কবি ও গীতিকার কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালির মনে এত বেশি প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় যে তার অন্যান্য পরিচয়গুলো প্রায়শই এই দুই পরিচয়ের আড়ালে হারিয়ে যায়। গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার বা প্রাবন্ধিক- তার অন্য কোনো পরিচয়ই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। হয়ত তাই আড়ালে ঢাকা পরে আছে তার চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টতাও।
অথচ তিনি কেবল চলচ্চিত্রের গীতিকার-সুরকার হিসেবেই নয়, পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। এমনকি অভিনয়ও করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলিম চিত্রপরিচালক। ১৯৩৪ সালে মুক্তি পাওয়া ধ্রুব চলচ্চিত্রটি সত্যেন্দ্র নাথ দে-র সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করেছিলেন তিনি। পরে কোলকাতায় আরো অসংখ্য চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। শুধু তাই নয়, বেঙ্গল টাইগার্স পিকচার্স নামের কোলকাতার প্রথম বাঙালি মুসলিমদের ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। অবশ্য ’৪২-র আন্দোলন, যুদ্ধ ও নজরুলের অসুস্থতার জন্য শেষ পর্যন্ত কোম্পানিটির কাজ আর এগোয়নি।
ঢাকার চলচ্চিত্রে নজরুলের প্রত্যক্ষ কোনো সক্রিয় ভূমিকা নেই। কারণ তার অসুস্থতা। ঢাকার বাংলা চলচ্চিত্র যাত্রা শুরু করে ১৯৫৬ সালে, মুখ ও মুখোশ-এর মাধ্যমে। পরে ১৯৫৭ সালে ঢাকায় এফডিসি প্রতিষ্ঠিত হলে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকার চলচ্চিত্র শিল্প যাত্রা শুরু করে। কিন্তু এর অনেক আগেই, ১৯৪২ সাল থেকেই নজরুল অসুস্থ হন।
কিন্তু তাই বলে ঢাকার চলচ্চিত্র নজরুলকে ভুলে যায়নি। দেশের জাতীয় কবি বলে কথা! তার সাহিত্যকর্ম থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৬টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
এগুলোর মধ্যে প্রথমটি নির্মাণ করেন খান আতাউর রহমান। নজরুলের পদ্মগোখরা গল্প থেকে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটির নাম সুখ–দুঃখ। চলচ্চিত্রটির নির্মাণকাজ অবশ্য শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতারও আগে। মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধের বছরে, ১৯৭১ সালে। আর স্বাধীন বাংলাদেশে নজরুলের কাহিনি থেকে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন মুস্তাফিজ। ১৯৭৬ সালে তিনি নির্মাণ করেন মায়ার বাঁধন, নজরুলের ওই একই গল্প থেকে।
নজরুলের কাহিনি থেকে প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র নির্মিত হয় এর প্রায় দেড় দশক পরে, আশির দশকের শেষ প্রান্তে এসে। নজরুলের জ্বিনের বাদশাহ গল্প থেকে একই নামের চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন সম্প্রতি প্রয়াত নায়করাজ রাজ্জাক। চলচ্চিত্রটিতে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন তার বড় ছেলে বাপ্পারাজ। বিপরীতে অভিনয় করেন রঞ্জিতা। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন এটিএম শামসুজ্জামান, খলিল, কল্পনা, আখতার হোসেন, অলকা সরকার, নারায়ণ চক্রবর্তী, আবুল খায়ের, আরিফুল হক প্রমুখ।
নজরুলের কাহিনি থেকে ঢাকার চতুর্থ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয় নতুন শতকে এসে। ২০০৪ সালে নজরুলের একই নামের গল্প থেকে মতিন রহমান নির্মাণ করেন রাক্ষুসী। চলচ্চিত্রটিতে রাক্ষুসী বড় বৌয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন রোজিনা। তার স্বামীর চরিত্রে ফেরদৌস এবং ছোট বৌয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন পূর্ণিমা।
পরের বছরই আবারও নজরুলের গল্প থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ২০০৫ সালে নজরুলের মেহের নেগার থেকে একই নামের চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। যৌথভাবে পরিচালনা করেন মুশফিকুর রহমান গুলজার ও মৌসুমী। আফগান যুবক ইউসুফ এবং কাশ্মীরের নারী মেহের নেগারের প্রেমের এই কাহিনিতে চরিত্র দুটিতে যথাক্রমে অভিনয় করেন ফেরদৌস ও মৌসুমী। অন্যান্যদের মধ্যে আরো অভিনয় করেন নাদের চৌধুরী, প্রবীর মিত্র, শহীদুল আলম সাচ্চু, ইরিন জামান প্রমুখ।
নির্মাতা গীতালি হাসান নজরুলের অতৃপ্ত কামনা গল্প থেকে প্রথমে নাটক তৈরি করেন। পরে ২০১৪ সালে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র প্রিয়া তুমি সুখী হও। চলচ্চিত্রটিতে নায়ক ফেরদৌসের বিপরীতে অভিনয় করেন নবাগতা শায়লা সাবি। আরো অভিনয় করেন সোহেল রানা, সুচরিতা, শহীদুল আলম সাচ্চু, শামস সুমন, আবু সাঈদ খান প্রমুখ।
এর বাইরেও নজরুলের লিচুচোর এবং খুকি ও কাঠবেড়ালি কবিতা দুটো থেকে শিশু একাডেমী থেকে দুটো শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে।