একবিংশ শতকের ঢাকাবাসীর হয়তো বিশ্বাস হবে না কিন্তু নবাবী আমলেও,শুধু মুসলমান নয়, বরং সকল ধর্ম-বর্ণের ঢাকাবাসীর অন্যতম প্রধান উৎসব ছিলো আশুরা বা মহররম। আর মহররমের প্রধানতম অনুষঙ্গ এ অঞ্চলে তাজিয়া মিছিল। বলাই বাহুল্য, ঢাকা কোনোকালেই শিয়া অধ্যুষিত শহর ছিলো না, আর মোঘলরাও ছিলেন সুন্নি। তবে ঢাকার নায়েব নাজিমরা ছিলেন শিয়া। মূলত তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার নানা স্থানে তৈরি হয় ইমামবাড়া ও জাঁকজমকের সাথে পালিত হতে থাকে আশুরা। ঢাকায় মুঘল আমলে সতের শতকে প্রচলিত হয়েছিলো মহররম পালন, গ্রামাঞ্চলে তা ছড়িয়ে পড়েছিলো আরো বেশ পরে, উনিশ শতকে।
আজিমুশশানের মতে, ঢাকার প্রথম ইমামবাড়া ফরাশগঞ্জে, বিবি কা রওজা, যেটি নাকি আমির খান নামেরএক ব্যক্তি ১৬০০ সালে নির্মাণ করিয়েছিলেন। দোসানজী নামের এক পার্সি ১৮৬১ সালে সেটি সংস্কার করেন। তবে এ নিয়ে আজিমুশশানের লেখায় কোন নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র পাওয়া যায়নি, তাই বিবি কা রওজার প্রথম হওয়া নিয়ে সন্দেহ রয়েই যায়, যেখানে নগরী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকার শুরুই হয় ১৬০৮ বা ১৬১০ সালে (ইসলাম খানের হাতে)। এছাড়া ১৮৬৯ সালের মানচিত্রে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাছে আরেকটি পুরনো ইমামবাড়া দেখা যায়। এর বাইরে ফুলবাড়িয়ার কাছে ছিলো মীর ইয়াকুবের হুসেনী দালান, ছোট কাটরা ও মুকিম কাটরাতে ছিলো আরো দুটি ইমামবাড়া।
বর্তমান হুসেনী দালান বা ইমামবাড়া নিয়ে জনশ্রুতি আছে যে, মোঘল নৌবাহিনী (নওয়ারা)-এর তত্ত্বাবধায়ক মীর মুরাদ, সুলতান সুজার আমলে ১৬৪২ সালে এটি নির্মাণ করেন। এ তথ্যটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়, কারণ সেখানে রক্ষিত শিলালিপিটি জাল। হাকিম হাবিবুর রহমান ধারণা করেন, এটি নুসরাত জং, আওরঙ্গজেবের আমলের পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামলে (১৮০০ সনের পরে) তৈরি করেছিলেন। এটিও সত্য নয়, দানীর মতে ও জেমস টেলরের বর্ণনায়, মীর মুরাদই এখানে আরো অনেক আগে শিয়াদের জন্যে একটি উপাসনালয় তৈরি করেছিলেন, সেটি ইমামবাড়া না হলেও, সম্ভবত একটি ‘তাজিয়া-খানা’ ছিলো। টেলর তার নির্মাণকাল নির্ধারণ করেছেন মোহাম্মদ আজমের আমলে, ১৬৭৮-১৬৭৯ সালে। পরে আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নবাব জেসারত খান তা পুনর্নির্মাণ করেন। ঢাকার শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন এই নায়েব নাজিমরা, তাই জেসারত খানসহ তাদের শেষ চারজনের কবরও এমনকি হুসেনী দালানে। নায়েব নাজিমদের পরিবার লুপ্ত হয়ে যাওয়ার পরে উনবিংশ শতাব্দীতে ঢাকার খাজা পরিবারের উপরে হুসেনী দালানের মোতওয়াল্লীর দায়িত্ব বর্তায়। সেজন্য ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে তা ক্ষতিগ্রস্ত হলে নবাব আহসানউল্লাহ এর সংস্কারের দায়িত্ব নেন।
কালের বিবর্তনে মহররমের সকল কার্যক্রমের মূলকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় হুসেনী দালান। সে সময় উৎসবের শুরু হতো মহররমের চাঁদ দেখার রাত থেকেই, চলতো টানা ১০ দিন ধরে। এই টানা দশদিন চলতো রোজা রাখাও। হুসেনী দালানের ভেতর সুসজ্জিত করা হতো কৃত্তিম ফুল, ঝালর, উটপাখির ডিম ইত্যাদি দিয়ে, যে দেয়ালের উপরে থাকতো হাসান-হুসাইনের প্রতিকৃতি, তা কালো কাপড়ে মোড়া থাকতো আর ঘরের মাঝে থাকতো একটি ফোয়ারা। এ সবই রাতে অসংখ্য বাতি ও রঙিন মোমের আলোয় ঝলমল করতো। সাথে চলতো ভাটিয়ালি মর্সিয়া, এবং রাতে‘সব-বয়দারি’বা রাত্রি-প্রহরা। চতুর্থ দিন থেকে ভীড় জমে উঠতো হুসেনী দালানের বারান্দায়, পঞ্চম দিনে মিছিল বের করতো ঢাকার ভিস্তিরা (চামড়ার মশকে করে যারা পানি বহন করতো)। তাদের পরনে থাকতো বিশেষ পোশাকঃ সবুজ লুঙ্গি ও শার্ট, মাথায় পাগড়ি, গলায় কাফনের কাপড়, কবজি ও গলায় সোনার তাগা। ষষ্ঠ ও সপ্তম দিনে এলাকা এলাকায় ফুটতো আতশবাজি। এছাড়া বিলানো হতো প্রচুর উপহার, খাদ্য ও অর্থ। বেগমবাজার থেকে হুসেনী দালান পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে ভীড় হয়ে যেতো মানুষের। নবাবী পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও ধনাঢ্য শিয়া পরিবারগুলোও এতে অর্থ যোগাতেন। এমনকি আঠারো শতকেও নায়েব নাজিমরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকে আশুরা উদযাপনের জন্য বছরে পেতেন সেই আমলে আড়াই হাজার টাকা।
অষ্টম দিনে বের হয়ে দুপুরে চলতো মহিলাদের জারিগান‘দুপহরিয়া মাতম’। এ সময় হুসেনী দালান ত্যাগ করতেন সকল পুরুষ। বিকেলে বের হতো বিরাট মিছিল। তাতে অংশ নিতো নিশানসহ হাতি, ঘোড়া, লাঠিয়াল, গানের দল, ডংকা ও অতি অবশ্যই‘দুলদুল’এবং জোড়া‘বিবি কা দোলা’ (যা ঢাকা থাকতো কালো কাপড়ে)। এ মিছিলকে বলা হতো‘তুগ-গাস্ত’, তুর্কিতে যার মানে পতাকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো। মিছিলটি বকশীবাজার, উর্দু রোড, বেগম বাজার হয়ে চকে পৌছাতো। নবম দিনে অনুষ্ঠান শুরুই হতো বিকেলে, বিভিন্ন আখড়া থেকে মানুষ এসে হাজির হতো। তারপরে বেলা তিনটায় আবারো হতো‘তুগ-গাস্ত’। আশুরার দিনে আজিমপুরে বসতো বিরাট মেলা, যা কলেবরে ছোট হয়ে আসলেও এখনো বসে। সে সময় বিভিন্ন ইমামবাড়া থেকে তাজিয়া মিছিল আজিমপুরের কাছে হাসনাবাদে আসতো এবং সেখানে তাজিয়াগুলো বিসর্জন দেয়া হতো, তবে প্রতীকী কবরগুলো নিঃশব্দে হোসেনী দালানে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হতো। সে মিছিল থেকে বিলানো হতো শরবত, আর মিছিল দেখতে রাস্তায় উপচে পড়তো মানুষ। বাড়ির দেয়াল, ছাদ বা বারান্দায় তিল ধারণের জায়গা থাকতো না, সেখান থেকে অনেকে মিছিলের দিকে ছুড়ে দিতেন কবুতর বা মানত করা মুরগী (এ প্রথা এখনো দেখা যায়)। তাজিয়া বিসর্জন এক সময় পুরানা পল্টনের কাছে কারবালার ঝিলেও বিসর্জন দেয়া হতো, যে ঝিলটাই এখন আর নেই।
বাঙালি, মহররমকে তার লোকায়ত সংস্কৃতির অংশই করে নিয়েছিলো, যার প্রমাণ মেলে প্রতিটি মহররমের মেলায়, যা এদেশীয় অনুষঙ্গ। এছাড়াও বাকি সকল দেশে প্রতীকী শব বহন করা হয় একটি, কারণ কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছিলেন শুধুমাত্র হুসাইন, কিন্তু বাঙালি দুটি শব বহন করে তাজিয়া মিছিলে, শোক ও মাতমও করে দুই জনের জন্যেই (হায় হাসান! হায় হুসাইন! বলে)। নানা সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে বর্তমানে মহররম বা আশুরা পালনে সে জাঁকজমক আর নেই। মূলত বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে তাজিয়া মিছিল ও আশুরার সকল অনুষ্ঠান জৌলুস হারাতে শুরু করে। এখন মিছিলের আকার আগের তুলনায় অনেক ছোট, এবং শুধুমাত্র মহররমের দিনটিতেই বড় একটি মিছিল হুসেনী দালান থেকে শুরু হয়ে আজিমপুর হয়ে ধানমণ্ডি গিয়ে শেষ হয়। বাকি কিছু অনুষ্ঠান স্বল্প পরিসরে পুরনো ঢাকার ইমামবাড়াগুলোতে হয়, তবে অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। আর মেলাগুলোর মধ্যে এখন আজিমপুরেরটিই সবচেয়ে বড়।
তথ্যসূত্রঃ
১। মুনতাসীর মামুন, ‘পুরানো ঢাকার উৎসব ও ঘরবাড়ি’, ‘ঢাকা সমগ্র ১’, অনন্যা, ২০০৩।
২। হাকিম হাবিবুর রহমান, ‘আসদুগানে ঢাকা’
৩। James Taylor, ‘A Sketch of the Topography and Statistics of Dacca’, The Asiatic Society of Bangladesh, March 2010 (1st Edition 1840)
৪। Muntassir Mamoon, ‘Religious Festivals of Dhaka’, ‘400 Years of Capital Dhaka and Beyond’, Volume II: Economy and Culture, Asiatic Society of Bangladesh, 2011.
৫। Azimusshan Haider, “Dacca: History and Romance in Place Names: An Analytical Account of the Nomenclature of Roads and Localities in Dacca, with a Discussion of the Rationale for Their Retention Or Otherwise”, Dacca Municipality, 1967
৬। নাজির হোসেন, ‘কিংবদন্তির ঢাকা’, থ্রী স্টার কো-অপারেটিভ মালটিপারপাস সোসাইটি লিঃ, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৯৫
৭। Ahmad Hasan Dani, “Dhaka: A Record of Its Changing Fortunes”, Asiatic Society of Bangladesh, 2009
ছবি সৌজন্য: বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর থেকে প্রকাশিত ‘ফটোগ্রাফিক অ্যালবাম অব ওল্ড ঢাকা’