নো ম্যান’স ল্যান্ড, দুই দেশের সীমানার মধ্যবর্তী জায়গা টুকুন। সেখানে কোন বসতি নেই, কোন সমাজ নেই, নিয়মনীতির কোন বালাই নেই। কেবলই কাঁটাতারে ঘেরা এক না মানুষী এলাকা। এমন এক অনিকেত প্রান্তরের কথা বলেছিল আর্টসেল, এক দশক আগে।
২০০৬ সালে বের হয়েছিল আর্টসেলের একটি অ্যালবাম। যার ১৬ মিনিট ২০ সেকেন্ডের প্রোগ্রেসিভ মেটাল লিড সংয়ের নাম ছিল, অনিকেত প্রান্তর। গানটির কথা আর দৈর্ঘ্য নিয়ে উত্তেজনার সীমা ছিল না ভক্তদের। একদমই রূপক ছিল লিরিক। পরে যদিও বিভিন্ন লাইভ শো, সাক্ষাৎকারে গানের অর্থ নিয়ে কথা বলেছিলেন আর্টসেল সদস্যরা। গানটি লিখেছিলেন রুম্মান আহমেদ। নিজের এক সাক্ষাৎকারে গানটি নিয়ে ব্যান্ডের ভোকাল ও রীফ প্লেয়ার লিঙ্কন ডি’কস্টা বলেছিলেন- ‘মানুষ আপাত স্বাধীন হলেও স্বাধীনভাবে সে যে তার প্রতিটি স্বপ্নকেই বাস্তবায়িত করতে পারে না। কেবল অনিকেত প্রান্তরে দাঁড়িয়েই তার পক্ষে নিজের স্বপ্নগুলোকে স্বপ্নে হলেও এক ধরণের বাস্তবতায় রূপ দিতে পারে। বাস্তবে হয়তো সেগুলো স্বপ্নের দলা পাকানো বাসি কবিতা, নষ্ট গান হয়েই ঝরে যায়।
আরাকানে চলছে এমনই এক অবাস্তব নৃশংসতা। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতো রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘরও পুড়িয়ে ছাই করে চলেছে। শরণার্থীদের স্বাধীন স্বপ্ন দেখার কোন সুযোগ নেই, আর রোহিঙ্গাদের তো সে সুযোগ নেই আরও। সীমানার দুইপারে কেবলই দুঃস্বপ্ন আর জীবন যাওয়ার ভয় তাদের।
আজকের রোহিঙ্গাদের সেই অনুভূতির কথাও যেন বলা আছে দশক পেরোনো আর্টসেলের সেই বিখ্যাত গানটির দ্বিতীয় স্তবকে-‘দুটো মানচিত্র এঁকে দুটো দেশের মাঝে_বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ’।
অনিকেত প্রান্তরের মাঝামাঝির একাংশে ছিল-‘মেঘের দূরপথ ভেঙ্গে বুকের গভীর অন্ধকারে_আলোর নির্বাসন স্মৃতির মতো_অবিকল স্বপ্নঘর বাঁধা স্মৃতির অন্ধ নির্জনে_সময় থেমে থাকে অনাগত যুদ্ধের বিপরীতে’।
ঠিক যে জীবন রোহিঙ্গারা পেছনে ফেলে পালিয়ে এসেছে, সে জীবনে তাদের ঘর-সংসার ছিল, স্বপ্ন ছিল, আবাদি জমি ছিল। এখন আবার জীবনের অনিশ্চয়তার পাশাপাশি যোগ হয়েছে ফিরে যাওয়া নিয়ে উপায়হীনতাও। ওপারে কেবলই বুলেটবাহী যুদ্ধের নির্মমতায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। আর ফেলে আসা সুখের সব স্মৃতি ফিরে পাবার মতো ভবিষ্যতের আলোও আজ প্রায় অসম্ভব। রোহিঙ্গাদের এই অনিশ্চিত জীবনের একই প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় গানটির আরও একাংশে- ‘তবু তোমার ভাঙ্গা স্মৃতি, ছেঁড়া স্বপ্ন, দোমড়ানো খেলাঘর_চেরা আকাশ ভাঙ্গা কাঁচে_আলো আর অন্ধকার তোমার_তোমার দেয়ালে কত লেখা, মানুষের দেয়ালে দেয়াল_বেড়ে ওঠে কাঁটাতার, এখানে মহান মানচিত্রের ভাগাড়”।
অনিকেত প্রান্তর গানের প্রথম ও শেষ দিকের দু’টি ভিন্ন অংশের সাথে করুণ ভাবে মিলে গেছে রোহিঙ্গাদের জীবন। নাফ নদী আর বঙ্গোপসাগর পাড়ি দেওয়ার সময়ে মায়ের কোলে একটু অসাবধানতার মূল্য দিতে কোলের শিশু হচ্ছে ‘লাশ’। ‘কত শিশু কত আলোর মশাল নিভে গেছে_নিভে গেছে কত অচেনা ভয়_তোমাকে এখন অপরিণত এক অচেনা স্মৃতি মনে হয়_তোমার জানালার বাইরে শূন্যে_দূরের স্বপ্নঘর, ঝুলে আছি নির্জনতায়_মৃত্যু কি অনিকেত প্রান্তর???’ নির্জন অনিকেত প্রান্তরে নির্বাক লাশদের পরিচয় কেবলই রোহিঙ্গা। অপরিণত অচেনা স্মৃতিগুলো শুধু লাশ হয়ে ঝুলে, ভেসে পচে যাওয়ার অপেক্ষায়। তাই “নির্জনতায় মৃত্যু কি অনিকেত প্রান্তর?” এই প্রশ্ন কার কাছে করতে হবে জানা নেই কারো।
দশক পুরনো একটা গানের সাথে সমকালীন তীব্রতম ঘটনার এত মিল!! মাঝখানে অনিকেত প্রান্তরের ভূমিকায় রোহিঙ্গাদের জীবনে আজ নাফ নামের নদী ও বঙ্গোপসাগরের সামান্য অংশ। এই জলপথে পচা কাঠের পুরনো নৌকায় ভেসে ভেসে স্বপ্নে হলেও একবার স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেই পারে রোহিঙ্গার দল। স্বপ্ন দেখার জন্য কেবল ঐ জায়গা টুকুনই তো আছে তাদের।
ছবি ঃ দীন মোহাম্মদ শিবলী