বাংলাদেশের ভুতুড়ে জায়গা

“রাস্তাটির ঠিক মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে একটি কুচকুচে কালো কুকুর। এক দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। গভীর রাত। এত বেশি সুনসান পরিবেশ যে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দটাও নিজের কাছে অপরিচিত লাগছে। হঠাৎ কুকুরটা যেন সতর্ক হয়ে গেলো। গা টানটান করে রাস্তার অপর দিকটায় তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো। দেখে মনে হচ্ছে, কুকুরটা কোন কিছুকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করছে; কোনো কিছুকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ও দিকটায় ঘন কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ গাছের সারির ফাঁক দিয়ে সাদা লম্বা কিছু একটা যেন ভেসে সোজা আমার মুখ বরাবর চলে আসলো। চিৎকার দিয়ে পড়ে গেলাম আমি। পেছনে তখনো কুকুরটার চিৎকার শোনা যাচ্ছে।”

এ রকম পরিবেশ নানা ভৌতিক গল্প বা সিনেমায় অহরহই পাওয়া যায়। কিছু ঘটনা নিছকই বানোয়াট, কিছু কিছু ঘটনাকে আবার সত্য বলে দাবি করেন অনেকেই। আর দুনিয়াজুড়ে ভুতুড়ে জায়গার তো অভাব নেই। দেশ-বিদেশে অনেক ঘোস্ট-হান্টার দল রয়েছে, যারা খুঁজে খুঁজে এমন ভুতুড়ে জায়গা বের করেন। ভৌতিক কিছুর উপস্থিতি আছে কিনা সেটা নিশ্চিত হবার জন্য সেখানে গিয়ে গবেষণাও করেন। বাংলাদেশেও কিন্তু আছে এমন বেশ কিছু ভুতুড়ে জায়গা। গা ছমছম করা অসংখ্য গল্পও রয়েছে সেসব জায়গাগুলোকে ঘিরে।

ঢাকার এয়ারপোর্ট রোড

দিনের এই ব্যস্ত সড়কই নাকি পালটে যায় রাতে

ঢাকার সবচেয়ে পুরানো মহাসড়কগুলোর অন্যতম। এই মহাসড়ক নিয়ে রয়েছে নানান ভুতুড়ে গল্প। গভীর রাতে এখানে নাকি অশরীরীর দেখা পাওয়া যায়- এমন দাবি করেছেন অনেকেই। গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ করেই চালক আবিষ্কার করেন, বিপরীত দিক থেকে সাদা পোশাক পরিহিতা এক নারী অসম্ভব দ্রুতগতিতে গাড়ির দিকে ধেয়ে আসছে। অনেক চালকই এমন অবস্থায় ভয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এমন ঘটনার শিকার কারও কারও মতে, এই অশরীরী কোন মানুষ বা গাড়িকে স্পর্শ করে না; ভয় দেখিয়ে দুর্ঘটনা ঘটানোই নাকি এর মূল উদ্দেশ্য। ভয় পেয়ে নিয়ন্ত্রণ না হারিয়ে সোজা গাড়ি চালিয়ে গেলেই মুক্তি মিলবে এই অশরীরীর হাত থেকে।

এসব মিলিয়ে গল্পের ডালপালা ছড়িয়েছে বেশ! অনেক বছর আগে নাকি ঠিক এই সড়কেই একজন নারী তার পুরো পরিবারসহ শিকার হয়েছিলেন দুর্ঘটনার। সেই প্রতিশোধ নিতেই আজও এই রাস্তাতেই ঘুরে বেড়ায় সে। অন্যদেরও একই কায়দায় দুর্ঘটনার কবলে ফেলার মধ্যেই অশরীরীর আনন্দ। চাইলেও দিনের বেলায় এই অশরীরীর দেখা পাবেন না। ভুতুড়ে রহস্যপ্রেমী হয়ে থাকলে যেতে পারেন নির্জন কোনো এক রাতে সেই অশরীরীর সাক্ষাতে। তবে সেক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি থেকেই যায়; এ কথাটি ক্ষণিকের তরেও ভুলবেন না যেন।

চলন বিল

চলন বিল

এদেশের সবচেয়ে বড় বিল, চলন। নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা- এই তিন জেলা নিয়ে মূলত বিলটির বিস্তৃতি। আমাদের এই ভুতুড়ে কাহিনীর স্থান সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলায়। কথিত আছে, চলন বিলের এই এলাকায় অনেক আগে এক অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী জমিদার বাস করতেন। একদিন রাতে হঠাৎ সেই জমিদার মারা গেলে নাকি রাতারাতি সেখানে তিনটি মন্দির গড়ে ওঠে। যার একটি আবার পরদিনই নিজ থেকেই ভেঙ্গে পড়ে। এই তিনটি মন্দিরকে ঘিরে থাকা বিলের এলাকাটি ভুতুড়ে বলে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত। এছাড়াও চলন বিলের মাঝিদের মতে, এই বিলে জ্বীনের প্রভাবও আছে যথেষ্ট। রাতে বিল পাড়ি দিতে অনেক মাঝিই নাকি জ্বীনের আছরের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। অনেক পথিকও আসা-যাওয়ার পথে অশরীরী কিছুর উপস্থিতি আঁচ করতে পারেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

ফয়স লেক

পাহাড়ে ঘেরা এই লেকের সৌন্দর্য্যের মাঝেই লুকিয়ে আছে ব্যাখ্যাতীত নানা ঘটনা

চট্টগ্রাম বা চাটগাঁ নামটির সঙ্গেই যেন ভুতুড়ে গল্প জড়িত। প্রচলিত আছে যে, ধর্মপ্রচারে আসার পর শহরের চেরাগী পাহাড়ে ভূতের আনাগোনায় ধ্যান করতে পারতেন না আউলিয়ারা। ভূত তাড়াতে তারা চাটি বা কুপি জ্বালিয়ে রাখতেন; এ ঘটনা থেকে জায়গাটির নাম হয়েছে চাটগাঁ বা কালের বিবর্তনে চট্টগ্রাম। নয়নাভিরাম এ অঞ্চলটি ঘিরে রয়েছে এমন নানান ভুতুড়ে গল্প।

শহরের কাছেই ফয় সাহেবের লেক বা ফয়’স লেক। পুরো দেশের মানুষের কাছেই ফয়’স লেক একটি পছন্দসই ঘুরতে যাওয়ার জায়গা। চট্টগ্রামে ট্যুরিস্ট হিসেবে ঘুরতে গিয়েছে, কিন্তু ফয়’স লেক দেখেনি, এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি ভুতুড়ে ঘটনার কারণেও এর পরিচিতি কম ছড়ায়নি। অনেকেরই দাবি, তারা ফয়’স লেকে সাদা ও কালো পোশাকে দু’জন রহস্যময়ী নারীকে দেখেছেন। আলখেল্লা গোছের ঢোলা কালো পোশাকের নারী সন্ধ্যার পর লেক দেখতে আসা মানুষদের হঠাৎ হঠাৎ ভয় দেখায়। তবে সাদা পোশাকের নারী আবার অনেক পথ হারানো দর্শনার্থীকে সাহায্য করেছেন বলেও স্থানীয়রা দাবি করে থাকে। পাহাড় ও প্রকৃতি ঘেরা এই লেকের আসল রহস্য হয়তো কখনোই জানা যাবে না, তবে অশরীরী কোনো কিছুর উপস্থিতি সম্পর্কে সাবধান হয়েই এই এলাকায় পা দেওয়া উচিত।

দেশের আরো নানান জায়গা নিয়ে এরকম আরো অগনিত ভুতুড়ে গল্প প্রচলিত আছে। চট্টগ্রামের পার্কি বিচ, কুয়াকাটা, সুন্দরবনসহ নানান জায়গায় পাওয়া গেছে অশরীরীর আলামত। কেউ কেউ বলেন এগুলো শুধুই গুজব, কেউ কেউ আবার দুলতে থাকেন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচালে। তাই এ ঘটনাগুলো কতটুকু সত্য, আর কতটুকু গল্পে মোড়ানো তার বিচার আমরা নাইবা করলাম। নিছক ভয় পাওয়ার আনন্দের জন্য হলেও ঘটনাগুলা জেনে রাখাতে মন্দ কি!