কাশ্মিরি বংশোদ্ভূত মার্কিনি কবি আগা শাহিদ আলী রচিত ‘The Country without a Post Office’ কবিতা অবলম্বনে নির্মিত নাটক রিজওয়ান। যার পরিকল্পনা ও নির্দেশণা সৈয়দ জামিল আহমেদের। নাট্যরূপ দিয়েছেন অভিষেক মজুমদার, ভাষান্তর ঋদ্ধিবেশ ভট্টাচার্যের।
রিজওয়ান, নন লিনিয়ার নাটক। নাট্যভাষা নির্মাণে নির্দেশকের দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ ঋদ্ধ মননের সুনিপুণ সৃজনের উচ্চতর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে রিজওয়ানে। কিন্তু চাইলে বড় সরলীকৃত সমীকরণে গল্পটা বলা যেতে পারে। রিজওয়ান, এক উচ্ছল তরুণের কথা বা সোজা বাংলায় সেই তরুণের কথা যার উচ্ছ্বল থাকার কথা ছিল। নব্বইয়ের দিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নির্মমতায় কাশ্মীর পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। বাইরের পৃথিবী থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, রুদ্ধ সেই কাশ্মিরে এমনকি চিঠিপত্রের আসা-যাওয়াও ছিল বন্ধ। একে একে হত্যা করা হয় রিজওয়ানের সকল স্বজনকে। নাটকের সরল বয়ান পরিণত হয় যৌগিক অধিবাস্তবতার জগতে বিচ্ছিন্ন সূত্রের চিন্তনীয় উপাখ্যানে, যেখানে লড়াই করে যায় রিজওয়ান একাই।
নাটকে এমন এক ভূখণ্ডের কথা বলা হয় যেখানে চাওয়া, পাওয়া, সুখ, দুঃখ, স্বপ্ন, স্মৃতি, মিলন, বিচ্ছেদের তীব্রতম প্রয়োগ দর্শকের হৃদস্পন্দনে অনুরণন ঘটায় বহুমাত্রিক পাটাতনে। পৃথিবী জুড়েই সহিংসতা ও নির্মমতা ফ্রাংকেনস্টাইনের মতো মনুষ্যত্বহীন আধিপত্যকামী বর্বরদের দ্বারা আপাত ক্ষমতাহীনের উপর প্রয়োগ হয়। যদিও আপাত ক্ষমতাবান এই পশু ক্ষমতাহীন হয়ে যায় যখন রিজওয়ানের বোন ফাতিমা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে ধর্ষণ নয় বরং ভীষণ ঠাণ্ডায় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। চরিত্ররা নিজেদের হত্যার শিকার নয়, ভাবতে শুরু করেন অন্য কোনভাবে মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়ার অল্টারনেটিভ ফ্যাক্টে।
‘সুদূর পাহাড় দিয়ে…’ গানের দ্বারা সদ্যোজাত শিশু রিজওয়ানকে ঘিরে মাতৃপ্রেম – স্বপ্নালু প্রত্যাশা – ভবিষ্যতের আবাহন নব আকাঙ্ক্ষাকে ইঙ্গিত করে। কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষার প্রতীক রিজওয়ান, তার পরিবারের সদস্যদের একের পর এক খুন সহ্য করতে পারে না। তাই সে লাশগুলো লুকিয়ে রাখে। কিন্তু রাষ্ট্রের সহিংস বাহিনী সবাইকে হত্যার দায় রিজওয়ানের উপরেই চাপিয়ে দেয়।
মঞ্চ পরিকল্পনায় ছিল অভিনবত্ব। মিলনায়তনের বিভিন্ন তল ব্যবহৃত হয়েছে আশ্চর্য দক্ষতায়। দর্শকের মাথার উপর দু’টি পাটাতন তৈরি হয় যেখানে রিজওয়ান ও ফাতিমা একে অপরের সাথে কথা বলে। প্রচলিত প্রবেশ-প্রস্থানের সুনির্দিষ্ট ছক ভেঙ্গে অভিনেতা কখনও উপর থেকে দড়ি বেয়ে নেমে আসে, কখনও কিক স্কুটার নিয়ে, কখনও মই বেয়ে। আলো ও রঙের ব্যবহার নাটকে চমৎকার লেগেছে। আলো দিয়ে তৈরি হয়েছে বিষন্নতা, উচ্ছ্বাস কিংবা প্রস্থানের বেদনা। আলোর জাদুতে মূর্ত হয়ে উঠেছে মৃত্যুনদীর গভীরতা।
রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন থেকে অসহায়, দুর্বলের উপর সহিংসতা, নির্মমতা আজ বিশ্বজুড়ে সহজ সত্য। ইতিহাসের এই পঙ্কিলতা রিজওয়ান নাটকে নান্দনিক আবহে মূর্ত। ‘এ দুনিয়ায় যদি কোন জান্নাত থেকে থাকে তবে সে জান্নাত এই মাটিতে, এই মাটিতে, এই মাটিতে’ এই সংলাপ তো পীড়িতের যন্ত্রণাদগ্ধ হয়ে স্বদেশ, মাটির প্রতি ভালবাসারই আর্তনাদ। চাকমা ভাষায় সংলাপটির রূপান্তর বাংলাদেশের নৃ-গোষ্ঠীদের বঞ্চনার প্রতি ইঙ্গিত করলেও পুরো নাটকের মধ্যে এটিকে বিচ্ছিন্নই মনে হয়েছে।
নির্দেশক খুব সতর্কতার সাথে তাল ও লয়ের ব্যবহার করেছেন। ডাকপিয়ন মাঝির আগমন, লাশ বহন, মৃত্যুকে অবজ্ঞা করে ফিরে আসা, দড়ি বেয়ে মৃতের ঊর্ধ্বে গমনসহ নানা ক্ষেত্রে তাল-লয়ের ব্যবহার ছিল অসাধারণ। দুয়েক জায়গায় অবশ্য আবহসংগীত খানিকটা অযাচিত বলেও মনে হয়েছে।
অসংখ্য কিউ, নাটকীয় মুহূর্ত, ঘটনার ত্বরিত পরম্পরা, প্রপস, কস্টিউম দ্রুত বদলের মাঝে অভিনেতাদের নৈপুণ্য প্রদর্শণ ছিল নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং। রিজওয়ানের বাধার মাঝেও পরিবারের একের পর এক সদস্য মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অমোঘ পরিণতি সে ঠেকাতে পারছে না! দৃশ্যকাব্যের এক অতুলনীয় ইমেজ নির্দেশক এখানে তুলে ধরেছেন। আহ সে কি দৃশ্য! মৃত্যুপানে ধাবিত মায়ের সাথে রিজওয়ানের কথোপকথন অনুপম এক অভিজ্ঞতা। এ দৃশ্য সকল দেশের, সকল কালের, সকল ধর্মের।
রিজওয়ান, অসামান্য পরিশ্রমী প্রযোজনা। রিজওয়ান, ফাতিমা, মা, ডাকপিয়ন, দাদাসহ অন্য চরিত্রে অভিনেতারা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টাটুকু করেছেন। রিজওয়ান চরিত্রে তিতাস জিয়ার অভিনয় ছিল অনবদ্য। ফাতিমা চরিত্রে মোহসিনাও ভালো করেছেন। তবে এ কথাও সত্যি কখনও কখনও অবশ্য মনে হয়েছে চমৎকার, অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা তিলে তিলে গড়ে তোলা প্রযোজনার চরিত্রায়নে খানিক হোঁচটই খেয়েছে, হাসপাতালের দৃশ্যের অভিনয় একটু ভিন্ন ঢঙে নির্মিত হয়েছে এবং এই দৃশ্যটি সম্ভবত পুরো নাটকের সাথে এক ধরণের দূরত্ব তৈরি করেছে যা খানিক বেখাপ্পা।
রিজওয়ান একটি ঝকঝকে প্রযোজনা। ঢাকার মঞ্চের শরীর নিষ্ক্রিয় রেখে কেবল সংলাপের ফুলঝুরি ছোটানোর বহমানতা থেকে রিজওয়ান মুক্ত। ফলে প্রযোজনা হয়ে উঠেছে পারফরম্যাটিভ। আর সেখানেই রিজওয়ান অনন্য। কি ঘটছে- সেটার চেয়ে কিভাবে ঘটলো নির্দেশক সেই বিষয়ে জোর দিয়েছেন। চূড়ান্ত ফলে সৈয়দ জামিল আহমেদ দর্শকদের উপহার দিলেন নান্দনিকতার এক মহান দৃশ্যকাব্য। ষাটোর্ধ অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ নিজের রিজওয়ান দিয়ে আবারও প্রমাণ করলেন কেন তিনি সদা তরুণ, কেন তাঁকে ব্যতিক্রমী প্রতিভা বলা হয়। পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় বারবারই তিনি নিজের কাজের উপস্থাপন নতুন উচ্চতায় তুলে ধরেছেন। এই নির্মাণের জন্য মেধা, পরিশ্রম আর বিশ্বনাট্যের ঋদ্ধ গবেষণার অদ্ভুত মিথস্ক্রিয়া বোধকরি এদেশে এখন একমাত্র তাঁরই আছে।