রেল আবিষ্কার ও জনপ্রিয় হবার পরে ব্রিটিশ ভারতে আসতে তার খুব বেশিদিন দেরি হয়নি। সেই ১৮৫৩ সালেই অল্প কিছু দিনের ব্যবধানে কলকাতা ও বোম্বাইতে ট্রেন চালু হয়। ১৮৬২ সালে বর্তমান বাংলাদেশে প্রথম ট্রেন লাইন আসে কলকাতা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত, পরবর্তীতে যেটি গোয়ালন্দ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। ব্রিটিশদের মাঝে কিন্তু ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে সরাসরি রেল সংযোগের চিন্তা সবসময়ই ছিলো। প্রথম ১৮৫৬ সালে, কলকাতা থেকে সুন্দরবন হয়ে ঢাকা পর্যন্ত রেললাইনের প্রস্তাব করা হয়।। কিন্তু বিশাল পদ্মা নদীর জন্যে তা আর সম্ভব হয়নি।
শেষতক বেশ কিছুদিন পরে, ১৮৮৫ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় প্রথম রেল চালু হয় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লাইনে। ঐ বছরই আগস্টে সে লাইন বিস্তৃত হয় ময়মনসিংহ পর্যন্ত। নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত সে সময় স্টেশন ছিলো ১১ টি , (১) নারায়ণগঞ্জ (২) চাষাড়া (৩) দোলাইগঞ্জ (৪) ঢাকা (৫) কুর্মিটোলা (৬) টঙ্গি (৭) জয়দেবপুর (৮) রাজেন্দ্রপুর (৯) শ্রীপুর (১০) সাত খামাইর এবং (১১) কাওরাইদ। শুরুর বছর (১৮৮৫) জানুয়ারির ১ম সপ্তাহের পরীক্ষামূলক পরিচালনায় যাত্রী ছিল- ১ম শ্রেণি ১৭ জন, ২য় শ্রেণি ৩২ জন, ৩য় শ্রেণি ২,১২১ জন।
ঢাকায় রেল আরো আগে আসতো, সরাসরি সংযোগ না হলেও, স্টিমার ও ফেরি সার্ভিসের মাধ্যমে হয়তো বা নদী পারাপারের ব্যবস্থা করা হতো। কিন্তু ১৮৭০ এর দশকে উত্তরবঙ্গের দুর্ভিক্ষের জন্যে রেলওয়ে নির্মাণ পিছিয়ে যায়। তবে একই দশকে কলকাতায় ট্রাম কিন্তু ঠিকই বসানো হয়েছিলো। এরও প্রায় ২০ বছর পরে, ১৮৯০ সনে ঢাকা থেকে শিবালয় পর্যন্ত ট্রাম লাইন করার আরেকটি প্রস্তাব করা হয়, যার জন্যে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা খরচ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। তবে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় নি; আর ততদিনে ট্রেনও চালু হয়ে গিয়েছে।
ঢাকার প্রথম এবং প্রধান স্টেশনটি ছিলো ফুলবাড়িয়াতে, এবং সেটিই শহরের শেষ সীমানা তখন। এরপরে শুরু হতো ঢাকা ভার্সিটি এলাকা, নতুন শহর ও রমনার বাগান। ঢাকা তখন নেহায়েতই এক ছোট্ট মফস্বল, বাংলার রাজধানী নয়, তাই কলেবরে স্টেশনটিও ছিলো ছোট। একটি একতলা ভবন ও প্ল্যাটফর্ম নিয়েই তৈরি করা হয়েছিলো সেটি, তবে সাথে ছিলো একটি রেল ইয়ার্ডও। মূলত রেল সংযোগের একটি বড় কারণ ছিলো ময়মনসিংহ অঞ্চলের পাট উৎপাদন ক্ষেত্র ও নারায়ণগঞ্জের নদীবন্দরের মধ্যে একটি দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য যোগাযোগের ব্যবস্থা করা। তাই পরিকল্পনায় ফুলবাড়িয়া খুব বেশি গুরুত্ববহ ছিলো না, এবং শহরের যাতায়াত ব্যবস্থায় রেলের কথা তখন মাথায় রাখা হয়নি। তাই স্টেশনটি করা হয়েছিলো শহরের প্রায় বাইরেই। যাই হোক, এ স্টেশনে একটি বেশ উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, ১৯০৪ সালে ভাইসরয় লর্ড কার্জন রেলে চড়ে ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনে এসেছিলেন। পরে তাকে সেখানেই সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
স্টেশন যেখানে তৈরি হয়েছিলো, সেই ফুলবাড়িয়া এলাকাটি বেশ পুরনো, সেখানে হয়তো ছিলো ফুলের বাগান বা চাষ করা হতো ফুলের। শহরবাসীর পূজার জন্যে প্রয়োজন পড়তো ফুলের। আ কা মো যাকারিয়ার মতে, প্রতিটি শহর-নগর বা গ্রামেই পাওয়া যায় মালিবাগ, মালিটোলা, ফুলবাড়িয়া ইত্যাদি নামের স্থান। নাজির হোসেন, ম্যানরিকের বিবরণ (১৬৪০) ও ১৭৯০ সালের দলিলাদিতেও ফুলবাড়িয়া ও ফুলমণ্ডির উল্লেখ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তার মতে, হয়তো এখান থেকে ফুল সরবরাহও করা হতো বেশ কাছেই গান্ধি গলিতে, যেখানে তৈরি হতো সুগন্ধী ও আতর।
স্টেশনের দক্ষিণে জঙ্গল, বিশেষ করে বাঁশবাগান ও বাঁশের কুটির শিল্প ছিলো, তা জানা যায় আজিম-উশশানের বই থেকে, জায়গাটাকে বলা হতো বাঁশপট্টি। পাকিস্তান আমলেও উনি তা দেখেছেন, তবে বাঁশবাগান আর ছিলো না, বাঁশ আসতো ঢাকার বাইরে থেকে। ফুলবাড়িয়া মার্কেট ও নগরভবন হবার আগে পর্যন্তও সেখানে এই বাজারটি ছিলো। ফুলবাড়িয়া ছাড়াও বর্তমান নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ী যেখানে সেখানে আরেকটি ছোট স্টেশন ছিল, কাগজ-কলমে যার নাম ছিলো ঢাকেশ্বরী স্টেশন। সেখানে মনে হয় না খুব বেশি ট্রেন থামতো।
ষাটের দশকে স্টেশন ও রেললাইন দুই-ই শহরের বাইরে নিয়ে যাবার কাজ শুরু হয়। আবারো শহরের ভেতরে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় ট্রেনের ভূমিকাকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ১৯৬৯ সালে কমলাপুর স্টেশন চালু হয়ে যায়, ফুলবাড়িয়াতে কালক্রমে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল গড়ে তোলা হয়। আর রেলওয়ের জমি ক্রমেই বেহাত হতে থাকে, সরকারি-বেসরকারি উভয়ভাবে। বর্তমানে সে এলাকায় তৈরি হওয়া অধিকাংশ সরকারি স্থাপনাই রেলওয়ের জমির উপরে। এখন পুরনো রেলওয়ের কিছু লাল ইটের ভবন ও রেলওয়ে হাসপাতাল ছাড়া রেল স্টেশনের আর কোন চিহ্ন সেখানে পাওয়া যায় না।
তথ্যসূত্রঃ
১। অনুপম হায়াৎ, ‘নবাব পরিবারের ডায়েরিতে সমাজ ও সংস্কৃতি’, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি, ২০০১
২। নাজির হোসেন, ‘কিংবদন্তির ঢাকা’, থ্রী স্টার কো-অপারেটিভ মালটিপারপাস সোসাইটি লিঃ, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৯৫
৩। শ্রী কেদারনাথ মজুমদার, ‘ঢাকার বিবরণ ও ঢাকা সহচর’, গতিধারা
৪। দিনাক সোহানী কবির, ‘পূর্ব বাংলার রেলওয়ের ইতিহাস ১৮৬২-১৯৪৭’, একাডেমিক প্রেস এন্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরি,
৫। মীজানুর রহমান, ‘ঢাকা পুরাণ’, প্রথমা প্রকাশন,
৬। খন্দকার মাহমুদুল হাসান ‘সেকালের ঢাকা’, শোভা প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১২
7. Azimusshan Haider, “Dacca: History and Romance in Place Names: An Analytical Account of the Nomenclature of Roads and Localities in Dacca, with a Discussion of the Rationale for Their Retention Or Otherwise”, Dacca Municipality, 1967