বছর ঘুরে আবারও এসেছে পূজা, বাজছে ঢাক। সাম্প্রতিক সময়কে বিবেচনায় নিলে, ঋতুপর্ণ ঘোষ আমাদের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচালকদের একজন। নিজের মাত্র ৪৯ বছর জীবনে ২০টিরও বেশি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। এরমধ্যে কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস-নাটক-কবিতা নিয়ে, শীর্ষেন্দুর ছোটদের কাহিনি এমনকি শরবিন্দুর ‘সত্যান্বেষী’ ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়েও।
নিজের সিনেমাগুলোর মধ্যে দুটো চলচ্চিত্রের কাহিনি কাঠামো ঋতুপর্ণ একেবারেই দুর্গা পূজাকে কেন্দ্র করে বানিয়েছেন- উৎসব (২০০০) এবং অন্তরমহল (২০০৫)। দুটো চলচ্চিত্রের কাহিনিই আবর্তিত হয়েছে দুটো পরিবারের বনেদি পূজাকে কেন্দ্র করে। দুটোই সামন্ত পরিবার। সময়কাল, পরিবার দুটোর অবস্থা ও ইতিহাস ইত্যাদি মিলিয়ে চলচ্চিত্র দুটোর জমিদার পরিবারের মধ্যে এক ধরনের দূরগত সম্পর্কও আছে। এবং সে সম্পর্কও বর্ণিত হয়েছে তাদের পারিবারিক পূজাকে আশ্রয় করেই।
উৎসব– এর প্রেক্ষাপট সমকালীন কলকাতা। আর অন্তরমহল উনিশ শতকের শেষ সময়ের পটভূমিতে নির্মিত। নির্দিষ্ট করে বললে ১৮৭৮ সালের। স্বাভাবিকভাবেই অন্তরমহলে হদিস মেলে তখনকার জমিদারবাড়ির রমরমা অবস্থা। জমিদারের জন্য তখন রায়চৌধুরী খেতাব অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই অভিপ্রায় থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন দেবী প্রতিমার মুখ গড়বেন ভারতেশ্বরী মহারানি ভিক্টোরিয়ার আদলে। আর সে খবর কোনোভাবে ইংল্যান্ডে পৌঁছাতে পারলেই হলো। তার রায়চৌধুরী খেতাব আটকাবে কে!
অন্যদিকে উৎসব সিনেমাটির সময়কালে এসে দেখা যায় জমিদার বাড়িটির প্রায় যায়-যায় অবস্থা। বাড়িতে ছেলেমেয়েরা সকলে থাকে কলকাতায়। বাড়িতে থাকেন একা দিদিমা। তবে এই জমিদার পরিবারও একসময় রায়চৌধুরী উপাধি পেয়েছিল। কিন্তু শেষ দিকে এ বাড়ির এক জমিদার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগ দেন। সে কারণে একবার দেবী প্রতিমাকে গড়েছিলেন ভারতমাতার আদলে। সে খবর কোলকাতায় পৌঁছলে, কেড়ে নেয়া হয় খেতাব।
দুটো সিনেমার গল্পের মূল কেন্দ্র দুর্গাপূজা হলেও সিনেমায় দুটো আলাদা সময়কে দেখানো হয়েছে। অন্তরমহলের কাহিনি যখন শুরু হয়েছে তখন পূজার প্রস্তুতি দিয়ে। সে আয়োজনের আড়ম্বর বাড়ার সাথে সাথে কাহিনির জটিলতাও উত্তরোত্তর জট পাকাতে শুরু করে। আর কাহিনি শেষ হয়েছে ঠিক পূজার শুরুতে, দেবী প্রতিমা বোধনের মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে উৎসবের কাহিনি শুরু হওয়ার আগেই পূজা শুরু হয়ে গেছে। আর কাহিনির জটিলতার জট ছাড়াতে ছাড়াতে পূজাও শেষ হয়ে যায়।
উৎসব ও অন্তরমহল– দুটো চলচ্চিত্রই শুরু হয়েছে দেবী দূর্গার প্রতিমা দেখানোর মধ্য দিয়ে। সে দেখানোর ধরণ-ধারণ অবশ্য আলাদা। উৎসব শুরু হয়েছে প্রতিমা তৈরি দেখিয়ে। একটি চরিত্রকে দিয়ে পরিচালক নিজেই বলে দিয়েছেন, দৃশ্যটি সত্যজিতের জয় বাবা ফেলুনাথ-এর ট্রিবিউট। অন্যদিকে অন্তরমহল শুরু হয়েছে স্রেফ প্রতিমা দেখিয়ে। দেখাতে দেখাতে এক ফিরিঙ্গি শিল্পীকে দিয়ে বলানো হয়েছে, বাংলার ঘরে ঘরে যে দেবীরা ঘর-সংসার সামলাচ্ছেন, পূজার প্রতিমার মুখের চেয়ে তাদের মুখ কত সুন্দর, কত প্রাণবন্ত।
দুর্গা পূজার মিল, সাথে পূজা দেয়া পরিবার দুটোর মিল থাকলেও, চলচ্চিত্র দুটোর গল্পে অবশ্য কোনো মিল নেই। উৎসবের কাহিনি মূলত নাগরিক জীবনের চাপে ভেঙে যেতে থাকা একান্নবর্তী পরিবারের গল্প। অন্যদিকে অন্তরমহলের গল্পে মূলত উঠে এসেছে কর্নওয়ালিসি বন্দোবস্ত পাওয়া জমিদারদের অসংযত ও খেয়ালি জীবনযাপন এবং সেই সময়ের সমাজে নিজেদের স্বার্থ ও লালসা চরিতার্থ করতে ব্রাহ্মণদের ধর্মের অপব্যবহার।
তবে চলচ্চিত্র দুটোর সবচেয়ে বড় মিল, দুটো চলচ্চিত্রই ভীষণ উপভোগ্য। এমনিতেই এবারের পুজোর সময়টায় ভীষণ গরম যাচ্ছে। তাতে কেউ যদি ভাবেন, এবারের পুজোর ছুটিটা ঘরে বসেই কাটিয়ে দেবেন, তবে এই সিনেমা দুটো দেখে ফেলতে পারেন। তাতে এই গরমে ঘর থেকেও বের হতে হলো না, আবার পূজার আবেশও গায়ে মাখা গেল খানিকটা। সেই সাথে ঋতুপর্ণের দুটো চলচ্চিত্র দর্শনের ভালো লাগা তো উপরি।