আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রভাব বৃদ্ধিসহ পশ্চিমা শক্তির হর্তাকর্তাদের বিপক্ষে লড়াইয়ে টিকে থাকতে আদ্যপন্ত চেষ্টা করে চলেছে ইসলামী আইন শাসিত দেশ ইরান। ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পগুলো পারমাণিবক অস্ত্র তৈরির অভিলাষ যা অঞ্চলিক তথা বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি- এমন অভিযোগে দেশটির ওপর আরোপ অর্থনৈতিক অবরোধ করেছিল পশ্চিমা মোড়লরা। সারা বিশ্বে ইরানের যত লেনদেন আছে সব স্থগিত করে দেওয়া হয় তখন, আটকা পড়েছিল ইরানের শত শত কোটি ডলার এবং বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সব ধরনের আমদানি-রপ্তানি। বলতে গেলে বিশ্ব বাণিজ্যে এক প্রকার এক ঘরে হয়ে পড়েছিল ইরান। মূলত ইসলামী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সংঘটিত পট পরিবর্তনের পটভূমিতে পুরো তেল শিল্প জাতীয়করণ করা হলে পশ্চিমা তেল কোম্পানিগুলো ইরান থেকে হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়, ঠিক তখন থেকে উভয় পক্ষের মধ্য শুরু হয় কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক টানা পোড়েন।
ছয় জাতি (নিরপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য ও জার্মানি) এবং ইরানের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালের গোড়ার দিকে ইরানের ওপর থেকে দীর্ঘ ৩০ বছরব্যাপী বলবৎ থাকা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। অবরোধ উঠে গেলেও বিশ্ব বাজারে তেলের বড় দরপতন বিশ্বের অন্যতম জীবাশ্ম জ্বালানি সমৃদ্ধ দেশ ইরানের জন্য বড় কোনো অর্থনৈতিক সুবিধা বয়ে আনেনি। কিন্তু দীর্ঘ অর্থনৈতিক অবরোধের নিগড় এবং মার্কিন-ইসরায়লি জোটের তীব্র হুমকির মুখেও ইরান বলতে গেলে মধ্য প্রাচ্যের অপরাপর জ্বালানি রপ্তানি নির্ভর দেশগুলোর তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই নির্ভার, অন্ততপক্ষে সৌদি আরবের তুলনায় তো বটেই! যদিও ইরানের অর্থনীতির পুরোটাই ছিল জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি নির্ভর। বিশ্বে আবিষ্কৃত তেলের মজুদের ১০ শতাংশের মালিক ইরান, পরিমাণ কমবেশি ১৫০ বিলিয়ন ব্যারেল। প্রচুর পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাসের মুজদও রয়েছে দেশটিতে, প্রায় এক হাজার ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। প্রশ্ন জাগতে পারে, ইরানের এ নির্ভার থাকার পেছনের কারণটা কি?
সন্দেহের চোখে ভ্রু কুঁচকে গেলেও এটা সত্য যে ইরানের অর্থনৈতিকভাবে নির্ভার থাকার অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে অর্থনৈতিক অবরোধ! যদিও শুরুতে অর্থনৈতিক অবরোধ দেশটির উচ্চ প্রযুক্তির খাতগুলোকে বড় ধরনের বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। অবরোধের ফলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমদানি রফতানি বন্ধ হওয়ায় হু হু করে বাড়তে থাকে আমদানি নির্ভর পণ্য ও সেবার দাম। আমদানি নির্ভর প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার ঘাটতিতে একদিকে বাড়ছিল উৎপাদন ব্যয়, অপরদিকে ছোট হয়ে পড়ছিল রপ্তানি বাজার, বন্ধ হয়ে যেতে থাকে বিভিন্ন শিল্প এবং এর সংযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো। এহেন সংকটে বিদেশি কোম্পানিগুলোও ইরান ত্যাগে বাধ্য হয়-একে একে বাতিল হতে থাকে রপ্তানির কার্যাদেশ, চাকুরি চ্যুত হতে থাকে উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীরা। ঠিক এ সময়ে বাজারে অতি চাহিদার বিপরীতে স্বল্প বা শূন্য যোগান পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে শুরু করে দেশিয় কোম্পানিগুলো, তুলনামূলক কম দামে ও স্বল্প সময়ে পণ্য সরবরাহ ও সেবা দিতে শুরু করে তারা। চাকুরি বাজারের সংকটকে কাজে লাগিয়ে কম বেতনে নিয়োগ দেয় উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীদের। বিদেশি কোম্পানিবিহীন একচেটিয়া দেশিয় বাজার ও উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীর সমন্বয়ে ক্রমে দেশিয় শিল্পগুলো ক্রমে বিকশিত হতে থাকে।
এককভাবে, শুধু অবরোধের ফলে সৃষ্ট চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে ইরানের তেল বহির্ভুত অর্থনৈতিক খাত বিকশিত হয়েছে, বিষয়টিকে অমন সরলভাবে ভাবার অবকাশ নেই। মধ্য প্রাচ্যের রাজনৈতিক টানা পোড়েন ও সামরিক শক্তির দামামার পাশাপাশি মার্কিন ও ইসরায়লি অক্ষের হুমকির নিত্য খড়গ ইরানকে এক নতুন উপলব্ধিতে তাড়িত হতে বাধ্য করে; অবরোধে যন্ত্রণায় জর্জরিত ইরান হাড়ে হাড়ে টের পায় যে বিশ্ব মোড়লদের সঙ্গে টক্করে দিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে বাঁচতে হলে তাদেরকে গবেষণা ও উদ্ভাবন নির্ভর শিল্পগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। তৈরি করতে হবে নিজস্ব প্রযুক্তি, জ্ঞান ও বিজ্ঞান। এ অভিলক্ষ্যে ‘বিশ বছর মেয়াদি জাতীয় পরিকল্পনা’র অংশ হিসেবে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে কয়েক বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠন করে কাজে নেমে পড়ে দেশটি। ফলাফলটা এক দশক পরে ক্রমেই দৃশমান হতে থাকে- ২০১১ সালে লন্ডনে অবস্থিত রয়েল সোসাইটির তৈরি করা ‘বিজ্ঞান গবেষণায় দ্রুত বর্ধনশীল রাষ্ট্রে’র তালিকায় সবার ওপরে স্থান করে নেয় ইরান।
গবেষণা ও উদ্ভাবনের সব অর্জন ইরানের অর্থনৈতিক, সামরিক এবং মেধা ভিত্তিক উন্নয়নে অভূতপূর্ণ সাফল্য বয়ে আনে। আন্তর্জাতিক মুদ্র তহবিলের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১২ থেকে ২০১৪ সময়কালে তেল বহির্ভুত খাত থেকে ইরানের আয়ের পরিমাণ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার অপরাপর তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি; ইরানের মোট জাতীয় আয়ে তেল বহির্ভুত খাতের অবদান শতকরা ৫৬ ভাগ। এহেন উন্নতিতেও আত্নতুষ্টিতে ভুগছে ইরান, তারা জাতীয় অর্থনীতিতে (বার্ষিক দেশজ উৎপাদন, জিডিপি) গবেষণা ও উদ্ভাবনের অবদানকে দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে আড়াই শতাংশে উন্ন্নীত করতে কাজ করে যাচ্ছে। ইরান খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছ যে, দৃশ্যমান ফলাফলের খুব বেশী চোখে পড়ার মতো না হলেও দীর্ঘ মেয়াদে সবক্ষেত্রে উন্নতি করতে হলে নিজস্ব প্রযুক্তি, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই। নিজস্ব প্রযুক্তি বিকাশের ধারাবাহিকতায় ইরানের ৩৬টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পার্কের ৩৬৫০টির বেশি কোম্পানিতে ২৪ হাজারেরও বেশি মানুষের সরাসরি কাজ সুযোগ তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্য জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্প পুরোটাই দেশিয় প্রযুক্তিতে ঢেলে সাজানো হয়েছে; এবং দেশটি অপরোশোধিত তেল নয়, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য বিশ্ব বাজারে বিক্রি করে থাকে। এতে অপরোশোধিত তেল বিক্রির তুলনায় লাভ হয় শতগুণ বেশি।
দীর্ঘ অবরোধকালীন সময়ে অভ্যন্তরীন একচেটিয়া বাজারকে কাজে লাগিয়ে ইতিমধ্যে ইরানের কোম্পানিগুলো নিজেদের মেরুদণ্ড বেশ শক্ত করে নিয়েছে। অবরোধ উঠে যাওয়ায় তারা খুব সহজে বহির্বিশ্বে নিজেদের বাজার সম্প্রসারিত করতে পারবে, বিশেষ করে পাশ্ববর্তী যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ ইরাক ও আফগানিস্তান হতে পারে সবচেয়ে উপযুক্ত বাজার। স্মরণাতীতকাল থেকে বিদ্যমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতেও তারা বাজার সম্প্রসারণের কাজ করছে। অবরোধকালীন সময়ের সহযোগী ভারত, চীন ও রাশিয়ার মতো বড় বাজারগুলোতে সুবিধাজনক অবস্থান রয়েছে ইরান। পূর্ব ইউরোপের ছোট ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর বাজারে প্রবেশে কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। আসিয়ান ও দূর প্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক বেশ উষ্ঞ। বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর ফ্যাক্টবুক অনুসারে, ক্রম সক্ষমতার ভিত্তিতে বিশ্ব অর্থনৈতিতে ইরানের অবস্থান ১৮তম। অর্থনীতিবিদদের অভিমত, ২০৫০ সাল নাগাদ ইরান ১৭তম অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হবে, দেশটির মোট অর্থনীতির আকার দাঁড়াবে প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলারে এবং পেছনে ফেলবে কানাডা, নেদারল্যান্ডস, ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো শক্তিশালীর অর্থনীতির দেশগুলোকে।
অর্থনৈতিক অবরোধের ফলাফল থেকে অর্জিত তিক্ত অভিজ্ঞতার উপলব্ধিকে কাজে লাগিয়ে খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ইরান। হয়তো অবরোধের নিগড়ে নিষ্পেষিত না হলে নিজ পায়ে দাঁড়ানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারত না ইরান?