মহারাজা তোমায় সেলাম

ষাটের দশক। উত্তাল আগুনলাগা সব দিন। রাজনীতি আর ভৌগলিকতার টানাপোড়েন। সিনেমার রংমহলে নজর দেওয়ার ফুরসতে মেলে মোগল-এ-আজম, বৈজু বাওরা, লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া কিংবা দিলীপ কুমার, পিটার ও’ টুল, গ্রেগরি পেকে। দেশের দিকে নজর দেওয়ার কি উপায়? তাদের মতোন, কেই বা আছেন তখন এই বাংলা মুল্লুকে?

দেশি নির্মাতাদের মনে বুঝি আফসোসও ছিল। থাকারই কথা। বড় পর্দায় গড়পড়তায় সবাই এন্টারটেইনমেন্ট চান, নায়কের শিভালরি চান, আর সাবকন্টিনেন্টে সেই সাথে চাই আহ্লাদী নায়িকার জন্য মন ভোলানো হাসি, আমন্ত্রণ। এ বঙ্গে এমন কমপ্লিট প্যাকেজ পাওয়া তো মুশকিল। সেই মুশকিল বোধহয় বহু বছর, কি আজীবনের জন্য সমাধান করতেই এলেন একজন। রাজ্জাক। সাথে নামের আগে ‘নায়করাজ’। সেটা তৈরি হতে সময় লাগেনি বেশি। তবে অম্লান থেকেছে আজীবন।

নায়করাজের পরিবার

দেশভাগের আগে তো সবাই একই দেশের মানুষ। সেই হিসেবে রাজ্জাক এদেশি হলেও জন্ম তার ঠিক এই মুল্লুকে নয়। ওপার বাংলায়। ভাগ্যের অন্বেষণে ষাটের দশকে চলে এসেছিলেন এদেশে। ফিল্ম করবেন এমন সংকল্প নিয়ে। শুধু কি তাই? হয়তো বিষয়টা এমন যে ইতিহাস যাকে নির্বাচন করবে তাকে ইতিহাস তৈরির জন্য বাড়তি কিছু করতে হয় না, ইতিহাস আপনা আপনিই তার জন্য মঞ্চ তৈরি করে রাখে। বাকিটুকু নিমিত্ত মাত্র। হয়তো ১৯৪২ সনে টালিগঞ্জে জন্মানো আব্দুর রাজ্জাকের জন্য ভাগ্যই অপেক্ষা করছিল। তাই ‘তেরো নম্বর ফেকু ওস্তাগড় লেন’ এর ছোট্ট পথচলা থেকে সিংহাসনের রাজাধিরাজ হয়ে উঠতে কখনো থমকায়নি, বা হোঁচট খায়নি রাজ্জাকের পথ। কারণ মেধা, দক্ষতা আর পরিশ্রমের দুর্দান্ত মিশেল। টিপিক্যাল কমার্শিয়াল কি ইন্টেলেকচুয়াল ছবি কি প্রতিবাদী ছবি- রাজ্জাক সবসময়ই স্পোর্টিং, ফিট এবং পারফেক্ট। তা সে চরিত্র ফোন দিয়ে মনভোলানো গান শোনানোর হোক, প্রতিবাদী ছাত্রের হোক, মুক্তিযোদ্ধার হোক, লোককাহিনীর নায়কের হোক, রংবাজের হোক অথবা যেমনটাই হোক না কেন- রাজ্জাক একমেবাদ্বিতীয়তম। এর জন্য ট্যালেন্ট লাগে, ভাগ্যও লাগে-আর দুটো বিষয়কে একসাথে তাল মানানোর যোগ্যতাও লাগে। রাজ্জাকের তা ছিল বলেই তিনি নায়করাজ হয়েছেন। আজীবনের জন্য।

বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী ব্যবসাসফল জুটি রাজ্জাক-কবরী

রাজ্জাক কি বিশেষভাবে কাউকে ফলো করতেন? উত্তম-দিলীপ-রাজ-রিচার্ড-গ্রেগরি-দেব আনন্দ? ভাবনার বিষয়। সে বাহাস উর্ধ্বে থাকুক, কারণ রাজ্জাক নিজের একটা আলাদা ল্যাঙ্গুয়েজ তৈরি করতে পেরেছিলেন, অ্যাপিয়ারেন্সে আলাদা জেল্লা আনতে পেরেছিলেন। লোকে তাকে আর কারও মতো বলেনি। তার মতোই বলেছে, বলেছে নায়করাজ! বলবে নাইবা কেন? বাংলা ছবিতে প্রেমে-পৌরুষে-অভিনয়ে এমন ধারাবাহিক স্টান্টবাজি আর কেই বা করতে পেরেছেন এতটা দিন ধরে? রাজ কাপুর নয়, আমাদের ছিলেন রাজ্জাক।

সহকর্মী শাবানার সাথে রাজ্জাক

সুপারস্টারের সংজ্ঞা বড় কঠিন করে চলে গেলেন নায়করাজ।