মুহূর্তদেরকে ধরে রাখে আলোকচিত্র। সাক্ষ্য দেয় ঘটনার। একান্ত আনন্দ-বেদনার, অসঙ্গতির কদাচ প্রাপ্তিরও। স্মৃতির ভাণ্ডারে থেকে যায় যেটি দাগ কাটে, হৃদয়ে। যার অভিঘাত রয়ে যায় ব্যক্তির জীবন কিংবা সমাজ, কখনো সখনো রাষ্ট্রেও। ‘একটি ছবি লাখো শব্দের চেয়ে শক্তিশালী’। মানুষের জীবন ও সমাজ বাস্তবতায় ‘ছবি’ আসলে এমন শক্তিশালী এক অবস্থানই তৈরি করেছে। প্রশ্ন আসতে পারে কেন, কিভাবে, কিসের নিরিখে ছবি কথা বলে জীবনের,সমাজের? কিভাবে একটি ছবি লাখো শব্দের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে? কিভাবে একটি আলোকচিত্র, জাগিয়ে তুলতে পারে মানবিকতার বোধ?
প্রথমেই ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের একটি ছবির গল্প। খুব বেশি দিন আগের ঘটনা না। ভূমধ্যসাগরের তীরে মুখ লুটিয়ে আছে তিন বছরের এক শিশু, আয়লান। নিষ্পাপ আয়লানের নিথর দেহের ছবি কাঁদিয়েছিলো বিশ্ব বিবেককে। বলেছিল যুদ্ধের নির্মমতা, অমানবিকতা। কালো হাফ প্যান্ট আর লাল শার্ট পরা শিশুটির মৃতদেহ পরিণত হয় যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার লাখো শরণার্থীর প্রতীকে। একটি ছবিই বলে দিয়েছিল শত সহস্র নিরুপায় শরণার্থীর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার মর্মন্তুদ কাহিনি। অথচ গত এক দশকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যায় যুদ্ধ নিয়ে কত শত শব্দ-বাক্য লেখা হয়েছে। সাগরের ওপারের সভ্যদের দেশের দরজা কিন্তু খোলেনি। আয়লানের এই ছবিটিই বিশ্ব মানবতাকে জাগিয়েছে। মানুষকে সোচ্চার করেছে। আশ্রয়ের খোঁজে থাকা হাতেগোনা শরণার্থীদের জন্য দ্বার উন্মোচিত হয়েছে সভ্যদের ইউরোপে।
এবার আসা যাক পৃথিবী বিখ্যাত আলোচিত আরেকটি আলোকচিত্রের কথায়, যে ছবিটি গত শতকের কুৎসিততম এক দুর্ভিক্ষের চিত্র তুলে ধরছিলো একটি ফ্রেমেই।
১৯৯৩ সালের মার্চের কোন একদিন। গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত, দুর্ভিক্ষে পীড়িত দক্ষিণ সুদান। ক্ষুধার জ্বালায় হামাগুড়ি দিয়ে জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা কেন্দ্রের দিকে এগোচ্ছিল একটি কন্যা শিশু। ছোট্ট দু’পায়ে আর একরত্তিও শক্তি ছিলো না যে আরেক কদম এগুবে। সেসময় কানাডীয় আলোকচিত্রী কেভিন কার্টার দেখেন একটি শকুন অনুসরণ করছে শিশুটিকে। আদিমতম এক লড়াইয়ের ছবি। কে জিতবে? শিশু না শকুন? সে ছবির জন্য কার্টার নিজে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন। ক্ষুধার্ত শিশুর এই অতি অমানবিক ছবি তোলার নৈতিকতা নিয়ে তুমুল সমালোচনা থাকলেও সে সময়ে সুদানের গৃহযুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা সারা বিশ্বে জানান দিয়েছিল এই ছবি।
চোখ ফেরানো যাক ৪৫ বছর আগের আরেকটি ছবির দিকে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ ভিয়েতনামে মার্কিন নাপাম বোমার ভয়াবহতা ফুটে উঠেছিল সে ছবিতে। সম্প্রতি ফেসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড নিয়েও গোল বাধিয়েছিল এই ছবি।
১৯৭২ সালের জুনের এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে ভয়ার্ত-নগ্ন শিশুদের। পেছনে অস্ত্র হাতে সেনা সদস্যরা। দূরে নাপামের ভয়াবহতা। ষাট ও সত্তর দশকে ভিয়েতনামে নিক্ষেপ করা মোট ৭০ লাখ টন মার্কিনি বোমা লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। রাসায়নিক বোমার বিষে ভিয়েতনামে হাজার হাজার শিশু বিকলাঙ্গ হিসেবে জন্ম নিয়েছিল। এই একটি ছবির ভিত্তিতেই ভিয়েতনামে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও যুদ্ধবিরোধী মত গড়ে উঠেছিলো মার্কিন মুল্লুকে। সাথে সোচ্চার হয়েছিলো লাখো মানুষ, বিশ্ব জুড়েই।
তাই একটি আলোকচিত্র যে জীবন ও সমাজের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতে পারে, মানুষের প্রতিরোধ, প্রতিবাদ কিংবা মানবিকতার ভাষা হয়ে উঠতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি ছবির অভিঘাত সমাজ ও জীবনের অনেক কিছুই পাল্টে দিতে পারে।
এবারে আসা যাক সাম্প্রতিকতম সময়ে। ভারি বৃষ্টিতে নাকাল রাজধানী ঢাকা। এ নিয়ে গত এক মাসে বিভিন্ন পত্রিকায় কয়েক হাজার শব্দ লেখা হয়েছে। কিন্তু ঢাকার জলজটের চিত্র একটি ছবিতেই বলে দিয়েছে একটি জাতীয় দৈনিক। নিজেদের প্রথম পাতার অর্ধেকটা জুড়ে একটি ছবি ছেপেই।
গত ১০০ বছরে, আবিষ্কারের পর থেকে প্রযুক্তির নানা বাঁক পেরিয়ে নানা ফর্মে ক্যামেরা এখন মানুষের হাতে হাতে। তাই সিলেটের দরিদ্র শিশু রাকিবকে চুরির দায়ে যখন পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়, তখন মোবাইলের ক্যামেরায় তোলা সেই ঘটনার ছবিই ভাইরাল হয়ে নিশ্চিত করে ঘাতকের শাস্তি। কোন গ্রামে প্রতিবন্ধী শিশুকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা কিংবা কোন নারীকে গাছে বেঁধে নির্যাতন করার ছবিই প্রতিবাদী করে তোলে মানুষকে। তথ্যের চেয়ে ছবিই মানুষকে জাগিয়ে তোলে।
ফটোগ্রাফি, বিশ্বের আন্তর্জাতিকতম ভাষা। যে ভাষা মানুষকে বার্তা দেয়, জাগিয়ে রাখে। আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফি দিবসের শুভেচ্ছা সকল জাগ্রত মানুষকে।