ঢাকা থেকে বার্সেলোনা, দূরত্ব আট হাজার একশ’ মাইল মাত্র! যদিও বোকাবাক্স আর অন্তর্জালের চক্করে পড়ে শহরটি বিশেষ করে শহরের একটি ফুটবল ক্লাব নিয়ে উত্তেজনায় বিন্দুমাত্র কমতি নেই বাংলাদেশের মানুষের। চায়ের দোকানে কিংবা ফেসবুকের কমেন্ট সেকশনে স্পেনের দুটি ফুটবল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনা এফসি নিয়ে চলে প্রতিনিয়ত উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়। এবং সে বাক্যি শুধু ফুটবলেই থেমে থাকে না, ফাঁকে ফাঁকে উঠে আসে কাতালোনিয়ার পরাধীনতার গল্প, একটি জাতির সংগ্রামের ইতিহাসও। এই উত্তেজনার পালে হাওয়া লেগেছে নতুন করে, যে হাওয়ার জোরে কাতালোনিয়ার মানুষ স্বপ্ন দেখছে নিজেদের জন্য একটি দেশের, নিজের একটি পরিচয়ের।
বর্তমানে স্পেনের অন্তর্গত হলেও কাতালোনিয়ার অধিবাসীদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি আর হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস। ইতিহাসের পালাবদলে কখনো সামান্য সময়ের জন্য স্বাধীনতা পেলেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই তারা ছিলো পরাধীন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে কাতালানরা স্বায়ত্তশাসন লাভ করলেও স্পেনের গৃহযুদ্ধের পর তারা আবারও সম্পূর্ণ পরাধীন হয়ে পড়ে।
কারণ, রক্তক্ষয়ী সে গৃহযুদ্ধ শেষে স্পেনের ক্ষমতা দখল করেন স্বৈরাচারী জেনারেল, ফ্র্যান্সিসকো ফ্র্যাংকো। একনায়ক ফ্র্যাংকোর শাসনকালে মুক্তিকামী কাতালানদের উপর নেমে আসে অত্যাচারের খড়গ, কেড়ে নেওয়া হয় তাদের মৌলিক মানবিক ও রাজনৈতিক অধিকার। নির্মম অত্যাচার করে হত্যা করা হয় গৃহযুদ্ধ পূর্ববর্তী স্বতন্ত্র কাতালোনিয়ার প্রেসিডেন্ট ল্যুই কম্প্যানিকে। কেড়ে নেয়া হয় তাদের মাতৃভাষা, বন্ধ করে দেওয়া হয় কাতালোনিয়াকে চিত্রিত করে এমন সব প্রতিষ্ঠান। এই অন্ধকার সময়ে কাতালান জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রতীক ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা এফসিকেও পড়তে হয় ফ্র্যাংকোর তোপের মুখে। একবার তো তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে খেলা চলাকালীন সময়ে বার্সেলোনা এফসির খেলোয়াড়দের জীবননাশের হুমকিও দেয়া হয়। ১৩ জুন, ১৯৪৩ সালের ফুটবলের গায়ে কালিমা লেপে দেওয়া এক ম্যাচে বার্সেলোনা এফসি প্রথমার্ধে ১-০ গোলে এগিয়ে গেলেও পরবর্তীতে হারে ১-১১ গোলে।
১৯৭৫ সালে স্পেনে গণতন্ত্র ফিরে আসলে কাতালোনিয়াও ফিরে পায় তাদের স্বায়ত্তশাসন। শিল্পায়ন ও পর্যটনকে পুঁজি করে এ অঞ্চল শুধু স্পেন নয়, সমগ্র ইউরোপের অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত হয়। সমগ্র স্পেনের মধ্যে স্বমহিমায় উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতে থাকে কাতালোনিয়া। অনেকদিন চাপা থাকলেও ২০০৯ সাল থেকে আবারো কাতালোনিয়ায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে স্বাধীনতার স্বপ্ন। নিজের দেশ, নিজের অর্থনীতি এই স্বপ্নকে ধারণ করে কাতালোনিয়ায় সর্বত্র শুধু একটাই রব শোনা যেতে থাকে “স্বাধীনতা, স্বাধীনতা”।
এই স্বাধীনতা সংগ্রামে কাতালোনিয়াকে নেতৃত্ব দেয়া দলটির নাম “ডেমোক্রেটিক কনভারজেন্স অফ কাতালোনিয়া”। দলটি প্রদেশের মানুষের মধ্যে জনমত গড়ে তুলেছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য। জনগণও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই অংশ নিতে থাকে এই আন্দোলনে। নিবেই না বা কেন, সমগ্র স্পেনের ১৯% জিডিপি আসে কাতালোনিয়া থেকে। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিলে এ প্রদেশই জমা করে সবচেয়ে বেশি কর। এ করের পরিমাণ প্রতি বছর কাতালোনিয়ার হওয়া সরকারি খরচের চেয়ে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বেশি। এছাড়াও ভাষা, সংস্কৃতিতেও ভিন্ন কাতালানরা নিজেদের সীমানার দাবীতে হয়ে ওঠে অবিচল।
স্বাধীনতার প্রশ্নে কাতালোনিয়ার সরকার এ বছরের অক্টোবরের এক তারিখে ঘোষণা দেয় গণভোটের। স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার ভীত হয়ে এই গণভোটকে অবৈধ দাবি করে, গণভোটের দিন বার্সেলোনার রাস্তায় রাস্তায় মোতায়েন করা হয় হাজারো পুলিশ। কিন্তু স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর একটি জাতিকে নিজের মত প্রকাশে তো আর লাঠির ব্যবহারে থামানো যায় না। ব্যালটে ৯০% এরও বেশি ভোট পরে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে। স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার এবং উচ্চ আদালত এ ভোটকে অবৈধ ঘোষনা করার পর থেকেই আবারও উত্তাল হয়ে উঠেছে কাতালোনিয়া। রাস্তায় নেমে এসেছে হাজারো নারী পুরুষ, বৃদ্ধ কিশোর নির্বিশেষে হাজারো মানুষ- শুধু একটি দাবি নিয়ে, স্বাধীনতার। বার্সেলোনার রাস্তায় রাস্তায় মুক্তিকামী মানুষের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পরেছে পুলিশ আর কাতালোনিয়ার সর্বত্র পতপত করে উড়ছে তারকা খচিত লাল হলুদে কাতালোনিয়ার পতাকা, সাড়ে সাত মিলিয়ন মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন।
স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ পেতে এখনো কাতালোনিয়াকে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ। তাদের সমর্থন আদায় করতে হবে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের থেকে। সমঝোতায় আসতে হবে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে। তবে গণভোটে বিপুল বিজয়ের পর কাতালোনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন দ্বিগুণ উৎসাহে আকাশে উড়বে, ঘুড়ি হয়ে উড়ে বেড়াবে বার্সেলোনার অলিতে গলিতে।