সকাল সকাল লেখকের বাড়ির বৈঠকখানায় বসে আছেন দুজন যুবক। লেখকের কাছে একজনের ঠিকানা চাইতে এসেছেন। যার ঠিকানা চাইতে এসেছেন সেই ব্যক্তিটির নাম সুধন্যবাবু। তার মেয়ে ও মেয়ের জামাই থাকে কানাডা। দুই বেকার যুবকের আশা সেই সুধন্যবাবুকে ধরে যদি বিদেশযাত্রার ব্যবস্থা করা যায়। সুধন্যবাবু, তার মেয়ে ও মেয়ের জামাই ছাড়া বাকি তিনজনের চরিত্র বাস্তব। ঘটনাও বাস্তব। লেখকের নাম মনিশংকর মুখোপাধ্যায়। লেখেন শংকর নামে। বেকার ছেলে দুটোর নাম জানা যায়নি।
![](http://icetoday.net/wp-content/uploads/2017/07/ছবি-১-লেখক-শংকর.jpg)
১৯৭৩ সালে দেশ পত্রিকার পুজো সংখ্যায় ছাপা হয় শংকরের জন অরণ্য উপন্যাসটি। এই উপন্যাসেরই চরিত্র সুধন্যবাবু। কলকাতা তখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। একদিকে বেকার যুবকদের ছড়াছড়ি আরেকদিকে নকশাল আন্দোলন। বেশ টালমাটাল পরিস্থিতি। আর সেই পরিস্থিতি নিয়েই লেখা জন-অরণ্য। দেশ পত্রিকার পুজো সংখ্যা যেদিন বের হয় সেদিনই উপন্যাসটি পড়ে শংকরকে ফোন করেন চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়। সেসময় শংকর বাড়ি ছিলেন না। ফিরে এসে স্ত্রীর কাছে খবর পান। সত্যজিৎ রায় উপন্যাসটি অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চান। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায় পরিচালিত জন- অরণ্য চলচ্চিত্রটি।
![](http://icetoday.net/wp-content/uploads/2017/07/Jana-Arnya-7.jpg)
সত্যজিৎ রায় তাঁর জীবনে সাহিত্য অবলম্বনে প্রচুর ছবি বানিয়েছেন। তবে জন অরণ্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এ ধরণের কনটেন্ট নিয়ে সত্যজিৎ রায় সচরাচর কাজ করেননি। মানে বিক্ষুব্ধ কলকাতা, বেকার সমস্যা, নকশাল আন্দোলন এ ধরণের মোটা দাগের রাজনৈতিক সমস্যাগুলো নিয়ে সত্যজিৎ খুব স্পষ্ট বক্তব্য কখনো দেননি। তবে তাঁর কলকাতা ট্রিলোজিতে তিনি বিষয়গুলো তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। কলকাতা ট্রিলোজির (প্রতিদ্বন্দ্বী, সীমাবদ্ধ, জন অরণ্য)মধ্যে সবচেয়ে জোরালে বলা যায় জন অরণ্যকে।
![](http://icetoday.net/wp-content/uploads/2017/07/ছবি-৩-সিনেমার-পরিচালক-সত্যজিৎ-রায়.jpg)
এবার আসা যাক শংকরের উপন্যাস থেকে সত্যজিতের ছবি হয়ে ওঠার মধ্যে কি কি ফারাক রয়েছে সে বিষয়ে। ফারাক থাকাটাই খুব স্বাভাবিক। কারণ দুটো ভিন্ন শিল্পমাধ্যমে দুজন ব্যক্তি একই গল্পকে ভিন্নভাবে প্রকাশ করেছেন।
![](http://icetoday.net/wp-content/uploads/2017/07/Jana-Arnya-8.jpg)
লেখকের বর্ণনার যে স্বাধীনতা থাকে সেখানে নির্মাতাকে হিসেবি হতেই হয়। তাই আমরা দেখি জন-অরণ্য ছবিটি শুরু হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার হল থেকে। যেখানে দেদারসে নকল করে পরীক্ষা দিচ্ছে ছাত্ররা, শিক্ষকরা অসহায়। মূলত এর মাধ্যমে নির্মাতা ছবিটির সময় ও প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরেন। অন্যদিকে উপন্যাসে আমরা দেখি অসহায় সোমনাথ ব্যানার্জিকে। যে দাঁড়িয়ে আছে কলকাতার চিৎপুর রোড ও সিআইটি রোডের মোড়ে। এই কলকাতাকেই জন অরণ্য বলেছেন লেখক।
লেখকের বয়ানে আমরা পাই হতাশ বেকার যুবক সোমনাথকে। যার জীবনের একমাত্র ব্যর্থতা দুই বছর আপ্রাণ চেষ্টা করেও একটা কোনরকমের চাকরি জোগাড় করতে না পারা।ঘরে বড় দুই ভাই, বৌদি আর বাবা। যেখানে বড় বৌদি মায়ের ভূমিকা পালন করছেন। আগলে রেখেছেন সংসারটাকে। চলচ্চিত্রে মেজ ভাই ও বৌদি গায়েব। চরিত্র কমিয়ে বরং মূল চরিত্র সোমনাথের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বেশি।
উপন্যাসে সোমনাথের বন্ধু সুকুমারকে পাওয়া যায় বিস্তৃতভাবে। যে কিনা অভাবের সংসারে একটা সামান্য চাকরিও জোগাড় করতে না পেরে পাগল হয়ে যায়। চলচ্চিত্রে সুকুমারকে আমরা পাগল হতে দেখি না। বরং সে ট্যাক্সি চালিয়ে রোজগার করে।
চলচ্চিত্রে আমরা দেখি সোমনাথের প্রেমিকা তাকে ছেড়ে যায়। উপন্যাসে সোমনাথের প্রেমিকা তপতী শেষ পর্যন্ত সোমনাথের জন্যই অপেক্ষা করে।
সোমনাথ ব্যবসায় নামে পরিচিত বিশুদার হাত ধরে। এই ব্যবসায় নামার অভিজ্ঞতা লেখক শংকর নিজের জীবন থেকেই আহরণ করেছেন। সেটা তিনি উল্লেখ করেছেন উপন্যাসটি লেখার প্রেক্ষাপটে। তো সেই অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করতে করতে কলকাতার অনেক কিছুই তাঁর চেনা হয়ে যায়। মানুষ চেনা হয়, দেখা হয় মানুষের দুর্দশা, অভাব। অভাব ও লোভের কারণে দেহপসারিনী হয়ে উঠেছে গৃহবধূ, কিশোরী-বালিকা। আরও ভয়াবহ বিষয় এ কাজে তাদের সহযোগী কখনো স্বামী, ভাই বা স্বয়ং মা। আর এ অভিজ্ঞতা শংকরের নিজ চোখে দেখা।সেখান থেকেই লেখা।
সোমনাথের অসহায়ত্বকে লেখক এবং নির্মাতা দুজনেই ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। ব্যবসায় যখন একটু একটু করে দাঁড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে সোমনাথ তখনই আবার সমান্তরালে পতনের আশঙ্কাও দেখতে পায়। নৈতিকভাবে সৎ থেকে ব্যবসায় টিকে থাকা তার জন্য মুশকিল হয়ে পড়ে। একবার একটি বড় অর্ডারের জন্য মিস্টার গোয়েঙ্কার কাছে যায় সে। কিন্তু অর্ডারটি পেতে হলে মিস্টার গোয়েঙ্কাকে খুশি করতে হবে। না আর্থিক লেনদেন নয়। একজন সঙ্গিনী জোগাড় করে দিতে হবে যার সঙ্গে গোয়েঙ্কা নিভৃতে সময় কাটাবেন। ভদ্র ঘরের ছেলে সোমনাথ। মধ্যবিত্ত মূল্যবোধে বড় হয়েছে সে। তাই লজ্জায় সে ফিরে যেতে চায় কিন্তু পারে না। কারণ এই অর্ডারটা পেয়ে গেলে মাটির তলার শক্ত মাটির খোঁজ পাবে সে। এগিয়ে আসেন নটবর মিত্তির। পাবলিক রিলেশন স্পেশালিস্ট, এই জন অরণ্যে সবার সব রকম চাহিদার খোঁজ রাখে সে। সেই এগিয়ে দিতে চায় সোমনাথকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিতান্ত বাধ্য হয়েই নটবরের সাথে গোয়েঙ্কার সঙ্গিনীর খোঁজে সন্ধ্যায় কলকাতার জন অরণ্যে নেমে পড়ে সোমনাথ। লজ্জা ডিঙিয়ে সেই দেহপসারিনীকে পৌঁছে দেয় গোয়েঙ্কার হোটেল রুমে।
যেই মেয়েটিকে সোমনাথ হোটেল রুমে পৌঁছে দেয় সে সোমনাথেরই বন্ধু সুকুমারের ছোটবোন কণা। দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত সোমনাথ তা ভাবতেও পারেনি। কারণ নাম পাল্টে সে এখন শিউলি। উপন্যাসে সোমনাথ মেয়েটিকে হোটেল রুমে পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত পরিচয় জানতে পারে না। মেয়েটি যখন বেরিয়ে যায় তখনই নটবর জানেন মেয়েটিকে তিনি চেনেন। তাদের এলাকাতেই থাকে, মেয়েটির নাম কণা, যার এক ভাই পাগল হয়ে গেছে, নাম সুকুমার। সোমনাথ বুঝতে পারে এই সুকুমারই তার বন্ধু।
অন্যদিকে চলচ্চিত্রে মেয়েটির নাম যুথিকা। সোমনাথ হোটেলে যাওয়ার সময় ট্যাক্সিতেই চিনতে পারে কনাকে। বন্ধুর ছোটবোনকে নিয়ে হোটেলে গোয়েঙ্কার কাছে পৌঁছে দিতে বিবেকে বাধে সোমনাথের। সে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু কণা যাবে না। কারণ সে আর কণা নেই, সে যুথিকা। সোমনাথ যতই আঢ়ষ্ট হোক, যুথিকার মধ্যে আঢ়ষ্টতা নেই, সে দৃঢ়। এই সংসার, এই সমাজ, দারিদ্র্য কণাদের দৃঢ় করে তুলেছে। এই জন অরণ্যে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা কণা করে নিয়েছে নিজের মত করে।