একটা সময় নাটক দেখার জন্য সবাই ঘড়ি ধরে ঘরে ফিরতো। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেত আগেভাগে। রাস্তা ফাঁকা, চায়ের দোকানের আড্ডা বন্ধ। টিভিতে নাটক হবে! বিটিভির সেইসব দিন। মানুষকে চুম্বকের মত টিভি সেটের সামনে টেনে আনতেন এক জাদুকরী লেখক হুমায়ূন আহমেদ।একদিন, দুইদিন নয় দশকের পর দশক, একটা দুটো নয়, শয়ে শয়ে নাটক। বিটিভি থেকে প্যাকেজ নাটক, নাট্যকার-পরিচালক হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি। তিনি প্রমান করে গেছেন, ‘কনটেন্ট ইজ কিং’।
অথচ যখন হুমায়ূন আহমেদ পরিচালনায় আসেননি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের শিক্ষকতা করেন আর করেন লেখালেখি। তখন তার লেখা একের পর এক ধারাবাহিক প্রচারিত হতে শুরু করে বিটিভিতে। নাট্যকার হুমায়ূন লাভ করেন ঈর্ষনীয় জনপ্রিয়তা। নাট্যকার পরিচয়ের কারণেই লেখক হিসেবে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। অন্তত এমনটাই মনে করতেন তিনি। লেখক ইমদাদুল হক মিলনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিষয়টি নিজেই উল্লেখ করেছেন। বলেছেন,
“আমি নাটক লেখা শুরু করলাম৷ আমাদের দেশে নাটকের দর্শক তো অনেক বেশি৷‘এইসব দিনরাত্রি’ বহু লোক দেখা শুরু করল এবং এরা মনে করল এই যে লোকটি নাটক লিখছে, তার একটা বই পড়ে দেখি না কেন! তারা বই কিনতে শুরু করল৷ পাঠকদের আমার বইয়ের প্রতি আগ্রহী হবার পেছনে ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকটা কাজ করেছে বলে আমার নিজের ধারণা৷ একজন নতুন লেখক লিখবে আর সঙ্গে সঙ্গেই তার বই বিক্রি হবে- এটা তো হবার কথা না৷ আমার ধারণা আমার নাটক দেখে লোকজন আগ্রহী হয়েছে, একটা বই পড়ে হয়তো সেকেন্ড বই পড়তে চেয়েছে- এটা হতে পারে৷”
২০০৮ সালের ৭ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য সাময়িকীতে ছাপা হয়েছিল সাক্ষাৎকারটি।
হুমায়ূন আহমেদ রচিত বেশিরভাগ নাটকের গল্পই আবর্তিত হয়েছে শহুরে মধ্যবিত্তকে নিয়ে। সাহিত্যের মতো নাটকেও মধ্যবিত্তের সুখ, দুঃখ, টানাপোড়েনকে তিনি খুব সহজে ধরতে পেরেছেন। নাটকের ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের হিউমার সেন্স অনেক ক্ষেত্রেই নাটকগুলোকে জনপ্রিয় ও চরিত্রগুলোকে দর্শকদের কাছের করে তুলতে পেরেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত ধারাবাহিক নাটকগুলো তাঁকে সারা দেশে নাট্যকার হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলে। অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, বহুব্রীহি, আজ রবিবার ধারবাহিক নাটকগুলো এখনো ইউটিউবে দর্শকের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়।
বিটিভিতে যখন হুমায়ূন আহমেদ কেবল নাট্যকার হিসেবেই কাজ করেছেন সে সময়ে তাঁর নাটকের অভিনেতাদের মধ্যে আসাদুজ্জামান নূর, হুমায়ূন ফরিদী ও আলী যাকের বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এক ঘণ্টার নাটক বা ধারাবাহিকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে কাজ করেছেন মঞ্চ কাঁপানো এসব শিল্পীরা। তাদের অভিনীত সেসব চরিত্র দারুণভাবে জনপ্রিয়ও হয়েছে। যেমনঃ কোথাও কেউ নেই নাটকের বাকের ভাই চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর, আজ রবিবার নাটকের বড় চাচা চরিত্রে আলী জাকের। পরবর্তীতে যখন হুমায়ূন আহমেদ লেখার পাশাপাশি নাটক পরিচালনাতে আসেন সেখানেও তাঁর অভিনয়শিল্পীরা ছিলেন বাঁধা। ডা. এজাজুল ইসলাম, ফারুক আহমেদ, চ্যালেঞ্জার, স্বাধীন খসরু ও নারী চরিত্র শাওন। এছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় অনেক নাটকে কাজ করেছেন জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ ও রিয়াজ। এই একই চরিত্রাভিনেতাদের নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ প্রত্যেকটা নাটককে আলাদা করতে পেরেছিলেন গল্প দিয়ে। অর্থাৎ একই মুখ দেখতে দেখতে দর্শকরা বিরক্ত হয়নি কারণ ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে তাদের উপস্থাপন ছিল আলাদা।
বিটিভির যুগ পেরিয়ে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোতে শুরু হয় প্যাকেজ নাটকের যুগ। সেখানে নাট্যকারের পাশাপাশি নির্মাতা হিসেবেও হুমায়ূন আহমেদ অপরিহার্য হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে ঈদের অনুষ্ঠানমালায়। ঈদ বিনোদনের মূল আকর্ষণ হয়ে ওঠে হুমায়ূন আহমেদের নাটক। হাস্যরসে পরিপূর্ণ নির্মল পারিবারিক বিনোদন ঈদের আনন্দে এনে দিত পরিপূর্ণতা। যতদিন হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন ঈদের অনুষ্ঠানে তাঁর নাটক মানেই দর্শক সময় ধরে টিভি সেটের সামনে বসবে সে যত বিজ্ঞাপনই থাকুক। ঈদের নাটক হিসেবে ‘তারা তিনজন’ সিরিজটিও দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।
এই যে বহুবিধ লেখালেখি। গল্প, উপন্যাস, নাটকের মত নানা মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছানো এটা হুমায়ূন আহমেদ অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পেরেছেন। তাঁকে কখনো গল্প বা কনটেন্টের খরায় ভুগতে হয়নি। হুমায়ূন আহমেদ মানেই নির্মল বিনোদন, নতুন গল্প, ভরপুর হিউমার। লেখালেখি করে কখনো ক্লান্ত হননি হুমায়ূন আহমেদ। আর নানা মাধ্যমে প্রতিনিয়ত লিখে যাওয়ার ব্যপারে তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা ছিল। ২০১০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকী পাতায় হুমায়ূন আহমেদের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল যেটি নিয়েছিলেন আলীম আজিজ ও তৈমুর রেজা। কথাপ্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ সেখানে বলেছিলেন,
‘পৃথিবীতে দুই ধরনের লেখক আছে। একটা হলো স্পনটিনিয়াস রাইটার। আরেকটা ধরণ হলো, চিন্তাভাবনা করে বইপত্র পড়ে ধীরেসুস্থে লিখবে। অল থ্রু মাই লাইফ আই ওয়াজ এ স্পনটিনিয়াস রাইটার। এর মধ্যে কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। তবে এই স্পনটিনিয়াস রাইটিংয়ের জন্য আমাকে ইতিহাস পড়তে হয়েছে। তথ্যগুলো ব্রেইনের একটা অংশে ছিল। কিন্তু আমি লিখেছি স্পনটিনিয়াসলি। চিন্তাভাবনা করে, এটা করব ওটা করব এসবের মধ্যেই আমি নেই’।