পানির অপচয় কমালাম কিন্তু ‘ভয়ংকর সুন্দর’ দিয়ে কি বুঝলাম?

৪ আগস্ট মুক্তি পেয়েছে অনিমেষ আইচের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ভয়ংকর সুন্দর। সে উপলক্ষ্যে ঢাকঢোলও মোটামুটি পেটানো হয়েছিল। নায়িকা আশনা হাবিব ভাবনার বিপরীতে নায়ক চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কোলকাতা থেকে উড়িয়ে আনা হয় হালে দুই বাংলাতেই বিশেষ জনপ্রিয়তা পাওয়া পরমব্রতকে। ফলাফল কিন্তু আশানুরূপ নয়। না দর্শক মহলে, না সমালোচক মহলে, কোনো মহলেই চলচ্চিত্রটি বিশেষ সমাদর লাভ করতে পারেনি।

খুন করে পালালেও, পরে নায়ক কী নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করে যায়

এই সমাদর লাভ করতে না পারার পেছনে অনেকগুলো কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রথম কারণ চলচ্চিত্রটির গল্প। গল্পটি অবশ্য গৃহীত; কোলকাতার আনন্দ পুরস্কার ও সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক মতি নন্দীর ‘জলের ঘূর্ণি ও বকবক শব্দ’ গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্রটির কাহিনির বুনন। কিন্তু মূল গল্পটি থেকে যখন চলচ্চিত্রের কাহিনি নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে কিছু দুর্যোগ থেকে গেছে। এই যেমন একটা খুন করে পালিয়ে যাওয়ার পর নায়ক কী নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করে যায়! খুনেরও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, খুনিরও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই!

নায়িকা একবার বটি হাতে দাঁড়িয়েছে, আর তাতেই তার শ্রেণীচ্যূতির সংগ্রাম শেষ হয়ে গেছে

আবার নায়িকার শ্রেণিচ্যূতিও তার ক্ষমতাশালী-অভিজাত পরিবার কী সহজে মেনে নিল। নায়িকা একবার বটি হাতে দাঁড়িয়েছে, আর তাতেই সংগ্রাম দেখানো হয়ে গেছে! অভিজাত ও ক্ষমতাশালী একটা পরিবার স্রেফ মেয়ের ইচ্ছার কারণে একমাত্র সন্তানকে এমন একটা ছেলের সাথে বস্তিতে বাস করতে দিয়েছে, যে ছেলে অন্য ধর্মের, যার বংশপরিচয় নেই, এমনকি ন্যূনতম সম্মানজনক চাকরিও করে না। ভাঙা মাটির জালার শব্দ নর্দমার জলে বকবক শব্দ তোলার গল্পে যখন এই অনুষঙ্গগুলো যোগ করাই হলো, সেগুলোকে পূর্ণ রূপ দেয়াটাও জরুরি ছিল।

বাড়ির লোকদের মাঝে পানি বিলানোটাই যদি মোক্ষ হয়, তাহলে বাড়িতে বিপ্লব ঘটানোর যুক্তি কি বক্তৃতার ওই স্যাটায়ার

চলচ্চিত্রটিতে মূল গল্পের সমাপ্তিটাও বদলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেই সমাপ্তিটাও বেশ রহস্যময়। শেষে নায়ক-নায়িকার মুখে যখন সন্তুষ্টির চওড়া হাসি দেখা যায়, তখন দর্শককে দ্বিধাগ্রস্ত হন। সম্ভবত তারা জীবনের অপর নাম যে পানি, তা বাড়ির লোকদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে ওরকম হাসি হাসে। কিন্তু সেটাই যদি তাদের মোক্ষ হয়, তাহলে বাড়িতে বিপ্লব ঘটানোর যুক্তি কী? সেটা কি বক্তৃতার ওই স্যাটায়ারটার মঞ্চ প্রস্তুতের জন্য? খানিকটা থ্রিলার-থ্রিলার ভাব আনার জন্য? তাতে কিন্তু আবার মূল ক্লাইমেক্সের চেয়ে ওই অনুষঙ্গটাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়ে যায়।

সমাপ্তির এই বদলের আরেকটা কারণ হতে পারে শুরুতে দেয়া দ্বিতীয় সতর্কবাণী। প্রথম বাণীটি বাধ্যতামূলক; যেহেতু চলচ্চিত্রটিতে ধূমপান ও মদ্যপানের দৃশ্য আছে, তাই প্রথমেই এগুলোকে নিরুৎসাহিত করে সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় সতর্কবার্তাটি পানির অপচয় রোধ করা বিষয়ক। কারণ পানির অপর নাম জীবন। আর তাই চলচ্চিত্রটির ক্লাইমেক্সের শেষে পানি নর্দমায় ফেলে অপচয় করা হয়নি, বরং বাড়ির লোকরা বিপ্লব করে নায়ক-নায়িকার ঘর থেকে বিভিন্ন পাত্রে জমানো পানি হরিলুট করে নিয়ে যায়। আর জীবন তথা পানিকে জীবনের কাজে লাগতে দেখে নায়ক-নায়িকা বিমলানন্দে দন্ত বিকশিত করে হাসতে থাকে।

গানের পোশাক-পরিকল্পনার সময় পোশাকটা কে পরবে, সে বিবেচনা বোধটা একটু বেশিই জরুরি

অবশ্য এই আখ্যানটার বিশেষ একটা সম্ভাবনাও ছিল। গল্পটা নির্দ্বিধায় ঢাকার সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। গ্রীষ্মকালে ঢাকার অনেক জায়গাতেই এমন পানির সংকট দেখা দেয়। প্রতি বছরই গ্রীষ্মকালে এমন খবর পত্র-পত্রিকার নিয়মিত অনুষঙ্গ। সদরঘাট-পুরান ঢাকায় কাহিনিটাকে স্থাপন করে সেই সম্ভাবনার পালে জোর হাওয়া খেলানোও হয়। কিন্তু ঢাকার বা পুরান ঢাকার উপস্থাপন সেই আবেদনটা ঠিক তৈরি করতে পারল না। এর আগে আয়নাবাজি-তে চলচ্চিত্রায়িত পুরান ঢাকাকে দেখে দর্শক খানিকটা চমকেই উঠেছিল। সেই পুরান ঢাকার দৃশ্যায়নই ভয়ংকর সুন্দর-এ এসে বড় বিবর্ণ।

সিনেমাটার কাহিনিতে গানের ব্যবহারও সম্পূর্ণ সার্থক হয়নি। শুরুর দিকে মুহুর্মুহু গান। প্রতিটা গানেরই অবশ্য কোনো না কোনো ভাবসঞ্চারের দায়িত্ব ছিল। প্রায় গানগুলোর কথা-সুরও ভালো। কিন্তু কথা-সুর-কম্পোজিশন-কোরিওগ্রাফি মিলে কম্বিনেশনটা ঠিক দুর্দান্ত হলো না। আর গানের পোশাক-পরিকল্পনার সময় পোশাকটা কে পরবে, সে বিবেচনা বোধটা একটু বেশিই জরুরি; কারণ তখন দর্শকের পুরো মনোযোগ পাত্র-পাত্রী তথা নায়ক-নায়িকার প্রতিই থাকে।

ভয়ংকরসুন্দর-এর চিত্রনাট্যটাই এমন, তাতে পরমব্রত-ভাবনা ছাড়া আর কারোই তেমন অভিনয়ের সুযোগ নেই। কারণ এই মূল দুই চরিত্র বাদ দিলে, আর কোনো চরিত্রকেই কাহিনিতে ফুটিয়ে তোলা হয়নি। আর এই জুটির মূল সমস্যাই হয়ে রইল দুজনের অভিনয়ের দূরত্ব। বেচারা পরমব্রত, বাংলার ঘরে ঘরে মা-বোনদের প্রিয় এই নায়ক ঢাকায় দুটো সিনেমা করেও কল্কে জোটাতে পারলেন না।

পরমব্রত-ভাবনা জুটির মূল সমস্যা হয়ে রইল দুজনের অভিনয়ের দূরত্ব

তবে ভয়ংকর সুন্দরের সবচেয়ে জটিল ও রহস্যময় বিষয় এর নামকরণ। সিনেমাটির নামে জায়গা করে নেয়া এই ‘ভয়ংকর সুন্দর’ জিনিসটা কী? ভয়ংকর সুন্দর কী নায়িকার রূপ, যার কারণে পরমব্রত অভিনীত গোবেচারা মকুও খুন করে বসল? কিন্তু তাতে তো সিনেমার ক্লাইমেক্সের সাথে নামকরণের কোনো যোগাযোগই রইল না। নাকি ভয়ংকর সুন্দর হলো পানি? যে পানিকে নিয়ে ঘোরগ্রস্ত শ্রেণিচ্যূত নায়িকা একের পর এক ইংরেজি কবিতা আওড়াতে থাকে, যে কবিতাগুলোর মধ্যে ডেঞ্জারাস বিউটি শব্দবন্ধও আছে।

ভোটটা বোধহয় পানিতে দেয়াই নিরাপদ, কেননা তাতে নামকরণের সাথে ক্লাইমেক্সের একটা প্রগাঢ় যোগাযোগ স্থাপন করা যায়।