৈরি করতে হয় নতুবা কোন জীবনবোধ জাগাতে হয়! পিতৃতান্ত্রিক সাংস্কৃতির ধারক বাহক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর কাছে সেখানেও হতাশা বাদে আর কিছু জুটবে না টিকেট কেটে হলে ঢুকে পড়া দর্শকদের। নারীর নিজের পায়ে দাঁড়ানোকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ‘বিউটিফুল উইম্যান’ বলে! যেন নারী সারাজীবন ধরে খালি বিউটিফুলই হতে চায়!
এত আবেগের কথা বলা, রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলোর আবেগ নিয়ে কথা বলা নির্মাতা জাভেদের মৃত্যুর পরে কিন্তু তার তৎকালীন স্ত্রী যে কিনা নিজে তরুণ এবং জাভেদের শিশু সন্তানের মা, তার আবেগের জন্য এক ইঞ্চি সেলুরয়েডের ফিতাও খরচ করেননি!
বাবার প্রতি অতল ঘৃণা পুষে বেড়ানো পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ডিম ভাজি খেতে চাওয়া সন্তানকে দেখিয়ে ফারুকী কি এবং কতখানি একান্ত ট্রেডমার্ক ‘নাখালপাড়া স্মার্টনেস’ প্রকাশ করলেন, তা বোধগম্য নয়।
সিনেমায় নীতুর সম্পর্কে জাভেদের ভাইকে বলতে দেখা যায়- যেভাবেই হোক নীতু তো তার স্ত্রী! তার মানে নীতুর স্ত্রীর মর্যাদাও নির্মাতার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ! পরিচালক অবশ্য এর আগেও পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছেন- শাওন, হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী। কিন্তু আহমেদ পরিবার এদেশের সাহিত্য-বিনোদনের ফার্স্ট ফ্যামিলি বলে দর্শকমাত্রেই জানেন, হুমায়ুন আহমেদের সব সময়ই একটিই স্ত্রী ছিল! যখন গুলতেকিন ছিলেন, তখন শুধুমাত্র গুলতেকিন, যখন শাওন ছিলেন তখন শুধুমাত্র শাওন! উনার এই দ্বিতীয় স্ত্রী ফর্মুলা পরিস্কারভাবেই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই ফসল!
অনেকেই বলছেন, তিনি নিজেও বলছেন- এই সিনেমায় কোনো ভিলেন নেই কিন্তু নীতুকে ভিলেন বানিয়েছেন নির্মাতা। মায়ার পছন্দ করা পর্দা সরিয়ে ফেলা, সাবেরীর জন্য কেনা উপহার গাড়ি থেকে চুরি করে নেওয়া, সেটা নিয়ে ঝগড়া করা এগুলো দিয়ে নীতুকে ভিলেন হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিতে নির্মাতার চেষ্টার কমতি ছিলো না!
সবশেষে বলতেই হয়, নির্মাতা যাদের গল্প বলার চেষ্টা করেছেন, যদি তাদের সাথে আলাপ করে নিতেন তবে চিরকুটের ‘আহারে জীবন’-এর মতো পুরো ছবিটাই একটা মহৎ ছবি হয়ে উঠতে পারতো কারণ এই ছবিটার মধ্য দিয়েই হয়তো একদিন পরবর্তী প্রজন্ম হুমায়ূন আহমেদকে চিনতো! আর ‘ডুব’ নামের সিনেমায় তাকে ও তার পরিবারকে যে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হলো সেই এই দায় কি নির্মাতা ফারুকী এড়াতে পারবেন?