গেল কয়েক বছরে চোখে পড়ার মতো কিছু পরিবর্তন ঘটেছে বিনোদনের দুনিয়ায়। টিভিসেটের সামনে গ্যাট হয়ে বসে থাকা কিংবা উইকেন্ডে সপরিবার/ সবান্ধব সিনেমা হলের টিকেটের কাতারে দাড়ানোর পাশাপাশি বিনোদন যোগানোর নতুন মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে প্রচুর অনলাইন ভিত্তিক প্ল্যাটফর্মও, যেখানে ২৪ ঘণ্টার সংবাদ কিংবা টকশোর বাধা কচকচির বদলে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছে ভিডিও কনটেন্ট। তাই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে প্রচুর ব্যক্তিগত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইট; আর এদের সবার ইউটিউবে একটি চ্যানেলতো মাস্ট! আসলে ইউটিউবই এক্ষেত্রে অগ্রপথিক ও সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম কিনা! হেন কোনো বিষয় নেই যার ভিডিও কনটেন্ট ইউটিউবে পাওয়া যায় না। তবে, বেশিরভাগ কনটেন্টের উদ্দেশ্য থাকে যেনতেন উপায়ে প্রচুর দর্শক আকৃষ্ট করে নিজেদের পকেট ভারি করা।
এমনি একটি ভারতীয় ইউটিউব চ্যানেল হচ্ছে ‘All India Bakchod’ (AIB)। তন্ময় ভাট ও গুরসিমরান খাম্বার যাত্রা শুরু মূলত একটি কমেডি টিম হিসেবে। পরে তাদের সাথে যোগ দেয় রোহান যোশি ও আশিষ শাক্য। ২০১৩ থেকে তারা ইউটিউবের জন্যে নিয়মিত কমেডি শো বানানো শুরু করে। ব্যাঙ্গাত্নক এই ভিডিও কনটেন্টগুলোর মূল উপজীব্য বিষয় হলো ভারতীয় রাজনীতি, সমাজ ও বলিউড। অল্প দিনের মধ্যেই চ্যানেলটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। আর এখনতো তাদের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ২৬ লাখ!
প্রচুর বিতর্কের জন্ম দেওয়া AIB, ভিডিও কনটেন্টগুলোতে লতা মুঙ্গেশকর ও শচীন টেন্ডুলকারের মতো ভারতীয় কিংবদন্তিদের নিয়ে বিটকেলে ঠাট্টা করায় মামলাও খেয়েছে। নিজেদের ভিডিওতে সিনেমা সংশ্লিষ্টদের ব্যাঙ্গাত্নক উপস্থাপনের বিষয়টিও ভালোভাবে নেয়নি বলিউড। অনুপম খের, আমির খানের মতো তুলনামূলক উদার বলে পরিচিত মানুষেরাও এটাকে দেখেছেন বাড়াবাড়ি হিসেবেই। বাক-স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে যা খুশি তাই বলা যায় কিনা, এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিশাল বিশাল বিতর্কের জন্ম দেওয়া এই দলটিই আবার নেট নিউট্রালিটি, সেইভ দ্য ইন্টারনেটের মতো ক্যাম্পেইনও করেছে। তাদের দাবি, বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাকে পর্দায় বিদ্রুপাত্নকভাবে তুলে ধরে অভিনব পন্থায় গণসংযোগ ও জনসচেতনতা তৈরি করছে তারা।
কিন্তু সবাইকে এভাবে নানান বিষয়ে হাসির পাত্রে পরিণত করা AIB নিজে কতটুকু স্বচ্ছ্ব তাদের কাজে? সবাইকে বিনোদিত করাই কি তাদের একমাত্র লক্ষ্য?
AIB তাদের বিভিন্ন কনটেন্টে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে বিদ্রুপ করেছে। “If apps were people”, “Fevent” -এই ভিডিওগুলোতে সরাসরি ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রামের মতো সাইটগুলোকে ব্যঙ্গ করেই তৈরি। অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সবগুলো সাইটকেই নিজেদের প্রচার ও প্রসারের কাজে ব্যবহার করে চলেছে AIB।
ভিডিওগুলোতে তরুণ প্রজন্ম কি করে অনলাইনের দুনিয়ায় ডুবে আছে, এ নিয়ে নানা উপহাস করা হলেও প্রকৃত পক্ষে এ ধরনের কনটেন্ট তৈরি করা হয়েছে তরুণ প্রজন্মের দর্শকদের বাজার ধরার উদ্দশ্যে। মূলত এ ধরনের ভিডিও তরুণ প্রজন্মকে ডুবিয়ে রাখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ভিডিও কনটেন্ট শেয়ারিং সাইটগুলোতে। আর সাথে নতুন নতুন প্রোডাক্টের সূক্ষ্ম প্লেসমেন্টতো চলছেই!
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে “AIB Knockout” নামের একটি শো-তে “অকথ্য ও অবমাননাকর ভাষা” ব্যবহারের দায়ে তাদের নামে মামলা ঠুকে দেন মুম্বাইয়ের ‘ব্রাহ্মণ একতা সংস্থা’-এর প্রধান অখিলেশ তিওয়ারি। “অকথ্য ও অবমাননাকর ভাষা” ব্যবহার করা হয়েছে- এমন অভিযোগ একদম ফেলে দেওয়ার মতোও না। সিনেমা, নাটকসহ অন্যান্য বিনোদন মাধ্যমে আপত্তিকর ভাষা ও বিষয়বস্তুর ব্যবহার থাকলে তা কাট-ছাঁটের সুযোগ আছে, কিংবা সেটিকে একটি নির্দিষ্ট বয়সের দর্শকদের জন্যই কেবলমাত্র উন্মুক্ত করা যায়। কিন্তু অনলাইন কনটেন্টে এ ধরনের বিধিনিষেধের আওতায় আনার তেমন কোন সুযোগই এখনও নেই; এমনকি এ বিষয়ে আশু কোনো উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
এছাড়াও প্রতিটি ভিডিওতে প্রোডাক্ট প্লেসমেন্টের বাড়াবাড়ি আপনাকে বারবার মনে করিয়ে দেবে কন্টেন্টগুলো শুধুই বিনোদিত হওয়ার জন্যই তৈরি করা হয়নি, এর পেছনে আছে খাঁটি ব্যবসায়িক চিন্তা। আপতদৃষ্টিতে শুধুই হাসি-তামাশা মনে হলেও AIB এবং এ ধরনের অন্যান্য ইউটিউব চ্যানেলগুলোর উদ্দেশ্য কতটা মহৎ তা বোধহয় একটু ভেবে দেখার সময় এসেছে। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে নিজের অজান্তেই কখন আপনি কার ক্রেতায় পরিণত হচ্ছেন তার হিসেব রাখাও বেশ জরুরি। আর আপনি হাসতে ভালোবাসেন, এটিকে পুঁজি করে নানান পণ্য বিক্রির চেষ্টাটা যেন আপনার চোখ এড়িয়ে না যায়, সেদিকেও একটু লক্ষ্য রাখবেন।