“ঢাকা একটি বৈষ্ণব শহর”, গেল শতকের ঢাকাকে সংজ্ঞায়িত করতে গেলে এমনই বলতে হয়! ঢাকার অধিবাসীদের একটি বড় অংশ ছিলো সনাতন ধর্মীয় বৈষ্ণব ও তাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ছিল জন্মাষ্টমী। বাংলা বা পূর্ববঙ্গের জন্মাষ্টমী উৎসবের প্রধানতম অনুষঙ্গ ছিল জন্মাষ্টমীর মিছিল, আর সে মিছিলের কথা যখন বলা হয়, তখন ঢাকা ছাড়া আর কোন শহরের মিছিলের বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
ঢাকার জন্মাষ্টমীর মিছিল এতটাই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল যে, তার নামডাক ছড়িয়ে পড়েছিলো পুরো বাংলায়। সে মিছিল দেখতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসতো (এমনকি উন্নাসিক কলকাতা থেকেও), সারা বছর অপেক্ষা চলতো তার। ১৮৬১ সালের সংবাদপত্র অনুযায়ী, প্রায় নাকি দুই লাখ লোকের সমাগম ঘটতো (সে সময় ঢাকার জনসংখ্যাই দু’লাখ নয়)। যাতায়াতের সুবিধার্থে ঢাকায় ট্রেন চালু হবার হবার পরে জন্মাষ্টমীতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ স্পেশাল ট্রেনও চালু হয়। এছাড়াও বাকল্যান্ড বাঁধ ধরে সারি সারি নৌকা বাধা থাকতো, দৈনিক ভাড়ার চুক্তিতে, যার খরচ সেসময়ের বিচারে খুব কম ছিল না। আবার লোহারপুল থেকে নবাবপুরের পুল ও তাঁতিবাজারের মোড় পর্যন্ত; ধোলাই খাল ও নারিন্দার খালে থাকতো যাত্রীর অপেক্ষায় থাকতো হাজার হাজার নৌকা। রাস্তা দু’ধারে ও বাড়িঘরের ছাদে বা দেয়ালে তো লোকের অভাবই ছিলো না। স্কুল-কলেজ, অফিস এমনকি পোস্ট অফিসও বন্ধ থাকতো দু’দিন (বাদানুবাদের ফলে নবাবপুর ও ইসলামপুরের দুটি মিছিল আলাদা করে দুই দিন বের হতো কিনা!)।
ঢাকার এ মিছিলের সুনির্দিষ্ট ইতিহাস পাওয়া যায় না, তবে অসংখ্য বিবরণ পাওয়া যায় উনবিংশ শতকে। যে ইতিহাস লেখার চেষ্টা করেছেন দু’জন ব্যক্তিঃ ভুবনমোহন বসাক (১৯১৭) ও যদুনাথ বসাক (১৯২১)। দু’জনেই বসাক পরিবারের সদস্য, যাদের উপরে এ মিছিলের কর্তৃত্ব বর্তেছিলো। ভুবনমোহনের তথ্যানুযায়ী, বংশালের কাছে পিরু মুনশির পুকুরের পাশে এক সাধু থাকতেন, ১৫৫৫ সালে তিনি রাধাষ্টমী উপলক্ষ্যে বালক ও ভক্তদের হলুদ পোশাক পরিয়ে একটি মিছিলের আয়োজন করেছিলেন। এরপরে প্রায় ১০-১২ বছর লেগে যায়, সে মিছিলকে জাঁকজমকপূর্ণ করতে, প্রথম জন্মাষ্টমীর মিছিল বের হয়েছিলো ১৫৬৫ সালে। কালে কালে মিছিল প্রতি বছরই হতে থাকে ও একটি সাংগঠনিক রূপ পায়, এর কর্তৃত্বভার অর্পিত হয় নবাবপুরের ধনাঢ্য কৃষ্ণদাস বসাকের পরিবারের ওপর। সুতরাং দেখা যায় যে, ঢাকায় ইসলাম খাঁর আগমনের পূর্বেই প্রচলন হয়েছিল এ মিছিলের। অবশ্য শহরের মুসলমানদের অংশগ্রহণও ছিল স্বতঃফূর্ত এবং তারা এ মিছিলকে বলতো ‘বাল গোপালের মিছিল’।
এরপরে প্রায় ১০০ বছর ধরে নবাবপুরে নানা ধনী ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজেদের মিছিল বের করতে শুরু করেন। উর্দুবাজারের গঙ্গারাম ঠাকুর বলেও একজন বসাকদের অনুকরণে মিছিল আয়োজন করেছিলেন। তবে সেটি বেশিদিন চলেনি, এবং নবাবপুরের বিভিন্ন মিছিলও ক্রমে একটি সমন্বিত মিছিলে পরিণত। প্রায় দেড়শ বছর এভাবেই চলছিলো, তারপরে ইসলামপুরের পান্নিটোলার গদাধর ও বলাইচাদ বসাক নামক দুই ধনাঢ্য ব্যবসায়ী তাদের এলাকা থেকে আরেকটি মিছিল বের করতে থাকেন, সেটি ১৭২৫ সালে। জেমস টেলর (১৮০৭), নবাবপুরের মিছিলকে লক্ষ্মীনারায়ণ ও ইসলামপুরের মিছিলকে মুরারি মোহনের দল বলে উল্লেখ করেছিলেন, তাদের ইষ্টদেবতার নামানুসারে।
এরপর থেকেই মিছিল দুটির মধ্যে প্রতিযোগিতার সূত্রপাত হয়, তাতে পাল্লা দিয়ে বাড়ে জাঁকজমক, কিন্তু বাদানুবাদেরও সৃষ্টি হয়, যাতে ক্রমে হাতাহাতি ও রক্তপাত পর্যন্ত গড়ায়। ইসলামপুরের মিছিলটি ইসলামপুরে শুরু হয়ে চলে যেত বাংলাবাজার, সেখান থেকে রায় সাহেবের বাজারের পুল অতিক্রম করে নবাবপুর রোডে উঠতো। অন্যদিকে নবাবপুরের মিছিল নবাবপুর থেকে রওনা হয়ে, রায় সাহেব বাজার পুল পার হয়ে বাংলাবাজার ঘুরে আবার নবাবপুরে ফিরে আসতো। দুটি মিছিল বের হয়তো এক সময়েই, ফলে সংঘর্ষ হয়ে উঠেছিলো অনিবার্য। মূল গণ্ডগোলটা হতো কে আগে পুল পার হবে সেটি নিয়ে! ১৮৫০ সনে ম্যাজিস্ট্রেট পুলের ৫০ গজ আগেই মিছিল শেষের নির্দেশ দেন, এর প্রতিবাদে নবাবপুর থেকে মিছিলই বের হয়নি। যা হোক, ১৮৫৬-এ ঢাকার কমিশনার দুই দিনে দুটি এলাকা থেকে আলাদা মিছিলের নির্দেশ দেন, এতে মারামারি অনেক কমে আসে।
জন্মাষ্টমীর মিছিল হতো প্রায় দু মাইল লম্বা, তার উপাদান মূলত স্থানীয় হলেও, পরবর্তীতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে উত্তর ভারতীয় উপাদানও যুক্ত হতে থাকে। মিছিলের শুরুতে থাকতো নেচে-গেয়ে যাওয়া মানুষজন, সঙ, মল্লযোদ্ধা, ডন-কুস্তি ও লাঠি খেলা। এদের পিছনে পিছনে নানা রঙের উচু নিশান, লাঠিসোঁটা, বর্শাবল্লম হাতে বিচিত্র রঙবেরঙের পোশাকে লোকজন ও দেবদেবীর মূর্তি। তারপরে বিশাল সব হাতি, যা আসতো সরকারি পিলখানা, ঢাকার নবাববাড়ি ও ভাওয়াল রাজবাড়ি থেকে। এর সাথে সাথেই থাকতো তাগড়াই সব ঘোড়া, যেগুলো আসতো আশেপাশের নানা জমিদারদের থেকে। সবশেষে ছিলো মূল আকর্ষণ, বিপুল পরিমাণে ছোট ও বড় চৌকি, পরিতোষ সেন যেগুলোর তুলনা দিয়েছেন গ্যালারির সঙ্গে, এমনকি জেমস টেলর যাদের সংখ্যা শতাধিক বলে উল্লেখ করেছিলেন। বিভিন্ন চৌকিতে থাকতো মঞ্চ, সিংহাসন বা দেবদেবীর মূর্তি (যার অনেকগুলোই খাটি সোনা বা রূপার তৈরি); বড় চৌকিগুলোতে চলে ভক্তিমূলক গানবাজনা বা নানা পৌরাণিক দৃশ্যের চিত্রায়ন। বড় চৌকিগুলো ছিলো ২০-২৫ ফুট চারকোনা পাটাতনের উপরে বসানো, প্রায় ৪০-৫০ উঁচু। সেগুলোতে ব্যবহৃত হতো জরি, চুমকি ও আয়না, পরে আরো যুক্ত হয় ঝালর, ঝুল ও ছাতা। প্রথমদিকে মিছিল অপরাহ্নে বের হলেও পরে কার্বাইড ও পেট্রোম্যাক্স ল্যাম্পের প্রচলন হওয়ায়, তা বের হতে থাকে সন্ধ্যার মুখে। তাতে মিছিলের রঙ ও রূপ যেন আরো ঝলসে ওঠে।
বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে এ মিছিল জৌলুস হারাতে থাকে, মূলত সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক দুরবস্থাই ছিল প্রধান কারণ। পাকিস্থান হওয়ার পরে এ মিছিল বের করা আর সম্ভব ছিলো না, অবশ্য মিছিল হয়তো বন্ধ হয়েছিলো আরো আগেই, কারণ ধনাঢ্য হিন্দু পরিবারগুলো পাড়ি জমিয়েছিলো ভারতে। বিংশ শতকের নব্বই দশকে ঈদ মিছিল পুনরায় শুরু করার পরে ঢাকার হিন্দু ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ও পুনরায় জন্মাষ্টমীর মিছিলের প্রচলন করে। তবে মিছিলের আগের সে জাঁকালো রূপ, উৎসবমুখর পরিবেশ ও সার্বজনীন হতে যে আরো সময় লাগবে, তা বলাই বাহুল্য।
ফটোঃ পলল ঘোষ
তথ্যসূত্রঃ
১। মুনতাসীর মামুন, ‘পুরানো ঢাকার উৎসব ও ঘরবাড়ি’, ‘ঢাকা সমগ্র ১’, অনন্যা, ২০০৩।
২। মুনতাসীর মামুন, ‘ঢাকার জন্মাষ্টমী উৎসবের ইতিহাস’, ‘ঢাকা সমগ্র ৪’, অনন্যা, ২০১২।
৩। James Taylor, ‘A Sketch of the Topography and Statistics of Dacca’, The Asiatic Society of Bangladesh, March 2010 (1st Edition 1840)
৪। Muntassir Mamoon, ‘Religious Festivals of Dhaka’, ‘400 Years of Capital Dhaka and Beyond’, Volume II: Economy and Culture, Asiatic Society of Bangladesh, 2011.
৫। Shameem Aminur Rahman, ‘Dhaka: In the Eyes of Painters 1789-1947’, Prothoma Prakashan, 2012