“The Prince of Dragonstone had never trusted him as he had trusted Arthur Dayne. Harrenhal had been proof of that. The year of the false spring. The memory was still bitter.”
– Ser Barristan Selmy
১ খর্বকায় মানব
দীর্ঘ দুই বছরের তীব্র শীত কয়েকমাস হলো একটু কমে এসেছে। বিবর্ণ রুক্ষ গাছপালায় একটু একটু করে সবুজ ফিরে আসছে। পুরো ওয়েস্টেরোসে সাড়া পড়ে গেছে আসন্ন উষ্ণ বসন্তের আগমনী শব্দে। সময়টা ২৮১ সাল। হ্যারেনহাল প্রাসাদের মালিকানা তখন হোয়েন্ট হাউজের হাতে। সে হাউজের লর্ড ওয়াল্টার হোয়েন্ট এক টুর্নামেন্টের ঘোষণা দিলো। তার কিশোরী মেয়ের জন্মতিথীতে দশ দিন ধরে এই টুর্নামেন্ট চলবে। দিকে দিকে সাড়া পড়ে গেল। লর্ড হোয়েন্ট যেমন ধনী তেমনই উদার। টুর্নামেন্টের পুরষ্কারের পরিমাণও আকর্ষণীয়। বিভিন্ন নামী-দামী হাউজের লর্ড আর পদবীপ্রাপ্ত নাইটরা হ্যারেনহালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। এতসব নামী-দামী যোদ্ধাদের মাঝে এক খর্বকায় অখ্যাত যুবক হ্যারেনহালে এসেছে। মনে আশা, টুর্নামেন্টে যে করেই হোক নাম লেখাতে হবে। তার পোশাক-আশাক অতো চকমকে না, হাতে অস্ত্র বলতে একটা তিনশলার বর্শা। টুর্নামেন্টের আগের রাত। প্রাসাদ থেকে একটু দূরে এক সরাইখানায় বেচারা খেতে বসেছে। আশেপাশের হৈ-হুল্লোড়ে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছে। চেনা-পরিচিতও কেউ নেই। হঠাৎ করেই তিনজন পনেরো-ষোল বছরের চ্যাংড়া ছোকরা এসে তাকে খোঁচাতে শুরু করলো। বয়সে এদের চেয়ে কিছুটা বড় হলেও হ্যাংলা-পাতলা, বেঁটে আর কাঁচুমাচু চেহারার লোকটাকে তারা রীতিমত হুমকি-ধামকি দিতে শুরু করলো। একজন তো জোরে ঠেলা দিয়ে তার হাতের বর্শাটি কেড়ে নিলো! সে বেচারা তিনজনের সাথে হাতাহাতিতে পারবে কেন? মাটিতে পড়ে গেল সে। ছোকরাগুলো তাকে আবারও মারতে উদ্যত হলো। আর তখনই সরাইখানার গুঞ্জন ছাপিয়ে চিৎকার করে উঠলো এক মেয়ের কণ্ঠ। “ঐ!! ছেড়ে দে ওকে!” থমকে গিয়ে তিনজনই পেছন ফিরে তাকায়। ভালমতো দেখার আগেই ওপর থেকে ঠাশ ঠাশ ঠাশ করে তিনজনের গালে বিদ্যুৎবেগে তিনটা চড় এসে পড়ে। হতভম্ব লোকটা তাকিয়ে দেখে ছিটকে সরে গেল তিনজনই। আর তাদের পেছন থেকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল ঢ্যাঙামতোন একটি মেয়ে। পরনে কালো চামড়ার ভারী পোশাক, উশকোখুশকো চুল, ঘাড়ের ওপর নেকড়ের ধূসর কেশর দেখলে মেয়েটাকেই বন্য নেকড়ে বলে ভ্রম হয়। মেয়েটির অন্য হাতে একটা খোলা তলোয়ার। লোকটাকে মাটি থেকে তুলতে তুলতেই সে তলোয়ারের চ্যাপ্টা দিকটা দিয়ে তিনজনের পিঠে সপাং সপাং করে কয়েক ঘা বসিয়ে দিলো। পড়িমড়ি করে পালিয়ে বাঁচলো ছোকরাগুলো।
খর্বকায় লোকটি মারামারিতে কিছুটা আহত হয়েছে। রক্ত পড়ছে। মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার সাথে চলো, রক্ত বন্ধ করতে হবে।”
সরাইখানা থেকে কিছুটা দূরেই অনেকগুলো তাঁবু টাঙানো। প্রতিটার সামনেই আলো জ্বলছে, আর কয়েকটির সামনে সশস্ত্র দারোয়ান। এরকমই একটি তাঁবুতে সোজা ঢুকে গেল মেয়েটি, তার পিছুপিছু লোকটা। আস্তে করে তাকে গদিতে বসিয়ে ভেজা কাপড় দিয়ে রক্ত পড়ার জায়গাটা চেপে ধরলো মেয়েটি, “এখানে জোরে চাপ দিয়ে ধরে রাখো কিছুক্ষণ। রক্ত বন্ধ হতে হবে।”
মুখের কথা শেষ হতে না হতেই তাঁবুর ভেতরে একটা পাগলা বাতাসের ঝটকা এসে ঢুকলো। সেইসাথে এলো বিশালদেহী গমগমে কণ্ঠস্বরের একজন লর্ড। পোশাক-আশাকে চলনে বলনে দাপুটে লর্ডকে দেখে আহত লোকটা জড়সড় হয়ে মেয়েটির কাছ থেকে সরে যেতে না যেতেই গমগমে স্বর গর্জে উঠলো, “লিয়ানা! কী শুনছি? কী হয়েছে আবার?”
লিয়ানা কাঁধ ঝাঁকিয়ে উড়িয়ে দিলো, “কিছুই হয়নি। এই লোকটাকে কয়েকটা ছোকরা মিলে শুধু শুধু মারছিল। আমি শুধু তাদেরকে মেরে ভাগিয়ে দিয়েছি। লোকটা ব্যথাও পেয়েছে তাই একটু সেবাশুশ্রুষা করছি।”
ব্র্যান্ডন এক ঝলক লোকটার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে থাকলো, “সবখানে তোর নাক গলানো লাগবে কেন? একটু বুঝেশুনে চলতে পারিস না? খালি যেখানে সেখানে মাথা গরম-”
ব্র্যান্ডনের কথা শেষ হবার আগেই লিয়ানা চোখ কপালে তুলে ফেললো, “আমি মাথা গরম করি? আমি? এ দেখি ভূতের মুখে রামনাম!”
এবারে ব্র্যান্ডনের কাঁধ ঝাঁকানোর পালা। এদের কথার মাঝেই লোকটা খেয়াল করলো তাঁবুতে ব্র্যান্ডনের পিছনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে কেউ একজন। সর্বশেষে এসে ঢুকলো কমবয়সী আরেকজন। তার আওয়াজে ব্র্যান্ডনও পিছু ফিরে দেখে যেন নতুন কাজ পেল, “নেড, বেনজেন। লিয়ানার কাণ্ড দ্যাখ। কোত্থেকে এই ব্যাটাকে ধরে এনে মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধছে!”
এতক্ষণ চুপ করে থাকা নেড শান্ত অথচ চাপাস্বরে বললো, “তুমি কি ক্র্যানোগম্যান?”
লোকটা মাথা ঝুঁকিয়ে ইতস্তত করে বললো, “জ্বি”।
নর্থ থেকে দক্ষিণে যেখানে ওয়েস্টেরোস ক্রমশ সরু হয়ে আসে সে জায়গাটাকে বলা হয় “দ্যা নেক”। হাজার হাজার বছর আগে চিলড্রেন অফ দ্যা ফরেস্টরা জাদুবিদ্যা ব্যবহার করে উত্তর আর দক্ষিণের স্থলভাগকে আলাদা করে দিতে চাইছিল। জাদুতে পুরোপুরি কাজ হয় নি, বরং নেক-এর জায়গাটা স্থল আর জলের মাঝামাঝি জলাবদ্ধ স্যাঁতস্যাঁতে একটা জায়গা হয়ে গেছে। চারপাশে ঘন জঙ্গল আর জলাবদ্ধ পরিবেশ। এই পরিবেশেই ক্র্যানোগম্যানরা থাকে, ভাসমান ছোট ছোট দ্বীপে কাঠ আর বাঁশ দিয়ে বাসা বানিয়ে। প্রতিকূল পরিবেশে থাকার কারণে তারা যথেষ্ট শক্তপোক্ত, হার-না-মানা স্বভাবের, আর শিকারে দক্ষ হয়ে থাকে। তাদেরই একজন এখন হ্যারেনহালের পাদদেশে স্টার্ক ছেলে-মেয়েদের তাঁবুতে বসে আছে। নেড এবারও শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো, “নাম কী তোমার?” আস্তে আস্তে উত্তর এলো, “আমি হাওল্যান্ড। রিড হাউজের লর্ডের ছেলে।”শুনে লিয়ানা বলে উঠলো, “বেশ তো! খুব ভাল হয়েছে। ব্যথা খুব বেশি নাকি? নইলে চলো, হ্যারেনহালের লর্ড হোয়েন্টের ফিস্টে যাই।”হ্যারেনহাল যাওয়ার পথে দেখা হয়ে গেল হাউজ মরমন্ট, হাউজ ম্যান্ডারলি, আর হাউজ ডাস্টিনের লর্ড আর নাইটদের সাথে। এরা সবাই নর্দার্ন লর্ড, স্টার্কদের অনুগত। হাওল্যান্ডের কাছে যদিও সবাই-ই নতুন, কিন্তু স্টার্কদের সাথে থাকায় এরাও তাকে উষ্ণতার সাথে বরণ করে নিল। পরিচয়পর্ব চলতে চলতেই হ্যারেনহাল এসে গেল। বিশাল ছাইরঙা কালচে প্রাসাদে ঢোকার মুখেই দেখা যায় সবচেয়ে উঁচু মিনারটি পুড়ে গেছে, তার অংশবিশেষ ভাঙা। হ্যারেনহালের ভেতরে যে কোন জায়গা থেকেই দেখা যায় এয়গন টারগারিয়েনের ড্রাগন ব্যালেরিয়ন দ্যা ড্রেড-এর সর্বনাশা কীর্তি। লর্ড হ্যারেনকে এই মিনারেই জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল ব্যালেরিয়ন। মানুষের দম্ভ আর অহমিকার পরিণতি ভস্মতেই হয়।
প্রাসাদের ভেতরের পরিবেশ যদিও উৎসবমুখর। আগামীকাল সকালেই শুরু হচ্ছে টুর্নামেন্ট। ভেতরে সাত রাজ্যের রথী-মহারথীরা বসে আছে। মূল টেবিলের লর্ড হোয়েন্টের পাশেই বসা রাজপুত্র রেয়গার টারগারিয়েন। স্টার্করা ঢুকতেই বিশালদেহী কালো চুল আর কালো চোখের একজন চওড়া হাসি মুখে ঝুলিয়ে এগিয়ে এলো।
“নেড!”
চুপচাপ নেডও হাসিমুখে সরব হয়ে উঠলো। “কী রে! কী খবর তোর? কখন এলি?”
পেছন থেকে হাওল্যান্ড প্রশ্নবোধক চোখে লিয়ানার দিকে তাকালো। মুখ চেপে লিয়ানা বললো, “রবার্ট।”
হাওল্যান্ড খেয়াল করলো কথা বলতে বলতেই রবার্ট আড়চোখে লিয়ানার দিকে বেশ কয়েকবার তাকালো।
মূল টেবিলে রেয়গার টারগারিয়েনের কাছাকাছিই বসে আছে রাজবধূ এলিয়া মার্টেল। এত দূরে থেকেও হাওল্যান্ড মনে মনে তার স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের তারিফ করলো। যেমন সুদর্শন রাজপুত্র, তেমনি অপরূপা তার স্ত্রী। ডর্নের শক্তিশালী মার্টেল হাউজের মেয়ে সে, যেই ডর্ন শত বছর ধরেও টারগারিয়েনদের পোষ মানে নি। সেই টেবিল থেকে আরেকটু কাছেই আরেকজন মেয়ে খিলখিল করে হাসছিল কিংসগার্ড আর্থার ডেইনের সাথে। এক পলক চোখাচোখি হতেই হাওল্যান্ড দুটো হার্টবিট মিস করলো। জীবনে বহু সুন্দরী দেখেছে হাওল্যান্ড, এই ডাইনিং হলেই রাজ্যের সেরা সেরা সুন্দরীদের মেলা বসে আছে। কিন্তু এই মেয়েটিকে দেখে তার অন্যরকম এক অনুভূতি হলো।
হ্যারেনহাল আসার পথে সে এক সুদীর্ঘ নদী পেরিয়ে এসেছিল। মেয়েটির কালো লম্বা চুল দেখে সেই নদীর কথাই মনে পড়ে গেল হাওল্যান্ডের। নিজের অজান্তেই আস্তে আস্তে মেয়েটির কাছাকাছি একটা টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। খেয়াল করলো মুক্তোঝরা হাসিতে ঝিকমিক করছে মেয়েটির বেগুনী দু’চোখ। আর্থার ডেইনের পাশেই আরেকজন কিংসগার্ড দাঁড়িয়ে তাদের সাথেই গল্পে মশগুল ছিল। খেয়াল করে নি হাওল্যান্ড, হঠাৎ পেছন থেকে এসে লিয়ানা বলে উঠলো, “কাকে দেখছ এমন করে?” আমতা আমতা করে হাওল্যান্ড, “না মানে, এই তো, তেমন কাউকে না-”। যদিও লিয়ানার চটপটে চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না, “বুঝেছি, আশারাকে দেখছো তো? ও হলো আর্থার ডেইনের ছোট বোন, প্রিন্সেস এলিয়ার সহচরী। ওদের পাশে স্যার ব্যারিস্টান সেলমি। তার নাম শুনেছো তো, নাকি?” শুনেছে মানে, হাওল্যান্ড চট করে আরেকবার ব্যারিস্টানকে দেখে নিলো। মাঝারি একহারা গড়নের সাদা পোশাকের কিংসগার্ড – এক হাত তলোয়ারের বাটে রাখা। গল্পে গুজবে মত্ত থাকলেও সদাপ্রস্তুত রাজপরিবারের প্রতিরক্ষায়। কিছুদিন আগেই রাজধানীর দক্ষিণের বন কিংসউডের দুর্বৃত্তদেরকে শক্ত হাতে দমন করেছে সে। সেই কীর্তির নানা ঘটনা নিয়ে আসার পথেই অনেকের মুখে গল্প শুনেছে হাওল্যান্ড। সেই অভিযানে টাইউইন ল্যানিস্টারের ছেলে জেইমি ল্যানিস্টারও অসাধারণ বীরত্ব দেখিয়েছে দুর্বৃত্তদের পরাজিত করতে।
একটু পরে খাওয়া-দাওয়ার মাঝেই গানবাজনা শুরু হলো। হাওল্যান্ডের চোখ একটু পরপর আশারাকে খোঁজে। দূর থেকে দেখলো নৃত্যরতদের মাঝে সেও আছে। সাদা পোশাকের ব্যারিস্টানের সাথে নাচছে। উচ্ছ্বল আশারা নজর কাড়ছিল সবারই। একটু পরে তার সাথে নাচতে এগিয়ে গেল গাঢ় লাল রঙের সাপের চামড়ার পোশাক পরা ওবেরিন মার্টেল, এলিয়া মার্টেলের ভাই। গ্রিফিন’স রুস্টের লর্ড জন কনিংটনও নেচেছিল তার সাথে। লিয়ানা বললো জন হচ্ছে রেয়গারের খুব কাছের বন্ধু, রেয়গার রাজা হলে হয়তো জনকে হ্যান্ড বানাবে। হাওল্যান্ডের পাশে বসা নেড প্রায় পুরোটা সময় চুপচাপ থাকলেও মাঝে মাঝে তার সাথে কথা বলছিল। হাওল্যান্ড নিজেও চুপচাপ স্বভাবের, তাই নেডের সাথে কথা বলতে ভাল লাগছিল। অন্যদিকে ব্র্যান্ডন পুরো নেডের উল্টো, জোরে জোরে হাসে, ঝড়ের মতো কথা বলে, আর কী কর্তৃত্বময় আত্মবিশ্বাস। আশেপাশের কাউকে কিছু বললে তার না শুনে উপায় নেই। কী মনে হলো তার, বলে বসলো নেডের উচিত গিয়ে এখন আশারার সাথে নাচা। বিব্রত নেড বারবার না করা সত্ত্বেও ব্র্যান্ডনের জেদ থামাতে পারলো না। শেষমেশ ব্র্যান্ডন নিজেই উঠে গিয়ে আশারার সাথে কথা বললো, “আমার ভাই নেড তোমার সাথে একটু নাচতে চাইছে। কিন্তু তুমি কীভাবে নাও বুঝতে না পেরে ওই দেখ, ওই টেবিলে বসে আছে। তুমি কি একটু নাচবে আমার ভাইটার সাথে?” ইতস্তত নেড উচ্ছ্বল আশারার সাথে তাল মিলিয়ে নাচার চেষ্টা করছে – দৃশ্যটা দেখার মতো ছিল। গান বাজনার ফাঁকেই রেয়গার নিজের হাতে বীণা তুলে নিল। সঙ্গীতের প্রতি তার আগ্রহ আছে, তার বীণা বাজানোর প্রশংসাও রাজ্যময় ছড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। তাই সে গাওয়া শুরু করলে এমনি এমনিই পুরো হলে নীরবতা নেমে এলো। আর কী গাইলো রেয়গার! ভরাট কিন্তু কোমল কণ্ঠে এক বিষাদমাখা প্রেমের গান গাইলো সে। চারপাশে আলো-আঁধারিতে এক মোহাচ্ছন্ন পরিবেশ। হাওল্যান্ড খেয়াল করলো লিয়ানা চুপ হয়ে গান শুনছে। গানের গল্পে বিভোর লিয়ানার অজান্তেই তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। প্রেমিকের মৃত্যুর খবর প্রেমিকা জানতে পারে না – এই লাইনে এসে লিয়ানা কিছুটা ফুঁপিয়ে উঠলো। গান শেষে করতালিতে চমক ভাঙলো তার। তাড়াতাড়ি নিজের চোখের জল এড়াতে চেষ্টা করলো সে। হাওল্যান্ড পাশ থেকে একটা রুমাল এগিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু বিধি বাম। লিয়ানাকে কাঁদতে দেখে ফেললো ব্র্যান্ডন। আর যায় কোথায়, ব্র্যান্ডনের হাসি আর থামে না, “এই গান শুনে তুই ছিচকাঁদুনেদের মতো কাঁদছিস কেন রে?” লিয়ানা স্বভাবতই বিরক্ত, পারলে ব্র্যান্ডনকে মেরে বসে। কিন্তু এর মাঝে হাওল্যান্ডের চোখে পড়ল তাদের থেকে কয়েকটা টেবিল দূরে সেই তিন বদমাশ ছোকরাকে। তিনজনই নাইটের ফাইফরমাশ খাটছে। আস্তে করে লিয়ানাকে ইশারায় দেখালো, লিয়ানাও দেখে নাইটগুলোর হাউজ চিনতে পারলো। তাড়াতাড়ি ব্র্যান্ডন, নেড আর বেনজেনকে ডেকে আগের ঘটনা খুলে বললো। সব কথা শুনে বেনজেন হাওল্যান্ডকে তার ঘোড়া আর অস্ত্র দিতে প্রস্তুত, কালকেই এই তিন নাইটকে চ্যালেঞ্জ করে অন্যায়ের বদলা নিতে বললো। হঠাৎ এসব দেখে হাওল্যান্ড একটু ঘাবড়েই গেল। সে তো আর কোন নাইট না, সাধারণ এক হাউজের সাধারণ এক ক্র্যানোগম্যান। সে কি আদৌ পারবে লড়াইয়ে? তাও একেবারে পুরোদস্তুর নাইট, একজন না, তিন তিনজন। আগুপিছু ভেবে সে পিছিয়ে গেল। বললো, “থাক, যা হয়েছে হয়েছে। এত ঝামেলা করার দরকার নেই।”উৎসব শেষে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে তারা নিজেদের তাঁবুর দিকে ফিরে যাচ্ছিল। নেড বরাবরের মতোই চুপচাপ। ব্র্যান্ডন মদ খেয়ে কিছুটা অসংলগ্ন – হেঁড়ে গলায় গান গাওয়ার চেষ্টা করছে। বেনজেন আর লিয়ানার পাশে হাওল্যান্ড হাঁটছে। লিয়ানার স্বভাব-বিরুদ্ধ নিশ্চুপতা দেখে হাওল্যান্ডই কথা বলতে শুরু করলো, “আসলে এদেরকে হারিয়ে তো কোন লাভ নেই। যা হওয়ার হয়ে গেছে, তুমিই ঐ তিন ছোকরাকে ভালমতো শাসিয়ে দিয়েছ।”লিয়ানা বললো, “না, যা হয়েছে তা ঠিক হয়নি। এই তিন ছোকরা এখন ফাই-ফরমাস খাটছে, কিছুদিন পরে তারা নাইট হয়ে যাবে। একজন নাইট কখনো দুর্বলকে আঘাত করে না। তার আত্মসম্মানবোধ হতে হয় আদর্শ, দৃষ্টান্ত দেয়ার মতো। এরা এখন শক্তভাবে সেটা না শিখলে পরে এদের হাতে অনেক নিরাপরাধ মানুষ তোমার চেয়েও বেশি আক্রান্ত হবে। এটা অন্যায়!” লিয়ানাকে এতটা উত্তেজিত দেখে হাওল্যান্ড আর কিছু বলার সাহস পেলো না। তাঁবুগুলোর কাছে গেলে নেড তাকে বললো, তুমি আমার তাঁবুতে থাকতে পারো, বিছানা বানিয়ে দেয়া যাবে তোমাকে। ঘুমানোর আগে নেড খেয়াল করলো হাওল্যান্ড বিছানার পাশে মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে প্রার্থনা করছে।
“You never knew Lyanna as I did, Robert. You saw her beauty, but not the iron underneath”
– Eddard Stark (A Game of Thrones)
২ রহস্যময় নাইট
পরের দিন সকালে শুরু হয়ে গেল হ্যারেনহালের টুর্নামেন্ট। বিশাল বড় মঞ্চের মাঝে বসে আছে রাজা এয়রিস টারগারিয়েন, তার পাশে রাজ্যের ওয়ার্ডেনরা আর প্রধান হাউজের লর্ডরা বসেছে। এদের পরেই রাজবধূ ও লেডিদের বসার জায়গা। রাজপুত্র স্বয়ং টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছে, তাই রাজার পাশে তার আসনটা খালি। জনগণের সাধারণ গ্যালারি মাঠের উল্টোপাশে। সেখান থেকে তারা রাজপুত্রকে দেখা মাত্রই সজোর উল্লাসে ফেটে পড়ছে পুরো দর্শকগ্যালারি। প্রতিটি লড়াইয়ের বিস্তারিত বর্ণনায় যাবো না। তবে দুটো বিশেষ ঘটনা উল্লেখ না করলেই না।
যে তিনজন নাইটের স্কয়ারেরা হাওল্যান্ড রিডকে আঘাত করেছিল, তারা প্রত্যেকেই প্রথম দুইদিনের লড়াইয়ে জিতেছিল। দ্বিতীয় দিন বিকেলের দিকে এক রহস্যময় নাইটের আবির্ভাব হলো প্রতিযোগিতার মাঠে। আকারে হ্যাংলা-পাতলা, মুখ শিরোস্ত্রাণে ঢাকা, পরনের বর্ম দেখে মনে হচ্ছে অন্য কারোটা নিয়েছে। জোড়াতালি দিয়ে বেখাপ্পা সাজের নাইটের বুকের ওপর চকচকে বর্মে একটা সাদা ওয়্যারউড ট্রি-এর ছবি আঁকা। গাছটার কাণ্ডে লাল কালিতে হাসিমুখের ছবি। মাঠে এসে এই নাইট সে তিনজন নাইটকে চ্যালেঞ্জ করে বসলো। এক এক করে তিনজনই এর হাতে পরাজিত হলো। দর্শক ততক্ষণে মজা পেয়ে গেছে। প্রথম জন ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার পর সবাই বলাবলি করতে শুরু করলো যে কে এই রহস্যময় নাইট? এমন হালকা পাতলা গড়নের কেউ নাইট হয় কীভাবে, আর সেই নাইট এমন বড়সড় আকারের কোন নাইটকে ঘোড়াচ্যুতি করায় কীভাবে! দুর্ধর্ষ তার কৌশল। একরোখা তার অধ্যবসায়। স্তিমিত বিকেলের আলোয় তার তিন তিনবার জয় পুরো গ্যালারিকে উজ্জীবিত করে দিল। সম্ভ্রান্তদের গ্যালারিতেও তখন গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে এই নাইটের পরিচয় নিয়ে। খেলা শেষে রবার্ট ব্যারাথিয়ন তন্ন তন্ন করে তাকে খুঁজতে লাগলো, আজ এর পরিচয় বের করেই ছাড়বে! এদিকে লড়াই শেষে হাসিগেছো নাইট পরাজিত তিন নাইটের সব বর্মটর্ম আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিয়েছে। তারা যখন টাকার বিনিময়ে সেগুলো ফেরত আনতে গেল তখন সে টাকা না নিয়ে বললো, “সব ফেরত পাবে। শর্ত একটাই- তোমাদের স্কয়ারদের সভ্যতা শেখাও, এরা উদ্ধত আর দুর্বলের ওপর অত্যাচার করে। এদেরকে শায়েস্তা করে বিনয়ী ও ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা দাও, তাহলেই হবে।”তারা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই রবার্ট ব্যারাথিয়ন এসে হাজির, কিন্তু ততক্ষণে রহস্যময় এই নাইট লাপাত্তা! এমনকি রাজা এয়রিসও সৈন্য দিয়ে খুঁজে তার আর কোন হদিস পেলো না। পরদিন থেকে টুর্নামেন্ট জুড়েই রহস্যকে পুঁজি করে গুজবের মুক্তো ফলে চললো। তার নাম হয়ে গেল “The Knight of the Laughing Tree”।
সব লড়াই যুদ্ধ শেষে চূড়ান্ত লড়াইয়ে মুখোমুখি হলো রাজপুত্র রেয়গার টারগারিয়েন আর কিংসগার্ড স্যার ব্যারিস্টান সেলমি। রেয়গার সাধারণত টুর্নামেন্টে অংশ নেয় না, এবার তাই তার চূড়ান্ত লড়াইয়ে আসাতে অনেকেই অবাক হয়েছে। বাঘা বাঘা সব নাইটকে হারিয়েছে সে, যাদের মধ্যে তিনজনই ছিল কিংসগার্ডের সদস্য। ফাইনালেও আরেক কিংসগার্ড, স্যার ব্যারিস্টান, যাকে পুরো সাত রাজ্যের মধ্যে সেরা লড়িয়ে বলে গণ্য করা হয়। তলোয়ারে তো বটেই, টুর্নামেন্টের লড়াইয়ে ব্যবহৃত বল্লমেও সে দুর্দান্ত। গত দশদিন ধরেই তার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারে নি। দর্শকদের মাঝে তাই চাপা উদ্বেগ, বেশিরভাগের সমর্থন রেয়গারের দিকে কিন্তু ব্যারিস্টান অপ্রতিরোধ্য। মাঠের দুই প্রান্ত থেকে দৌড় শুরু করলো রেয়গার আর ব্যারিস্টান। ঠিক মাঝখানে এয়রিসের মঞ্চ বরাবর এসে প্রচণ্ড বেগে একে অপরকে বল্লম দিয়ে আঘাত করলো। ব্যারিস্টান বল্লম সোজা রেয়গারের বুকের দিকে তাক করে রেখেছিল। রেয়গারের হাতের বল্লমটা সোজা ছিল না, কিছুটা বাঁকা করে ধরা ছিল। ব্যারিস্টানের বল্লম এড়াতে সে ক্ষীপ্রগতিতে ঘুরে গেল, আর সাথে সাথে শক্ত করে তার হাতে ধরা বল্লমটা ব্যারিস্টানের বুকের দিকে তাক হয়ে গেল। এক ধাক্কায় ছিটকে ঘোড়া থেকে পড়ে গেল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ নাইট। আর পুরো গ্যালারি বোমার মত ফেটে পড়লো উল্লাসে! সম্ভ্রান্তদের মাঝেও এই প্রথম দেখা গেল উল্লাসের তীব্রতা সাধারণ দর্শকদের মতই বাঁধভাঙা। রেয়গার টারগারিয়েন টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন! বিজয়ী!!
সবাই উল্লাসে ফেটে পড়লেও একজনের মুখে হাসি নেই। রাজা এয়রিস টারগারিয়েন। ভ্রূ কুঁচকে রেয়গারের দিকে তাকিয়ে রইল রাজা। গত কয়েক মাস ধরে যে সন্দেহের বীজ তার মনে অঙ্কুরিত হয়েছিল আজ যেন সেই বীজ থেকে এক ধাক্কায় এক মহীরুহের মতো বিষবৃক্ষ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।ডাস্কেনডেলের সেই বিদ্রোহের সময় থেকেই এয়রিসের মনে নিজের ছেলেকে নিয়ে সন্দেহ প্রথম দানা বাঁধতে শুরু করে। তার ধারণা হয় রেয়গার পদে পদে তাকে মেরে সিংহাসন দখলের চেষ্টা করছে। ডাস্কিনডেলেও তাকে ছাড়াতে যায় নি, নির্যাতিত হতে দিয়েছিল। এখন সে বেঁচে ফিরেছে বলে রেয়গারের চেষ্টার কমতি থাকবে না। মুক্তি পাবার পর থেকে এয়রিস রেড কিপ প্রাসাদে মোটামুটি স্বেচ্ছাবন্দী। তাকে কেউ ছুঁতে পারতো না, কাছে আসা নিষেধ ছিল বলে চুল দাড়ি নখ লম্বা হতে হতে রীতিমত উচ্ছৃঙ্খল অবস্থা। একদিকে তার সন্দেহপ্রবণতা বেড়েছে, অন্যদিকে ওয়াইল্ডফায়ার নিয়ে আগ্রহ বাড়তে বাড়তে অসুস্থ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তার চারপাশে চাটুকার আর সুবিধাবাদীরা ভিড় করেছে, যদি রেয়গারের নামে কান ভারি করে কোন সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেয়া যায় সে আশায়। এদিকে রেয়গারের সমর্থকেরাও রাজসভায় ছিল। রাজার ক্রমশ উন্মাদ হয়ে ওঠাকে কেউই ভালভাবে নেয় নি। অনেকেই রাজ্যের ও রাজকার্যের খামখেয়ালিপনা দেখে ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কাবোধ করছিলো। রেয়গার ও টাইউইন যেভাবে ডাস্কেনডেলের বিদ্রোহ দমন করেছে সেটাতেই অনেকের মনে রেয়গার ভবিষ্যতের উপযুক্ত রাজা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। এখন কবে সেই ভবিষ্যৎ আসবে সেটাই চিন্তার বিষয়। অনেকে বলে রেয়গারও চাইছিল বাপকে সরিয়ে সিংহাসনে বসতে। রাজসভার তার অনুপস্থিতিতে নিন্দা করে বাপের মন বিষানোর লোকের অভাব নেই এটাও সে জানতো। কিন্তু সে সরাসরি সভাসদ বা অন্যান্য লর্ডদের সাথে যোগসাজশ করেছে কিনা তার নিশ্চিত কোন প্রমাণ নেই। ভ্যারিসের গুপ্তচরেরাও তেমন কিছু জানতে পারে নি। এয়রিস তবুও নিশ্চিন্ত হতে পারে না। ড্রাগনস্টোনে বসে রেয়গার কী করছে? টাইউইনের সাথে কি তার এখনও যোগাযোগ আছে? বিয়েও করেছে ডর্নের এক ‘বিদেশি‘মেয়েকে।(এয়রিসের কাছে ডর্ন প্রকারান্তরে বিদেশিই ছিল। টারগারিয়েনরা সাধারণত নিজেদের ভাই-বোন বা কাজিনদের মধ্যেই বিয়েশাদী করতো।) কে জানে, হয়তো চিরকালের অবাধ্য ডর্ন আবারও চাইছে তাকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দিতে?এসব হাজারও সন্দেহের বিষে নাজেহাল এয়রিসের পুরো রাগটা গিয়ে পড়তো হ্যান্ড টাইউইনের ওপর। তাকে শায়েস্তা করার জন্য তার ছেলে জেইমিকে কিংসগার্ড বানানোর ঘোষণা দিল সে। এর পরপরই ক্ষুব্ধ টাইউইন হ্যান্ডের পদ স্বেচ্ছায় ছেড়ে চলে গেল। এয়রিস কিছুদিন বেশ আত্মতৃপ্তিতে কাটালেও অচিরেই সেই আত্মতৃপ্তি নতুন সন্দেহে পরিণত হলো। সেধে সেধে জেইমিকে তো কিংসগার্ড বানালাম, এখন সে যে গুপ্তচর না সেটা কীভাবে নিশ্চিত হবো? সারাক্ষণ আমার চারপাশে পাহারা দিচ্ছে, যদি রাতের আঁধারে আমাকে খুন করে? টাইউইন কি এর কাছে চিঠি পাঠায়? জব্দ করো সেই চিঠি! আমি পড়ে দেখব!সন্দেহবাতিকের চোটে সুযোগ পেলেই এয়রিস জেইমিকে বিভিন্ন অভিযানে পাঠাতে লাগলো। তারই একটা অভিযান ছিল কিংসউডের দুর্বৃত্ত দমন। সেখানে জেইমির বীরত্বের খবরে এয়রিস আবারও মুখ ফোলালো।
বসন্তের আভাস পেতেই যখন হ্যারেনহালের লর্ড ওয়াল্টার হোয়েন্ট টুর্নামেন্টের ঘোষণা দিয়ে রাজাকে নেমন্তন্ন করলো, তখন প্রথমে এয়রিস না করে দিল। রেড কিপ ছেড়ে বেরোবার প্রশ্নই আসে না! কিন্তু ভ্যারিস তাকে জানালো যে ওয়াল্টার হোয়েন্টের ভাই কিংসগার্ডের সদস্য স্যার অসওয়েল হোয়েন্ট কিছুদিন আগে তার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে হ্যারেনহাল গিয়েছিল। অসওয়েল আবার রেয়গারের বন্ধুমানুষ। তাহলে কি রেয়গারই এই টুর্নামেন্টের আয়োজন করছে না তো? সেখানে পুরো সাম্রাজ্যের সব লর্ডরা আসবে, রেয়গার সে সুযোগে সবাইকে এয়রিসের বিরুদ্ধে একাট্টা করবে না তো? সাথে সাথে সিদ্ধান্ত বদল। রাজা টুর্নামেন্টে যাবে। খবরটা চাউর হতেই তোড়জোড় আরো বেড়ে গেল। এত বছর পর রাজা জনসমক্ষে আসবে। সাত রাজ্যের যত বড় লর্ড আর ব্যানারম্যানরা আছে, সবাই এসে পড়বে। এলো না শুধু টাইউইন ল্যানিস্টার। ওয়েস্টারল্যান্ডের অন্যান্য ল্যানিস্টার ব্যানারম্যানরা এসেছে জেইমির লড়াই দেখবে বলে। এয়রিস তাতেও পানি ঢেলে দিল। সে জেইমির প্রতি এতটাই সন্দিহান যে টুর্নামেন্টের প্রথম দিন সকালে তাকে নাইট বানানোর পরেই নির্দেশ দিল রেড কিপে ফিরে যেতে। ওখানে রাণী ও ছোট ছেলে ভাইসেরিস আছে, তাদের প্রতিরক্ষার জন্য। টুর্নামেন্টের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত জেইমির জন্য এটা ছিল ধাক্কার মতো। হতাশ আর ভগ্নমনোরথ জেইমি কিংস ল্যান্ডিংয়ে ফিরে গেল। এয়রিসের সন্দেহের তবু যেন শেষ নেই। নাইট অফ স্মাইলিং ট্রি-কে দেখেও তার মনে হয়েছে এটা নিশ্চয়ই জেইমি। রাজার আদেশ অমান্য করে এখন মুখ ঢেকে টুর্নামেন্টে লড়াই করছে। তাকে ধরতেই সে সৈন্য পাঠিয়েছিল সে রাতেই, কিন্তু ততক্ষণে সেই রহস্যময় নাইট পুরোপুরি গায়েব হয়ে গেছে। জ্ঞানী গুণী মেয়স্টাররা আন্দাজ করতে পারেন কে ছিল সেই নাইট অফ দ্যা স্মাইলিং ট্রি। টুর্নামেন্টের আগের দিনের ঘটনাবলী বিচার করলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। তাকে নিয়ে বিস্তর গানও লেখা হয়েছে। কিন্তু সেসব কেবলই কবিমনের কল্পনা। তার আসল পরিচয় কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
৩ নীল গোলাপ
টুর্নামেন্ট শেষে রেয়গার চ্যাম্পিয়ন হলো। এসব টুর্নামেন্টের নিয়ম হলো শুরুতে একজন সম্ভ্রান্তবংশীয় নারীকে ‘প্রেম ও সৌন্দর্যের রাণী’উপাধিতে ভূষিত করা হবে। তিনি টুর্নামেন্টে তার হয়ে লড়াই করবে এমন কয়েকজন লর্ড ও নাইটদের নির্বাচন করবেন। অন্যদিকে অন্য লর্ড ও নাইটরা উপাধিটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবে। যদি এই ‘রাণী’র চ্যাম্পিয়নরা কেউ জিতে যায়, তাহলে তিনিই থাকবেন পুরো টুর্নামেন্টের প্রেম ও সৌন্দর্যের রাণী। আর যদি তার চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে অন্য কেউ চ্যাম্পিয়ন হয় তাহলে সে নতুন ‘রাণী’কে নির্বাচন করতে পারবে। হ্যারেনহালের টুর্নামেন্টের শুরুতে প্রেম ও সৌন্দর্যের রাণী হয়েছিল লর্ড হোয়েন্টের কুমারী কন্যা, যার জন্মতিথীর উদযাপনেই এতো আয়োজন। তার চ্যাম্পিয়নদের মধ্যে ব্যারিস্টান চূড়ান্ত লড়াইয়ে ছিল, আর চ্যালেঞ্জার হিসেবে ছিল রেয়গার। সুনিপুণ দক্ষতায় ব্যারিস্টান হেরে গেলে রেয়গারের হাতে এসে পড়ে ‘রাণী’নির্বাচনের সুযোগ। চারপাশে মানুষের উল্লাস উচ্ছ্বাস, সম্ভ্রান্তরাও অনেকে স্থান কাল পদবি ভুলে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছেন রাজ্যের রাজপুত্রকে। রেয়গারের ঘোড়া আস্তে আস্তে মূল মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল। মাঝখানে চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে রাজা এয়রিস। তার কয়েকটি আসন পরেই রাজবধূ এলিয়া মার্টেল। রেয়গারের লম্বা বল্লমের মাথায় একটি নীল গোলাপের মুকুট। সবাইকে অবাক করে দিয়ে রেয়গার নিজ স্ত্রীকে পেরিয়ে মঞ্চ থেকে দূরে সরে গেল। শিরোস্ত্রাণের ভেতর দিয়ে তার চোখ আরেকজোড়া চোখকে খুঁজছে। বিশালদেহী চওড়া চোয়ালের লর্ডটির পাশে সে খুঁজে পেল অভীষ্ট নারীকে। উজ্জ্বল তামাটে বর্ণের মুখে বিকেলের সোনারঙা সূর্যের আলোয় তাকে দেখে রেয়গারের মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম বন্য ভয়ঙ্কর সুন্দর মুখ সেটি। চারপাশের হাততালি থেমে গিয়ে তখন গ্যালারিতে পিনপতন নীরবতা। রেয়গারের বল্লমের মাথায় ধরা নীল গোলাপের মুকুট আস্তে করে সেই নারীর মাথায় বসে গেল। হ্যারেনহাল টুর্নামেন্টের প্রেম ও সৌন্দর্যের রাণী লেডি লিয়ানা অফ হাউজ স্টার্ক!
এবারে শুরু হয়ে গেল মহাগুঞ্জন। রাগে থমথম করছে লিয়ানার পাশে বসা নেড স্টার্কের মুখ। অন্যপাশের বিশালদেহী চওড়া চোয়ালের ব্র্যান্ডন আর বসে থাকতে না পেরে উঠেই দাঁড়ালো। এদের কাছাকাছিই বসেছিল রবার্ট ব্যারাথিয়ন, লিয়ানার বাগদত্ত। বুদ্ধিমানের মতো সেখানে সবার সামনে ব্যাপারটাকে হেসে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানালো সে। বললো, “ঠিকই আছে। সৌন্দর্যের রাণী এতদিনে তার মুকুট পেলো!” কিন্তু যারা সেদিন রাতে তাকে দেখেছে, সেই রবার্টের মুখে ছিল চাপা ক্রোধ আর অপমানিতের ছায়া। সবার সামনে তার বাগদত্তাকে মুকুট পরানোর সাহস হয় কি করে রেয়গারের? রাজপুত্র হয়েছে বলে যা ইচ্ছা তাই করবে সে!একমাত্র লিয়ানার অনুভূতিই আমাদের জানা হয় না। নেডের সাথে লিয়ানা কথা বলেছিল হয়তো। হয়তো নীল গোলাপের মুকুট নিয়ে একান্তে তাঁবুতে বসে কতকিছুই না ভেবেছিল সে। দশ দিন আগে টুর্নামেন্ট শুরুর আগের রাতের ভোজের কথা মনে পড়েছিল হয়তো তার। সে রাতের সেই বিষাদমাখা বিরহের গান এখনো মনে আছে তার!
হ্যারেনহালের আসর ভাঙল। কিংস ল্যান্ডিংয়ে ফিরে গেল রাজা এয়রিস, সাথে তার সভাসদেরা। কিছুদিনের মধ্যেই বসন্তের উষ্ণ বাতাস থেমে আবারও ফিরে এলো শীতের রুক্ষ শীতল তুষার। দুই সপ্তাহের মধ্যেই কিংস ল্যান্ডিংয়ে তুষারপাত হলো, আর ব্ল্যাকওয়াটার রাশ নদীর পানি জমে বরফ হয়ে গেল। প্রাসাদ উষ্ণ রাখতে এয়রিস তার পাইরোম্যান্সারদের ওয়াইল্ডফায়ার জ্বালিয়ে রাখার নির্দেশ দিল। এলিয়া মার্টেল তার বাচ্চাদের নিয়ে ফিরে গেল ড্রাগনস্টোনে। শুধু হদিস মিললো না রেয়গার টারগারিয়েনের। কিংস ল্যান্ডিংয়ে নেই সে, ড্রাগনস্টোনেও না। কাউকে কিছু না বলে সাথে মাত্র জনাছয়েক অশ্বারোহী বন্ধুস্থানীয় নাইটকে নিয়ে সে উত্তরের দিকে রওনা দিয়েছে। হ্যারেনহাল থেকে মাত্র তিরিশ মাইল দূরে তার দেখা হয়ে গেল লিয়ানার সাথে। লিয়ানা কেনইবা সেখানে ছিল? হয়তো অপেক্ষা করছিল রেয়গারের জন্য? দেখা হবার পর তাদের মাঝে কী কী কথা হয়েছিল? এগুলোও আমাদের জানার উপায় নেই। আমরা শুধু জানি তাদের এই প্রেমের পরিপ্রেক্ষিতেই জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে টারগারিয়েনদের রাজত্ব। ওয়েস্টেরোসে তিনশ বছরের টারগারিয়েন শাসন শেষ হলো এক বসন্তের মিথ্যা আশ্বাসের ভেতর জন্মানো ভালোবাসার নীল ফুলে। সে ভালোবাসার পরিণতিতেই লাল রক্তভেজা মাতৃকোলে ফুটবে আরেকটি নীল ফুল, গোপনে, চুপিসারে, ভুল পরিচয়ে, ছদ্মবেশে। কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন ছদ্মবেশের আড়ালেও আমরা চিনে যাই প্রকৃত মানুষকে। কারণ খাঁটি মানুষের দ্যুতি লুকানো যায় না। ভুল পরিচয়ে ধীরে ধীরে শীতের রাজ্যের কোলে বড় হয়ে ওঠা কিশোর একদিন পুরো সাম্রাজ্যের একমাত্র সম্বল হয়ে উঠবে। সে গল্পের শেষ অঙ্ক এখনো অবগুণ্ঠনাবৃত।