ডুব দিয়াছি কিন্তু চুল ভেজেনি

‘পানির নীচে’ দ্যোতনা হিসেবে শব্দটি বেশ জম্পেশ। সম্ভবত সেকারণেই পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার ‘ডুব’ সিনেমায় শব্দের ব্যবহার এতটাই সীমিত রেখেছেন যে মনে হয় স্টাইলটি কোন ইরানি চলচ্চিত্র থেকে ইন্সপায়ারড!

ভাল অভিনয়ের মোরগ লড়াইটা এই চলচ্চিত্রের বিশাল বড় এক পাওয়া। সবার চরিত্রানুযায়ী অভিনয় দক্ষতা প্রদর্শন, সাথে শিল্পী নির্বাচনের যথার্থতা। তিশা তার অভিনীত “কাল্পনিক” চরিত্রে ভয়াবহ বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছেন। রোকেয়া প্রাচীও নিজের চরিত্রটিও সততার সাথেই ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু সৈয়দপুরের ছেলের উচ্চারণ অ্যাংলো-বাঙালি টাইপ হওয়াটা বাঘা অভিনেতা ইরফান খানের পারফরমেন্সকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করেছে।

চলচ্চিত্রটি’র সম্পদনার ক্ষেত্রে মিডিওকার বলে কোনো বিষয়ই ছিলোনা। কখনো সেটা বড়ই উচ্চমানের নয়তো মাত্রাতিরিক্ত নিম্নমানের। যেমন শট ট্রানজিশনের ক্ষেত্রে ইন্টারেস্টিং সিমিলারিটি বজায় রেখে পাহাড়ি রাস্তায় চলমান গাড়ি থেকে আচমকা শহুরে ফ্লাইওভারে মধ্যিখানে চলে আসা কিংবা এক বাড়ির সিঁড়িতে এক চরিত্রের পা ঝুপ করে আরেক বাড়ির অন্য কোনো এক সিঁড়িতে অন্য চরিত্রের পায়ে চলে যাওয়া। আবার এই অসামান্য সম্পাদনার বরাতেই কিছু দৃশ্য আগে যে বাক্সটি সরিয়ে বহু বাকবিতণ্ডার আবর্তন ঘটানো হল, সেই বাক্সটিই আবার হাতে নিয়ে মেয়ের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা বিষয়টা সম্পাদক মোমিন বিশ্বাস এবং পরিচালক হিসেবে ষষ্ঠ সিনেমা বানিয়ে ফেলা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী কিভাবে সাজালেন তা বোঝার কোন উপায়ই নেই।

হাতঘড়ি পানিতে ফেলে দিয়ে প্রথম স্ত্রী’র সাথে রোমান্স খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় পুরোনো জীর্ণ বিয়ের স্মৃতিচারণে স্ত্রীর বর্তমান অবস্থান নিয়ে তোলা প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলতে না পারাটা কি- ঘড়ি ফেলে দেয়ার মধ্য দিয়ে জাভেদের মানসিক অবস্থানে সময়কে অস্বীকার করার মন্তাজের সৃষ্টি করে নাকি শটটা সুন্দর তাই রেখে দেই টাইপের ঘটনা- সেটা শুধু পরিচালকই বলতে পারবেন। আরও আরও এমন কিছু অহেতুক দৃশ্য যা একটি পরিবার নিয়ে তৈরি করতে চাওয়া চলচ্চিত্রের মধ্যে কোথা থেকে এসেছে তা বুঝতে পারাটা সাধারণ দর্শকের পক্ষে বোঝা সত্যি সম্ভব হয়নি।

তবে সকল বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে পর্দায় প্রথম সেকেন্ড থেকে শেষের টাইটেল ওঠা পর্যন্ত ডুব-এর জাভেদ যে ‘হিমুর স্রষ্টা’ তাতে জীবনে একটিও ‘হুমায়ূন আহমেদ’ না পড়া মানুষেরও কোন সন্দেহ থাকবার অবকাশ থাকেনা। চলচ্চিত্রটির বেশ কিছু ডায়লগ পত্রপত্রিকায় ছাপা হওয়া হুমায়ূন আহমেদের এবং তার পরিবারের অন্যান্য সকলের বক্তব্য থেকে সরাসরি নেওয়া এবং পুরো গল্পই সেই হুমায়ূন আহমেদের তৈরি ‘শহুরে মধ্যবিত্ত’র ভাষায়!

প্রেডিক্টেবল গল্পে চলচ্চিত্র নির্মাণ করাটা বিশাল সাহসের ব্যাপার। এবং এই “হুমায়ুন-গুলতেকিন-শাওন-শীলা” নামক ‘জানা গল্প’র ক্ষেত্রে সকল গুণগ্রাহীদের আগ্রহ ছিল- আসলে কেমন করে কিংবা সেসময় ওদের কি মনে হয়েছিল সেটা জানার অসীম জিজ্ঞাসা থেকেই। সেই আগ্রহই এই সিনেমা দেখাতে হলে নিয়ে আসবে একটা বিশাল অংকের দর্শককে। তবে পরিচালক গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জাভেদের স্ত্রীকে যে বিশেষণে চিহ্নিত করেছেন সেগুলো হলো আবেগহীন, শীতল এবং অসহযোগী; আবার মা হিসেবে চমৎকার, দায়িত্বশীল এবং ধৈর্য্যশীল। আবার একইভাবে জাভেদের দ্বিতীয় স্ত্রী’র প্রতি যথাযথ মনোযোগ এবং তার সম্মান সবার মাঝে এস্টাবলিশ করার চেষ্টা কিংবা প্রথম স্ত্রী’র কাছে বিশ্বাসের জায়গায় অগাধ বিশ্বাস দাবি করা এবং স্ত্রী’র অসহযোগিতার কারণে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাওয়ার গল্প তার প্রতি একধরণের সহানুভূতি তৈরির সুযোগ তৈরি করে দেয়। যদি এই চলচ্চিত্র থেকে দর্শক জাভেদের মাঝে হুমায়ূনকেই খুঁজে পায় তাহলে এই পক্ষপাতিত্ব সত্যিই দৃষ্টিকটু। কারণ, পরিচালক/চিত্রনাট্যকার দিনশেষে পুরুষতান্ত্রিকতার সেই চেনা রাস্তাতেই চলেছেন।

চলচ্চিত্রটি হুমায়ূন আহমেদের জীবনী অবলম্বনে তৈরি বিষয়ক পরিচলাকের অস্বীকৃতির মাধ্যমে যে হিপোক্রেসি শুরু হয়েছিল তা চলচ্চিত্রের মুক্তির পরও সততার প্রমাণ দিতে ব্যর্থই হয়ে থাকল।