অলিম্পিয়াসের ক্রোধের সামনে লড়ুয়ে দ্বিগ্বিজয়ী এক বালক বীর

ব্যাটিং দেবতা শচীন টেন্ডুলকারের টেস্ট থেকে বিদায় ২০১৩তে আর সেই বছরেই বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম খেলতে নামেন মুমিনুল হক। শচীনের প্রিয় ব্যাটিং পজিশন চারে খেলতে নেমে প্রথম টেস্টে শ্রীলঙ্কার সাথে প্রথম ইনিংসেই ফিফটি করেন। যদিও একই ইনিংসে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা মুশফিকের ডাবল সেঞ্চুরি আর আশরাফুলের ১৯০ রানের ওপর ভর করে শ্রীলঙ্কার ৫৭০ রানের জবাবে টাইগারেরা ৬৩৮ রান করে। পরের ম্যাচেও আরেকটি ফিফটি করেন মুমিনুল, সেটা কলম্বোতে। তবে তাঁর আসল ঝলক দেখা যায় ঘরের মাঠে। দেশের মাটিতে টেস্ট খেলতে নেমে প্রথম ইনিংসেই করেন ১৮১। সেই একই সিরিজে পরের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের সাথে দ্বিতীয় ইনিংসে আবার করেন অপরাজিত ১২৬। এর পরের সিরিজ আবার শ্রীলঙ্কার সাথে, এবার দেশের মাটিতে। প্রথম ম্যাচে একটা ফিফটি করলেও সেটা মুমিনুলীয় হয়নি, পরের ম্যাচে করলেন সেঞ্চুরি। ঘরের মাঠে প্রথম চার ম্যাচে গড় ১০৯.৪০। একেবারে ব্র্যাডম্যানীয় গড়! ব্যাটিং দেবতার বিদায় বেলায় শুরু করা ছোটখাটো বামহাতি মনে করিয়ে দিচ্ছেন ব্যাটিং ঈশ্বরকে! তারপর!

তারপর যেন তিনি গ্রিক ট্রাজেডির চরিত্র হয়ে গেলেন। অলিম্পিয়াস থেকে আকন্ঠ অমৃতসুধা পান করতে করতে গ্রিক দেবতা তথা ক্ষমতাশালীরা যেমন মর্ত্যের মানুষের ক্ষমতাকে রুদ্ধ করে দিত, প্রতিহিংসার ছোবল দিতো নানা কায়দায় তাই যেন হলো! সমুদ্রপাড়ের শহর কক্সবাজার থেকে আসা ছোট্টখাটো ছেলেটি ব্যাটিংয়ে তিনে নামা শুরু করলো, যথারীতি সেঞ্চুরিও পেল একটা কিন্তু এর বিপরীতে জমা হতে লাগলো কেবল ফিফটি। টানা ম্যাচে ফিফটি করার রেকর্ডও করে ফেললো। ব্যাট হাতে টেস্টে সে অন্যদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে! তাতে কি! প্রথমে তিনি বাদ পড়লেন ওয়ানডে থেকে, বলা হলো তিনি ‘টেস্ট স্পেশালিস্ট’।

কিংবদন্তী ডন ব্র্যাডম্যান বডিলাইন সিরিজে তাঁর ক্যারিয়ার এভারেজের অর্ধেক এভারেজে রান করেছিলেন, টেন্ডুলকার কিংবা লারার মতো আধুনিক ব্যাটিং দেবতাদেরও অনেক খারাপ সময় গেছে। মুমিনুলও ব্যাতিক্রম না। তার উপরে সুযোগ মেলে কেবল বছরে দু’চারটা টেস্ট খেলার। একটা সময় তো পনেরো মাস বাংলাদেশ টেস্টই খেলেনি। মুমিনুল নিজের ফর্ম কিভাবে প্রমাণ করবেন!

একটু বাজে ফর্ম নিয়েও দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডের সাথে বাজে পিচে ফিফটি করলেন, অল্প রানের ম্যাচে সেই ইনিংস, সেঞ্চুরিয়ান তামিমের সাথে তাঁর জুটি দলকে জেতাতে সাহায্য করলো। যদিও পরের তিনটি টেস্ট, বাইরের মাঠে খেলায় তিনি খারাপ করলেন।

মুমিনুল এতকিছুর পরেও প্রায় পঞ্চাশের কাছে গড় নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গড় (আবুল হাসানের তিন ম্যাচে ৮২ গড় বাদ দিলে) আর ঘরে মাঠে সেটা প্রায় ষাটের কাছাকাছি। আগের ম্যাচেই দলকে জিততে বড় ভূমিকা রেখেছেন।

কিন্তু অলিম্পিয়াস থেকে নির্দেশ এলো, মুমিনুল তুমি বহিস্কৃত, তোমার সুযোগ নেই। যেই ফর্মের অজুহাতে তাঁকে বাদ দেয়া হলো সেই একই বিচার অন্য অনেকের বেলায় হলো না, অতীতেও হয়নি। ‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট’- এই ক্রিকেটীয় অপ্তবাক্য তাঁর বেলায় খাটলো না। তিনি ব্রাত্য হলেন। রোষানলের আগুনে পুড়লেন। যদিও এই আচরণ কিন্তু নতুন কিছু নয় বরং ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি এবং আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে একসময় যারা নিজেরা এই আগুনে পুড়েছেন তারাই এখন অগ্নি শলাকা নিয়ে অগ্নিমন্দিরের পুরুত হয়েছেন।

ফিরে এসে দারুন করেছিলেন নান্নু

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে মুমিনুলের এই বিতর্কিত বাদ পড়ার আগে অন্তত তিনটি বিতর্কিত বাদ পড়ার ঘটনা ঘটেছে। যার দুটির সাথে জড়িত আছেন বর্তমানের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ও অন্যতম নির্বাচক হাবিবুল বাশার সুমন।

বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল ১৯৯৯ সালে। এর আগে একাধিকবার অনেক কাছে গিয়েও বিশ্বকাপে বাছাই না করার যন্ত্রনায় পুড়েছে গোটা দেশ। সেবার স্বপ্নপূরণ হলো। সেই স্বপ্নের দলে আর কেউ না হোক দেশসেরা ব্যাটসম্যান নান্নু যে থাকবেন তাতে খুব বেশি সন্দেহ কারো ছিলো না। দল ঘোষণার দিন তিনেক আগে বিকেএসপিতে প্র্যাকটিস ম্যাচে সেঞ্চুরিও হাঁকালেন অনেকের মতে সর্বকালের সবচেয়ে স্টাইলিশ এই বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান। কিন্তু নির্বাচকদের বিবেচনায় তিনি বাদ পড়লেন!

জনগণ ফুঁসে উঠলো, মিডিয়া সরগরম হলো। ‘নান্নুর বাদ পড়া, মানি না মানবো না’। ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা বিশেষ সভা ডাকলেন, সেই সভায় নির্বাচক কমিটিই বাতিল হলো, নান্নু দলভুক্ত হলেন ব্যাটসম্যান জাহাঙ্গীর আলমের বদলে।

সেই নান্নু আমাদের বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম জয় এনে দিয়েছিলেন এককভাবে! আইসিসির সহযোগী সদস্য স্কটল্যান্ডের সাথে জিতবে সেই আশায় গোটা দেশ প্রস্তুত থাকলেও ২৪ মে এডিনবার্গে টসে হেরে কনকনে শীত আর সিমিং উইকেটে বাংলাদেশের স্কোর দাড়ালো পাঁচ উইকেট হারিয়ে ২৬! সেই বিপর্যয়ে নান্নু ৬৮ করলেন, দলকে নিয়ে গেলেন ১৮৫ তে, পরে মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে একটি মহামূল্যবান উইকেটও পেলেন। দল ২২ রানে জিতলো। রচিত হলো ইতিহাস। ঠিক পরের খেলাতেই দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম ওয়ানডে দল অস্ট্রেলিয়ার সাথে ৫৩ করলেন, পাকিস্তানের সাথে খেলায় আঁটোসাটো বোলিং করে দলকে জেতাতে সাহায্য করলেন। বিশ্বকাপ শেষে নান্নু মাথা উঁচু করে অবসর নিলেন। অলিম্পিয়াসের দেবতাদের অহঙ্কার চূর্ণ হলো।

ঠিক একইরকম হয়েছিল বাশারের বেলায়। নান্নুদের সেই দারুন পারফরম্যান্স বাংলাদেশকে টেস্ট স্ট্যাটাস এনে দিল। পরের বছর ঢাকার মাঠে অভিষেক টেস্ট ম্যাচ ভারতের সাথে। সবাই উত্তেজিত, উত্তেজিত রান মেশিন বাশারও। তিনি ব্যাট হাতে তখন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা! কিন্তু হায়! আবারও সেই অন্ধকারে পুনরাবির্ভাব! নির্বাচকদের অচিন্ত্যনীয় সিদ্ধান্ত! বাশার টেস্ট দলে নেই।

হাবিবুল বাশারের দলে ফেরার কাহিনির অনেকটাই লিখেছিল মিডিয়া

আবারও জনতার ক্রোধ, মিডিয়াতে বিস্ফোরণ। সেবার বোর্ড প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী বিশেষ ক্ষমতাবলে তাঁকে দলে নিলেন। খেলার আগের দিন নভেম্বরের ৯ তারিখে হোটেলের প্যাডে চুড়ান্ত দল ঘোষণা করে তাতে স্বাক্ষর দিলেন তিনি। এদিকে দলে সুযোগ পেয়ে বাশার ৭১ রান করলেন প্রথম ইনিংসে। সেটি বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম টেস্ট হাফ সেঞ্চুরি। সেই বাশার পরে হলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা রান স্কোরার, প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে যিনি ৩ হাজারের ফলক ছুঁয়েছিলেন। আজকের দিনে তামিম, সাকিব, মুশফিক আর মুমিনুলদের আগে তিনিই ছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাটিং নক্ষত্র।

শত টেস্ট পেরিয়েও কতটুকু পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড!

সেই বাশার আর সেই নান্নু আজ মমিনুলকে বাদ দিচ্ছেন!!

এসব দেখে না জানি কেমন বোধ করছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা অধিনায়ক, দেশের সবচেয়ে ক্যারিশমাটিক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। ইনজুরিতে জর্জর হয়ে যিনি টেস্ট ছেড়েছেন আজ প্রায় এক দশক যদিও নিজের ওয়ানডে দলে প্রতিটি খেলোয়াড়কে তিনি আগলে রাখেন, ফর্মে ফেরার সুযোগ দেন। যার প্রমাণ মুমিনুলের সাথে টেস্টে বাদ পড়া মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ আর এবার বহুদিন পর দলে ফিরে আসা নাসির হোসেন।

কিন্তু মাশরাফিরও নিশ্চয়ই মনে আছে আরো এক গ্লানির কথা, নির্বাচকদের কোপানলের কথা! দেশে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ হবে ২০১১ সালে, ইনজুরি আক্রান্ত মাশরাফি দেশের মাটিতে খেলার স্বপ্নে জান দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করছেন। ডাক্তাররাও বলেছেন যে বিশ্বকাপের আগে আগেই সুস্থ হয়ে যাবেন, বেশি হলে ফার্স্ট রাউন্ডের একটা দুইটা খেলা মিস করবেন। কিন্তু না! তিনি উপেক্ষিত হলেন।

মাশরাফিকেও শিকার হয়েছেন নির্বাচকদের ব্যস্ত ভাবনার 

মাশরাফি, বীর মাশরাফি, ইনজুরিতে পড়েও বারবার ভেঙ্গে পরার বদলে যিনি উঠে দাঁড়ান, যিনি অবিচল, সেদিন তিনি অঝোর ধারায় কাঁদলেন। এই অবিচারে, এই গ্লানিতে, এই কষ্টে কোটি কোটি সমর্থকের বুক ভেংগে গিয়েছিল কিন্তু তিনি নান্নু বা বাশারের মতো সৌভাগ্যবান ছিলেন না, তাকে দলে নেয়া হলো না।

তবে বাকিটা ইতিহাস! ঠিক পরের বিশ্বকাপ, চার বছর পরে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডে! সেখানকার অচেনা কন্ডিশনে দলকে নেতৃত্ব দিলেন মাশরাফি। শুধু তাই না, দলকে এনে দিলেন সেরা সাফল্য। শুধু সেখানেই থামলেন না, এর পর পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা আর ভারতকে টানা হারিয়ে দলকে নিয়ে গেলেন অন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশকে পৌঁছে দিলেন এমন এক উঁচ্চতায়, নিজেকে নিয়ে গেলেন এমন এক সম্মানের আসনে যেটি অলিম্পিয়াসের চূড়া থেকেও যোজন যোজন উঁচু।

তাই মুমিনুলের ভেঙ্গে পড়ার কিছু নেই, অলিম্পিয়াসের দেবতাদের রোষ বাঁচিয়ে এবার হয়তো তিনি দলে থাকবেন না কিন্তু কিংবদন্তীর মহাপুরুষের মতো তিনি নিজেকে আরো উঁচুতে তুলে ধরবেন এতে সন্দেহ সামান্যই।

তোমাকে আগুনে পুড়ে আরো খাঁটি দেখার আকাঙ্ক্ষায়, দ্বিগ্বিজয়ী দেখার অপেক্ষায়, বালক বীর।