ফেলুদা বাংলার গোয়েন্দাকুল শিরোমনি। তার সঙ্গে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ব্যোমকেশ বক্সী। কিন্তু সে আবার ঠিক গোয়েন্দা নয়- ‘সত্যান্বেষী’। সেই হিসেবে, সুনির্দিষ্টভাবে ‘গোয়েন্দা’ বিবেচনা করলে, ফেলুদা বাংলা সাহিত্যের অবিসংবাদী গোয়েন্দা চরিত্র। কিন্তু বাংলাদেশি ভক্তদের এক আজন্ম আক্ষেপ ছিল, ফেলু মিত্তির কখনোই বাংলাদেশে পাড়ি দেননি। ঢাকার বুকে কখনোই পা-ই রাখেননি।
তবে এবার সেই আক্ষেপ ঘুচতে যাচ্ছে। না, সত্যজিতের লেখা ফেলুদার কোনো হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপি নতুন করে উদ্ধার হয়নি। কিংবা ফেলুদার কোনো গল্পে বাংলাদেশের কোনো উল্লেখও আচমকা কেউ আবিষ্কার করে বসেনি। ফেলুদার গল্পগুলো আগের মতোই থাকছে। তবে কিনা স্বয়ং ফেলুদাই চলে আসছেন বাংলাদেশে। আর তা নিশ্চিত করে জানাতে ঢাকা ঘুরে গেছেন সত্যজিত-পুত্র সন্দ্বীপ রায়।
পুত্র হিসেবে এখন ফেলুদার স্বত্বাধিকারী এই সন্দ্বীপ রায়। সত্যজিৎ গাদা গাদা ফেলুদার গল্প লিখে গেলেও, বানানোর সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র দুটো- জয় বাবা ফেলুনাথ আর সোনার কেল্লা। এরপর যত ফেলুদা বানানো হয়েছে, চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিজ- সবগুলোরই পরিচালক এই সন্দ্বীপ রায়। কখনোই তিনি ফেলুদাকে অন্য কারো হাতে ছাড়েননি, ছাড়তে পারেননি। তবে এবার ছেড়েছেন।
ছেড়েছেন, কারণ নাকি বাংলাদেশ থেকে ডাক এসেছে বলে। সংবাদ সম্মেলনের একগাল হাসি নিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের প্রতি রায় পরিবারের নাকি এক বিশেষ ভালোবাসা আছে। তাই বাংলাদেশ থেকে চাওয়া হয়েছে বলে আর না করতে পারেননি তিনি। ফেলুদার সমস্ত গল্পের স্বত্ব বিক্রি করে দিয়েছেন প্রযোজনা সংস্থা ক্যান্ডি প্রোডাকশন এবং টম ক্রিয়েশনসের কাছে। তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশে পদার্পণ ঘটছে ফেলুদার।
হ্যাঁ, বাংলাদেশে ফেলুদাকে নিয়ে টিভি-সিরিজ বানানো হচ্ছে। কাজেই সেখানে ফেলুদাকেও প্রায়ই ঢাকায় আসতে হবে। নইলে আর জমবে কেন! একে একে এপিসোড বানানো হবে ফেলুদার সবগুলো গল্প নিয়েই। প্রথম সিজনে থাকছে চারটি গল্প- শেয়াল দেবতা রহস্য, ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা, গোলকধাম রহস্য এবং গ্যাংটকে গণ্ডগোল। প্রচারিত হবে চ্যানেল আইতে। তবে কেউ যদি টিভিতে দেখতে নাও পারেন, তাতেও কোনো সমস্যা নেই। কারণ টিভিতে সম্প্রচারের পরপর সিরিজটি চলে আসবে অনলাইনে, ওয়েব সিরিজ হিসেবে। বাংলাদেশে দেখা যাবে বায়স্কোপ-এ, আর দেশের বাইরে আড্ডা টাইমস-এ।
নতুন এই টিভি-সিরিজে ফেলুদাকে দেখা যাবে নতুন রূপে। নতুন চেহারায় তো বটেই, তার হাবভাবে-চলাফেরাতেও আসছে নতুনত্ব আর আধুনিকতা। ঢাকার ফেলুদা নতুন ঢাকার মতোই ঝাঁ-চকচকে। তার হাতে থাকে স্মার্টফোন। প্রয়োজনের সময় আগের মতো পেট মোটা এনসাইক্লোপিডিয়া ঘাঁটে না আর। গুগলে সার্চ দিয়েই জেনে নেয় দরকারি তথ্য। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে গল্পগুলোর চিত্রায়নেও। ফেলুদার উপর যেমন শার্লকের একটা প্রভাব ছিল, তেমনি ফেলুদাকে নিয়ে এই টিভি সিরিজেও সম্ভবত থাকতে যাচ্ছে শার্লক সিরিজের প্রভাব।
বাংলাদেশের প্রথম এই ফেলুদা অবশ্য বাংলাদেশের কেউ হচ্ছেন না। সিরিজটাতে ফেলুদা যেমন গোয়েন্দাগিরি করতে কোলকাতা থেকে উড়ে আসবেন ঢাকায়, তেমনি সিরিজের ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করতে কোলকাতা থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছে পরমব্রতকে। তোপসের চরিত্রেও থাকছেন কোলকাতার আরেক অভিনেতা ঋদ্ধি সেন। পরিচালনার দায়িত্বেও থাকছেন পরমব্রত। এমনকি সহযোগী পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সিনেমাটোগ্রাফার, এডিটর, সঙ্গীত- সর্বত্রই সত্যজিতের দেশের মানুষেরই জয়জয়কার।
তবুও তো ফেলুদা ঢাকায় আসতে পারল, সেটাই বা কম কী! সারা জীবনই তো ফেলুদাকে কোলকাতার অলিগলিতে দৌড়াতে দেখা গেছে, এবার সে ঢাকার অলিগলিতেও দৌড়াবে, রাজপথেও ছোটাবে গাড়ি। ফেলুদাকে দেখা যাবে আমাদেরই পরিচিত শহরের পরিচিত রাস্তায়। চেনা গোয়েন্দার সঙ্গে চেনা শহরের মেলবন্ধনে ভালো লাগার অনুভূতিটা বেড়ে যাওয়ারই কথা। এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশের ফেলুদা সে আশার কতটা পূরণ করতে পারে।