‘খাঁচা’, বন্দিত্ব থেকে মুক্তির গল্প

‘খাঁচা’ সিনেমার গল্পটা বাড়ি বিনিময় নিয়ে। দেশভাগের পরে দু’পারের পরিবারগুলো নিজেদের পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়েছিল বাধ্য হয়ে-সেই সব করুণ শেকড় ছাড়ার গল্প থেকেই আকরাম খান বেছেছেন নিজের সিনেমার রসদ, বাংলার অন্যতম শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের সাহিত্য থেকে।

ওপার থেকে আসবে একটি মুসলিম পরিবার। বাড়ি বিনিময় হবে এপারের হিন্দু এক পরিবারের সাথে। জলের মানুষ যাবে শুকনো ডাঙ্গায়। আর সেই শুকনো বাড়ির মানুষেরা নদী পেরিয়ে আসবে জলের দেশে। এই জল আর স্থল। বাড়ি বিনিময়ের স্বপ্ন। দিন বদলের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন দিয়েই গল্পের শুরু। শেষও হয় স্বপ্নের গল্প দিয়েই। আদৌ কি ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে হীরন-সরোজের? তক্ষক তো দেখা দিয়েছিল তাদের গৃহে দেবতা হয়ে। এরপর কি হয়?

‘খাঁচা’ গল্পটি লিখেছিলেন হাসান আজিজুল হক। সরকারি অনুদানের সিনেমা। বাংলা ইতিহাসের বিশেষতম এক অধ্যায়কে অবলম্বন করে গল্পের পটভূমি গাঁথা। দেশ ভাগের টানা পোড়েন, নিরাপত্তা, ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন ইত্যাদি নিয়ে এক মহাকাব্যিক গল্প। পরিচালক আকরাম খান ঠিক সেই অস্থির সময়কেই বেছে নিয়েছেন।

খাঁচা সিনেমার পোস্টার

মূল চরিত্রগুলোতে দারুণ দক্ষতার সাথে অভিনয় করেছেন মামুনুর রশীদ, আজাদ আবুল কালাম এবং জয়া আহসান। বিশেষ করে বর্তমানে কলকাতার বাংলা সিনেমা অথবা প্রচলিত ঢাকার সিনেমার চেনা চরিত্রের বাইরে একদম আটপৌরে হিন্দু গৃহিণীর চরিত্রে বেশ জমিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। ২৫ বছর আগের এক ভরা সংসারের অবশিষ্ট সদস্যদের নিয়ে এই গল্প, যার পারিবারিক গ্রুপ ছবি তোলার মুহূর্তে জয়া প্রশংসিত হন ‘দেবী’র মত দেখতে বলে। সেখানে থেকে দর্শক দেখে নতুন আরেক জয়াকে, যে কিনা বয়সের ভারে নুইয়ে গেছে। তুলসী তলা, জবা ফুল, দোতলা ইটের বাড়ি মিলে ভরা এক সংসারের গল্প উপস্থিত হয় শুধুই অতীতের স্মৃতি হিসেবে।

পটভূমির সময়টা এখন থেকে ৭০ বছর আগের কিনা, খট খট করে খড়মের শব্দ বাজবে কানে। মামুনুর রশীদের অভিনীত চরিত্রটি যখন পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয় তখন একমাত্র নিয়তি হয়ে দাঁড়ায় যেন মৃত্যু। যদিও দুর্যোগের সেই সময়ে পরিবারটি না খেয়ে ছিলোনা।

গল্পের সবটা বাড়ি বিনিময় সংক্রান্ত প্রত্যাশা-হতাশা এসবের উপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে ছিল। আর সেই স্তরগুলো দেখানো হয়েছে যথাক্রমে ১৯৪৮, ১৯৫৪, ১৯৫৭ আর ১৯৬৪ এই চারটি সময়কে ভিত্তি হিসেবে ধরে। যদিও সময়ের সাথে সাথে ছেলে-মেয়েদের চরিত্রগুলোর শারীরিক পরিবর্তনের গতি পরিচালক গুলিয়ে ফেলেছেন। বয়সের ভারে পর্দায় সবচেয়ে কাতর হয়েছেন কেবল হীরন ডাক্তারের চরিত্রের আজাদ আবুল কালাম।

বাড়ি বিনিময়ের কল্যাণে এপারে আসা এক মুসলিম পরিবারের গল্পও পর্দায় এসেছে কিছু সময়ের জন্য। তবে মানুষের প্রকট অভাবের মূল চিহ্ন হিসেবেপুরো সিনেমাজুড়েই বারবার প্রতীকি উপস্থাপন ছিল হীরণের ভিজিট পাওয়ার মূহূর্তগুলো।

নেশাগ্রস্ত বড় ছেলে সূর্য, মেজ ছেলে অরুণ, আর দুরন্ত দুই ভাই-বোন ভ্যাবলা ও পুষ্পের অভিনয় দারুণ। অরুণ  চরিত্রে অভিনয় করেছে একসময়ের শিশু শিল্পী পিদিম। হিন্দু-মুসলিম পরিস্থিতির যেই রাজনৈতিক-সামাজিক সংকট, তার উপস্থাপনা কেন জানি সিনেমাতে ছিল শুধুই কিছু দাঙ্গার খবর আর সরোজিনীর ছোট ছেলেমেয়ের সাথে পাড়ার অন্য মুসলিম ছেলেমেয়েদের আচরণের মধ্যেই।

সিনেমার গল্পটাই ধীর লয়ের। যদিও দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগে, ১৯৫৭ তেও যাদের চোখে মুখে সুখের ঝলক দেখা যায়, ঠিকঠাক মত দালাল খুঁজে পাওয়ার আশায়, আদৌ সেই বাড়ি বিনিময় হবে কিনা? পুরো পরিবার নিয়ে নৌকায় চেপে ভারত যাত্রার সরোজের স্বপ্নপূরণ হবে কিনা? এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের পরিণতিই এখন হলে গিয়ে দর্শকের জানার অপেক্ষা।