১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহ। এত কম চলচ্চিত্রে অভিনয় করে এমন জনপ্রিয়তা বোধহয় আর কেউ পাননি। আর কী আশ্চর্য, তাকে চলে যেতে হলো তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার সময়েই।
আর অমন জনপ্রিয় থাকলে যা হয়, সেই সময়েও তিনি অনেকগুলো চলচ্চিত্রের কাজ করছিলেন। অনেকগুলোর শুটিং শেষ হয়ে গিয়েছিল, পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজ চলছিল। সব মিলিয়ে মৃত্যুর পরে তার অভিনীত আরও ৮টি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়- জাকির হোসেন রাজুর জীবন সংসার (১৯৯৬), শিবলী সাদিকের মায়ের অধিকার (১৯৯৬), এম এম সরকারের চাওয়া থেকে পাওয়া (১৯৯৬), রেজা হাসমতের প্রেম পিয়াসী (১৯৯৭), নাসির খানের স্বপ্নের নায়ক (১৯৯৭), শিবলী সাদিকের আনন্দ অশ্রু (১৯৯৭), কাজী মোর্শেদের শুধু তুমি (১৯৯৭) এবং ছটকু আহমেদের বুকের ভেতর আগুন (১৯৯৭)।
এগুলোর মধ্যে বুকের ভেতর আগুন-এর কাজ সালমান শাহ পুরোপুরি শেষ করে যেতে পারেননি। পরে চলচ্চিত্রটির কাহিনি খানিকটা বদলে নতুন চরিত্র সৃষ্টি করে চলচ্চিত্রটির নির্মাণ শেষ করা হয়। আর সেই নতুন চরিত্রের মাধ্যমে রুপালি পর্দায় অভিষেক ঘটে চিত্রনায়ক ফেরদৌসের।
আগে ফেরদৌস মূলত র্যাম্প মডেলিং করতেন। তাকে প্রথম চিত্রজগতে আনার উদ্যোগ নেন নৃত্যপরিচালক আমির হোসেন বাবু। নৃত্যকে উপজীব্য করে তিনি একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। নাম ভেবেছিলেন নাচ ময়ূরী নাচ। সেই চলচ্চিত্রের নায়ক হিসেবেই তিনি ফেরদৌসকে বাছাই করেছিলেন। পরে আর সেই চলচ্চিত্রটি তিনি নির্মাণ করতে পারেননি।
এর মধ্যেই সালমান শাহর আকস্মিক মৃত্যু ঘটল। ফলে অনিশ্চিত হয়ে গেল বেশ কিছু চলচ্চিত্রের ভবিষ্যত। এর মধ্যে ছটকু আহমেদের বুকের ভেতর আগুন-ও ছিল। সালমান শাহর মৃত্যুর পর পরিচালক গল্প খানিকটা বদলে নিয়ে চলচ্চিত্রটি শেষ করার উদ্যোগ নিলেন। গল্পে নতুন একটি নায়ক চরিত্র অন্তর্ভুক্ত করা হলো। আর সেই চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমেই রূপালি পর্দায় অভিষেক হলো ফেরদৌসের। প্রথম ছবিতে প্রশংসিত হলেও, ফেরদৌস নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন ১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া বাসু চ্যাটার্জী পরিচালিত যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র হঠাৎ বৃষ্টি দিয়ে।
এছাড়া আরও একটি চলচ্চিত্রের শুটিং শুরু করেও শেষ করে যেতে পারেননি সালমান শাহ। মতিন রহমান পরিচালিত সেই চলচ্চিত্রটির নাম মন মানে না (১৯৯৭)। মাত্র অর্ধেকের মতো শুটিং করা হয়েছিল বলে, সালমান শাহ-র মৃত্যুর পরে, তার পরিবর্তে রিয়াজকে নিয়ে নতুন করে চলচ্চিত্রটির শুটিং করা হয়।
রিয়াজ ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনির পাইলট হিসেবে। পরে সেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন এফডিসিতে, নায়ক হিসেবে। তার প্রথম চলচ্চিত্র দেওয়ান নজরুলের বাংলার নায়ক মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে। ১৯৯৬ সালে দিলীপ বিশ্বাসের অজান্তে চলচ্চিত্রে আলমগীর-সোহেল রানার পাশাপাশি অভিনয় করেন তিনি। একই বছরে তিনি সালমান শাহর সাথেও অভিনয় করেন রানা নাসের পরিচালিত প্রিয়জন-এ। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে।
দিলীপ বিশ্বাসের হাত ধরেই প্রথমবার মন মানে না-র সেটে গিয়েছিলেন রিয়াজ। সেটা ১৯৯৬ সালের জুন মাসের কথা। এফডিসির ৮ নম্বর ফ্লোরে শুটিং চলছিল। সেখানে একটি মাজারের সেট তৈরি করা হয়েছে। তাতে একটি গানের দৃশ্যায়ন চলছিল; জীবনের প্রতি হতাশ সালমান শাহ মাজারে গিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ জানিয়ে কাঁদছেন আর গাইছেন। তার পরনে সবুজ রংয়ের পাঞ্জাবি। আর কী আশ্চর্য, সেদিনই ছিল মন মানে না ছবিতে সালমান শাহর শেষ অভিনয়। এর মাস তিনেক পরেই তিনি মারা যান।
কিন্তু তখনো সিনেমাটির অর্ধেকের মতো শুটিং বাকি। তাই পরিচালককে নতুন নায়ক নিয়ে ছবিটি নির্মাণ করতে হলো। যে রিয়াজ ওই দিন দিলীপ বিশ্বাসের সাথে সালমান শাহর শুটিং দেখতে এসেছিলেন, সালমান শাহর বদলে নতুন নায়ক হিসেবে নেয়া হলো সেই রিয়াজকেই। নতুন করে শুটিংয়ের পরে, ১৯৯৭ সালের ১১ নভেম্বর মুক্তি পায় ‘রিয়াজ-শাবনুর’ অভিনীত মন মানে না। সুপারহিটও হয়।
একই বছর মুক্তি পায় রিয়াজ অভিনীত মহম্মদ হাননানের প্রাণের চেয়ে প্রিয়। চলচ্চিত্রটির পরে না চোখের পলক গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সেই সঙ্গে শাবনুরের সঙ্গে জুটি বেঁধে মন মানে না এবং পূর্ণিমার সঙ্গে জুটি বেঁধে এ জীবন তোমার আমার চলচ্চিত্রগুলো রিয়াজকে নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়।