কথা শুরু করতে চাই একটু পেছন থেকে। হুমায়ূন আহমেদ যে বছর মারা যান, সেই বছর, ২০১২ সাল থেকে। সে বছর একটি দৈনিক পত্রিকায় বিশিষ্ট সমালোচক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম হুমায়ূনকে নিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন। যেখানে তিনি বলছেন-
‘হুমায়ূন আহমেদের লেখার নিশ্চয় নানা মূল্যায়ন হবে। কেউ কেউ হয়তো একাডেমিক প্রবন্ধও লিখবেন। কিন্তু সেসব হবে উপযোগী দূরত্বের একটা সময়ে।
তাঁকে নিয়ে একটা সমালোচনা আছে এ রকম যে তিনি জনপ্রিয় সাহিত্য রচনা করেছেন, কিন্তু তাতে উঁচু কোনো মান ধরে রাখার চেষ্টা করেননি, যে মান নন্দিত নরকে তাঁর লেখকজীবনের শুরুতেই অর্জন করেছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, ওই মান রাখার দায় থেকে তিনি বরং নিজের মতো করে একটি সাহিত্য ভাষা ও গল্প বলার কৌশল রপ্ত করতেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। এবং এই গল্প বলার কৌশলটি যে মান নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেই মানে পৌঁছাতে অনেকের এক জীবন লেগে যাবে। তাঁর একটি উপন্যাস হাতে নিয়ে সমস্তটা না পড়ে রেখে দিতে পারেন না তাঁর কঠোর সমালোচকও। গল্প বলার এ শক্তিটি তাঁকে বিশিষ্ট করেছে। এক বিশালসংখ্যক পাঠকসৃষ্টির একক কৃতিত্ব তিনি দেখিয়েছেন, যে পাঠকেরা তাঁকে পড়া শেষ করে অন্য লেখকদের দিকে হাত বাড়িয়েছে। একসময় পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য ছিল যাদের প্রতিদিনের সঙ্গী, তারা হুমায়ূন আহমেদকে তাদের সঙ্গী করেছে। আমাদের সাহিত্যের নিজস্ব একটি ঠিকানা তিনি খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিলেন। বাংলা একাডেমী প্রতি ফেব্রুয়ারি যে বইমেলার আয়োজন করে, যার অভিঘাত আমাদের সাহিত্যে পড়েছে সঞ্জীবনী শক্তি নিয়ে, তার সাফল্যের পেছনে তাঁর অবদান নিশ্চয় কেউ অস্বীকার করবেন না।
লেখাটা হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের মূল্যায়ন নয়, বরং তাঁকে নিয়ে কিছু স্মৃতির।’
সৈয়দ মনজুরুলের মতো এপার বাংলা-ওপার বাংলার অনেক জাঁদরেল লেখক-সমালোচক হুমায়ূনের সাহিত্য আলোচনার কঠিন কাজটি করতে সাহস পাননি। মনজুরুল যদিও বিপরীত মতের একটি আভাস দিয়েছেন ৫ বছর পরে। আইস মিডিয়ার পডকাস্টে হুমায়ূনের সাহিত্যকীর্তি মূল্যায়নে তিনি এবারে বেশ কিছু দুর্বলতার কথা বলেছেন। তার চোখে বিভিন্ন উপন্যাসে চরিত্রের পুনরাবৃত্তি, ছোট গল্পকে টেনে বড় করা, মধ্যবিত্তের গল্পের ঘেরাটোপে বন্দি থাকা- এমন বিভিন্ন প্রসঙ্গে তিনি সমালোচনা করেছেন। এগুলোও মোটা দাগে বলা, কোনো স্পেসিফিকেশন নেই।
আমার মনে হয়, জীবদ্দশায় হুমায়ূনের সাহিত্যের তুমুল জনপ্রিয়তা এমনকি মৃত্যুর পরেও তাঁর পাঠককূলের অতিমুগ্ধতা তাঁর সাহিত্যের নির্মোহ বিচারে প্রতিবন্ধকতা হয়ে আছে। এ কারণে হুমায়ূণের সমসাময়িকরা অন্তত যাদের আমরা শক্তিমান লেখক হিসেবে বিবেচনা করি, সাহিত্য সমালোচকরা যাদের সমীহ করেন তারা এখনও নিশ্চুপ। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তারা শুধু স্মৃতিচারণ করেন, হুমায়ূন এমন ছিল, রগচটা ছিল, দেশের প্রকাশনা শিল্পকে ভারতীয় বিশেষত পশ্চিমবঙ্গীয় সাহিত্য মাফিয়াদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, আম-পাঠককে বিশেষত টিন-এজারদের বইমুখী করেছিল- ইত্যাদি নানা ভাসাভাসা কথা বলেন। কিন্তু তারা কেউ বলেন না- তোমরা হুমায়ূনের এই বইটি পড়ো, এটা না পড়লে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে তোমার পাঠ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
হুমায়ূন জীবদ্দশায় বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন। নাটক লিখেছেন, গান লিখেছেন, ছোট গল্প-ভ্রমণ-সিনেমা সবখানেই তাঁর বিচরন ছিল। সবখানেই তিনি তুমুল জনপ্রিয়, গৃহীত। এমনকি ব্যাপক বিরুদ্ধমত সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন পত্রিকায় হুমায়ূনের লেখা ছাপা হয়েছে। এর পেছনে হয়তো বাংলাদেশের পাঠকদের ধরার একটা ফন্দি ছিল পত্রিকাগুলোর। কিন্তু সেখানকার বড় বড় লেখকদের প্রশংসার ফুলঝুরি- সেটি কি তবে? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন- ‘হুমায়ূন তো শরৎচন্দ্রের চেয়েও জনপ্রিয়।’ সুনীল কিন্তু বলেননি হুমায়ূনের সাহিত্য শিল্পোত্তীর্ণ। মান-এর ব্যাপারটি এড়িয়ে গেছেন সকলে। যেমনি হুমায়ূনের উপন্যাসের চাপে হারিয়ে গেছে তাঁর গল্পকার পরিচয়টি। কিন্তু সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মতো আমিও মনে করি তিনি একজন শক্তিশালী গল্পকার। হুমায়ূনের লেখা কেমন- একই প্রশ্ন আমি করেছিলাম হাসান আজিজুল হককে; তিনিও এড়িয়ে গেছেন। শুধু বলেছেন- এতো জনপ্রিয়তা, এটা কি এমনি এমনি হয়?
বিষয়টা হলো, হুমায়ূনের জনপ্রিয়তাই হুমায়ূনের নিবিষ্ট পাঠের প্রধান অন্তরায়। অনেকে হয়তো একটু সাহস করে বলেন- হুমায়ূন যদি নন্দিত নরকে, দেবী, শঙ্খনীল কারাগার- এই বইগুলোর মতো আরও লিখে যেতেন তবে ইতিহাস অন্যরকম হতো। এটাও একটা পারসেপশন থেকে বলা। প্রশ্ন থেকে যায়: হুমায়ূন সাহিত্য আসলে কেমন? হুমায়ূন আহমেদের বেশিরভাগ উপন্যাস চার ফর্মা; আড়াই ঘণ্টার জমজমাট সিনেমার মতো। এরমধ্যে বই শেষ, পপকর্ন শেষ। একটা তৃপ্তি নিয়ে পাঠক-দর্শকের হল-ত্যাগ। লেখক যা বলতে চেয়েছেন পাঠক বুঝেছে, মজা দিয়েছেন, বার্তা দিয়েছেন, হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন। দর্শক আবারও এই পরিচালকের নতুন সিনেমার জন্য অপেক্ষা করেছে। হাউসফুল হয়েছে। আবারও মুগ্ধতা। এই যে প্রক্রিয়া, এটিতে কালজয়ী হবার বা প্রচলিত সাহিত্য সমালোচনা উত্তীর্ণ হওয়ার কোনো ইনটেনশনই ছিল না হুমায়ূনের। এক জন্মদিনে তাকে ইন্টারভিউ করার সুযোগ হয়েছিল আমার। খোশমেজাজে ছিলেন, এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলেন, ‘লেখা বাস্তব হতে হবে কথা নেই, কোনো একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্য লিখেও সার্বজনীন হওয়া যায়, রাজারাজরাদের কাহিনী নিয়ে সেক্সপিয়ার আজও টিকে আছে না?’
মোদ্দা কথায় উনার মধ্যে সহজাত স্টোরি টেলিং গুণটা ছিল, তা দিয়ে তিনি গল্প বলতেন, সেই গল্প বাস্তব না পরাবাস্তব তা তাঁর চিন্তায় ছিল না, তিনি কমিউনিকেটিভি লিটারেচার চর্চা করে গেছেন। এই লিটারেচার সব যুগে সব সময়েই থাকে। এটাই পপুলার আর্টের প্রধান বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা দেখেছি, পপুলার আর্ট একসময় এন্টিক ভ্যালুপ্রাপ্ত হয়। না হলে সেটি কালের গর্ভে হারায়। কোনো নতুন ব্যক্তি নতুন করে সেই আসনটি দখল করে নেন; আর্ট এরিনা দাপিয়ে বেড়ান; আবার আরেকজন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: হুমায়ূন টিকবেন কিনা? তার হিমুর অবস্থা কি দস্যু বনহুরের মতো হবে? এর উত্তর সময়ই দেবে। তারচেয়েও বড় প্রশ্ন: আমরা হুমায়ূনের জনপ্রিয় সাহিত্যের মূল্যায়ন করবো কোন টুলস দিয়ে? আমরা নিশ্চয় ইলিয়াসের খোয়াবনামা যেভাবে ব্যাখ্যা বা মূল্যায়িত হবে, সেই একই টুলস দিয়ে শুভ্র-হিমু-মিসির আলী’র মূল্যায়ন করব না। সেটা সম্ভব নয়, সমীচিনও নয়। এই দুই ধারায় তুলনা করা, কে বড় কে ছোট, সেই বিতর্ক অহেতুক। হুমায়ূনভক্ত ও সাহিত্য সমালোচকরা যা করতে পারেন তা হলো নিবিড় পাঠ। একটা তালিকা হওয়া জরুরি কোনটা হুমায়ূনের দুই ঘণ্টার সিনেমা আর কোনটা জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’। যদিও সিনেমা ও উপন্যাসে ঢের পার্থক্য, আমি শুধু বুঝবার সুবিধার্থে মোটা দাগে তুলনা করেছি। তবে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি হুমায়ূন সাহিত্যের শ্রেণিকরণ ও নির্মোহ পর্যালোচনাটা জরুরি। এটা জরুরি বাংলা বিশেষত বাংলাদেশের সাহিত্যের ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমার জন্য।