ডুব কি একটি অসৎ সিনেমা হতে যাচ্ছে?

২০১৩ সালের অক্টোবরে ‘দ্য টক্‌স’ নামের একটি ওয়েবসাইটে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা কুয়েন্টিন ট্যারান্টিনোর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেখানে এক প্রশ্নের জবাবে খুব জোর দিয়ে তিনি সিনেমার সততা-অসততা নিয়ে কিছু মন্তব্য করেন। কেমন সিনেমা পছন্দ নয় এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “… বায়োপিক সিনেমার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। এগুলো স্রেফ অস্কার জেতার কারসাজি। এগুলো সব অসৎ সিনেমা।” নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যায় বলেন, “পৃথিবীর সবচেয়ে দারুণ লোকটার জীবনীও যদি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলে যান তাহলেও একটা আস্ত বিরক্তিকর সিনেমাই হবে।”

যাকগে, পুরো সাক্ষাৎকারের গল্প বলতে গেলে এই লেখা আরও বিরক্তির উদ্রেক করবে। প্রসঙ্গে আসা যাক। গতকাল প্রকাশিত হয়েছে বহুল আলোচিত ডুব  সিনেমার ট্রেলার। সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন আলোচিত পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং সিনেমার গল্প গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের ততোধিক আলোচিত এবং প্রখ্যাত লেখক-পরিচালক হুমায়ুন আহমেদের জীবনকে ঘিরে। হ্যাঁ, এই প্রসঙ্গে এখনও বিতর্কের অবকাশ আছে। সিনেমার গল্প নিয়ে প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের দাবি মেনে চলচ্চিত্রের কিছু অংশ বাদ দিয়ে তবেই মিলেছে মুক্তি! পহেলা বৈশাখে জমা পড়ার পর সেন্সরবোর্ড ছাড়পত্র দিয়েছে সিনেমাটির। তবে এই ছাড়পত্র নেওয়ার আগেই মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ঘুরে এসেছে ডুব। সেখান থেকে প্রশংসাসমেত একটি পুরস্কারও বগলদাবা করে নিয়ে এসেছেন ফারুকী অ্যান্ড গং।

জাভেদ খানের মৃত্যু

এই ফেস্টিভ্যালের পর হলিউড রিপোর্টার, ভ্যারাইটি, স্ক্রিন ডেইলির মতো বহুল প্রচারিত ইংরেজি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে ডুবের রিভিউ। সেই রিভিউ থেকে জানা গেছে বেশ খানিকটা স্পয়লার। এই স্পয়লার থেকে সিনেমার গল্পে হুমায়ুন আহমেদের ছায়া খুঁজে পাওয়া মোটেই অসম্ভব কিছু নয়। আর যতটুকু আন্দাজ করতে বাকি ছিল তা সব দর্শকের একদম হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে এই এক ট্রেলারের মাধ্যমে।

দুই বান্ধবী। একজন জাভেদ খানের মেয়ে ,আরেকজন স্ত্রী

অত্যন্ত সাদামাটাভাবে সাজানো ২ মিনিট ৫১ সেকেন্ডের ট্রেলার। শুরুতেই উল্লেখিত তিনটি গণমাধ্যমের প্রশংসাসূচক মন্তব্য আসলে সিনেমায় ইরফান খানের অভিনয়ের গুণগান। তারপর বিভিন্ন মঞ্চে উপস্থিতি ও জয়সূচক পুরস্কারের খতিয়ান এবং নেপথ্যে সিনেমার মূল চরিত্র বয়ানের ‘ভয়েস ওভার’- “তিনি ছিলেন কৌতুহলী একজন মানুষ। এই কৌতুহলই হয়ত তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল প্রেমের জটিল উদ্যানে।”

দ্বিতীয় স্ত্রীর তিরস্কার

ট্রেলারে দেখা যাচ্ছে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এক চরিত্রের জীবনের দ্বিতীয় ভাগ। যেখানে আছে তার কন্যার তিরস্কার, ছেলেকে মনে পড়া, প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্য, দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে টানাপোড়েন, মৃত্যু এবং তৎপরবর্তী বিশাল জটিলতা। মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ধাপ জন্ম, মৃত্যু এবং বিবাহের মধ্যে এখানে শুধু জন্মটাই অনুপস্থিত। বাদবাকি সমস্ত ঘটনাবলীর গৎবাঁধা এবং অনুক্রমিক উপস্থাপন হয়েছে ট্রেলারে।

মানসিক বিপর্যয় দেখাতে মদ্যপানের ইঙ্গিত

সিনেমার বিপণনকে আজকাল সম্ভবত কোনো কোনো বাংলা ছবির পরিচালক আর গোণায় ধরছেন না। বলা নেই কওয়া নেই হুটহাট মুক্তি দিয়ে দিচ্ছেন আস্ত সিনামাই। সেখানে টিজার না হোক, একটি পোস্টার এবং একটি ট্রেলার মুক্তি দেওয়া নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য পদক্ষেপ। যদিও এই ট্রেলারটি বিশেষভাবে হতাশার উদ্রেক ঘটিয়েছে। সাধারণত প্রচারণার অংশ হিসেবে ট্রেলার মুক্তি দিয়ে সিনেমা সম্পর্কে দর্শকের আগ্রহ উস্কে দেওয়া হয়। কিন্তু এই ট্রেলার বরং আগ্রহের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে। সিনেমার প্লট অনুমান করতে আর একটুও বাকি থাকে না। সেক্ষেত্রে প্রচারণার বদলে দর্শকের আগ্রহের প্রদীপ নিভিয়ে দিতেই বেশি কার্যকর হবে ট্রেলারটি।

সন্তানের খোঁজ নিচ্ছেন পিতা

তবে সামনেই অস্কার। আর ট্যারান্টিনোর রুচি অনুযায়ী বললে, ডুব হতে যাচ্ছে একটি অসৎ সিনেমা। যেখানে হুমায়ুন আহমেদ, থুক্কু, জাভেদ খানের গোটা জীবন পর্দায় উঠে আসতে যাচ্ছে। এসব সিনেমা ট্যারান্টিনোর ভাষায়, ‘অস্কার’ জেতে।
তবে আশার বাত্তি জ্বালিয়ে রাখতে কিছু তথ্য স্মরণ করা যেতে পারে। ব্যাচেলর, মেড ইন বাংলাদেশ, থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার, পিঁপড়াবিদ্যা, টেলিভিশন এই ক্রমিক অনুসরণ করলে দেখা যাবে তরুণ থেকে ক্রমশ বুড়িয়ে গিয়েছেন ফারুকী। অর্থাৎ উইটি কাজ দিয়ে শুরু করে দিনে দিনে পরিণত হয়েছেন তিনি। তাই ডুব হতে পারে তার এ যাবৎকালের সবচেয়ে পরিণত সিনেমা। তাছাড়া, বেশ ক’বছর ধরে ভালো ভালো ট্রেলার দেখে মূল সিনেমায় হতাশ হয়েছেন অনেক দর্শকই। তাই মন্দ ট্রেলারের ছবি উপভোগ্য হতেই পারে- এই কল্পিত তত্ত্বে আপাতত ভেসে থাকুক ডুব– এর আশা।