কারো কাছে তিনি রূপকথার নায়ক, আবার কারো কাছে শয়তানের দাস। কেউ তাকে ভাবে বন্ধন মুক্তির প্রতীক, আবার কেউ তাকে আখ্যা দেয় সমাজকে বিপথে ঠেলে দেওয়া খলনায়ক হিসেবে। প্লেবয় ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা হিউ হেফনারের জীবন ছিলো এমনই হাজারো তকমায় ভরা। যৌনতাকে সামাজিক ট্যাবু হিসেবে আখ্যা দেয়ার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সব সময়েই সরব। নারী, মদ এবং উদারচিত্ত পার্টির জন্যে তিনি পরিণত হয়েছিলেন এক রহস্যময় পুরুষে। আর তার প্রতিষ্ঠিত প্লেবয় ম্যাগাজিন বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী হতাশায় আক্রান্ত আমেরিকার যুবসমাজে, বিশ্বজুড়ে যা এখনো অন্যতম জনপ্রিয় সাময়িকী। প্লেবয়ের খরগোশ রূপী প্রতীকধারী বাসভবন ‘প্লেবয় ম্যানসনে’ ২৮ ফেব্রুয়ারি নিজের মৃত্যুর আগে তিনি জন্ম দিয়েছেন অসংখ্য রূপকথার।
জন্মেছিলেন শিকাগোতে, একেবারেই রক্ষণশীল একটি পরিবারে। মনোবিজ্ঞানে লেখাপড়া করার পর বিখ্যাত এসকোয়ার ম্যাগাজিনে কর্মজীবন শুরু করলেও নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে চাকরি ছেড়ে দেন দ্রুতই। ১৯৫৩ সালে ৮০০০ ডলার ধার নিয়ে প্রকাশ করেন প্লেবয় ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যা। প্রথম সংখ্যাতেই ছিল চমক। কিংবদন্তী নায়িকা মেরিলিন মনরোর নগ্ন ছবি সম্বলিত সেই ম্যাগাজিন বাজিমাত করে মার্কিন মুল্লুকে। আমেরিকাতেই বিক্রি হয় ৫০০০০ এরও বেশি কপি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মেরিলিন মনরোর ছবি প্রকাশ করতে তিনি কিন্তু নায়িকার মৌখিক সম্মতিরও ধার ধারেননি। পুরানো একটি ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে নেয়া সেই ছবিটিই মেরিলিন মনরোকে এনে দেয় তারকাখ্যাতি। মেরিলিনও কখনই এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। মেরিলিন মনরোর প্রতি প্রবল আকর্ষণ সবসময়েই ছিলো হেফনারের। এজন্যেই মৃত্যুর পরে মেরিলিন মনরোর পাশেই শায়িত হবার বাসনায় ৭৫০০০ হাজার ডলার খরচ করে পাশের জমিটুকু কিনে রাখতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেননি।
জীবন ছিলো তার কাছে একটা খেলাঘর। ১৯৪৯ সালে মিলড্রেড উইলিয়ামসের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেও নারীর প্রতি আকর্ষণ কখনই কমেনি হেফনারের। গুজব আছে, প্লেবয় ম্যাগাজিনে স্থান পাওয়া প্রতিটি মডেলই শয্যাসঙ্গী হয়েছেন হেফনারের। এর সত্য মিথ্যে নির্নয় করা না গেলেও, একই সাথে আট-আট জন সুপারমডেল গার্লফ্রেন্ডের গল্পটি কিন্তু একেবারেই সত্য। শুরুতে প্লেবয়ের ঠিকানা ছিল শিকাগো, পরে ক্যালিফোর্নিয়ায় তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে আসার পর প্রথম স্ত্রী মিলড্রেডের সাথে বিচ্ছেদ ঘটে তার। এদিকে ‘প্লেবয় ম্যানসন’ পরিণত হয় পৌরাণিক এক রাজপ্রাসাদে। প্রতি রাতেই এ বাসায় বসতো জমকালো সব পার্টি। হলিউডের তারকারা কিংবা সুপারমডেল, মাঠ কাঁপানো খেলোয়াড় থেকে শুরু করে তেল বেচে হঠাৎ বড়লোক আরব শেখ- কে থাকতেন না সেই পার্টিতে! প্রায় ২২ হাজার স্কয়ার ফিটের সেই বাড়িকে অনেকেই আখ্যা দিতো “মর্ত্যের বুকে এক টুকরো স্বর্গ” হিসেবে। যদিও দ্বিতীয় স্ত্রী কিম্বারলি কনরাডের ঘরে সন্তান জন্মের পর বাড়ির পরিবেশ আমূল বদলে ফেলেন হেফনার।
হাজারো বিতর্কের তীর প্রতিনিয়ত তাকে ঘিরে ফেললেও কখনই নিজ মতবাদ থেকে মচকাননি হিউ। নারীবাদীদের প্রবল সমালোচনাকে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন। সমালোচকদের পাল্টা দুষেছেন “তাদের জন্যে আমার করুণা হয়। জীবনটাকে যে দেখতেই চাইলো না তারা”- এই বলে। নানা সামাজিক আন্দোলনের সাথে ও যুক্ত ছিলেন। প্লেবয় ম্যাগাজিনের শুরুতেই থাকতো ম্যালকম এক্স কিংবা মার্টিন লুথার কিংদের সাক্ষাৎকার। জিমি কার্টারের মতো সিরিয়াস প্রেসিডেন্টও বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্লেবয়ে। বর্ণবৈষম্য কিংবা সমকামীতার পক্ষের আন্দোলনগুলোতে একটি পরিচিত নাম হেফনার বিশ্বাস করতেন ব্যক্তি স্বাধীনতায়। আধুনিক ভোগবাদকে ব্যবহার করে এবং নারীকে পণ্য বানিয়ে নষ্ট পুঁজিবাদের সম্পূর্ণ ফায়দা তোলা হিউ হেফনার নিজের বিলাসী জীবনযাপনের জন্যেও আরো অনেকদিন মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন।