স্কয়ারফিটে মাপা জীবন

এদেশে স্কয়ারফিটে আবাস মাপার চল খুব বেশিদিনের নয়। ঢাকার মানুষ স্কয়ারফিটে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও ঢাকার বাইরে স্কয়ারফিট এখনো প্রায় অচেনা এক শব্দ। ভাড়াটিয়ার চাপ সবচেয়ে বেশি এই রাজধানীতে বলেই সম্ভবত আমরা লাইনে এসেছি। কাজ-সুযোগের খোঁজে বা লেখাপড়ার নামে প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ ঢুকছে ঢাকায়। নিজেদের ছাদ এখানেই তারা খুঁজে নিচ্ছে দেয়ালসমেত।

ব্যাচেলর, ছোট ফ্যামিলি, বড় ফ্যামিলি- এই মোটামুটি তিন ধরণের ভাড়াটিয়া। ব্যাচেলরদের পছন্দ একখানা বড় রুম যেখানে আরামসে ফ্লোরিং করে ৩/৪ জন থাকা যাবে। অর্থের সংস্থানের উপর নির্ভর করে সদস্য সংখ্যা। সদ্য বিবাহিত বা ছোট সন্তানসহ তিনজনকে ধরা হয় ছোট ফ্যামিলি। আর এর বাইরে বড় ফ্যামিলি। বাবা-মা-ভাই-বোন মিলিয়ে ফুল প্যাকড পরিবার।

জীবনের জলসাঘরে

এক রুম বা দুই রুমের ভাড়া বাড়িতে যাদের দম বন্ধ হয়ে আসে, ভাবনা হয় আলো-বাতাস নিয়ে, অনেকদিন আকাশ না দেখার আফসোস নিয়ে যারা মাসে মাসে হাজার টাকার নোট গুনে গুনে বাড়িওয়ালাকে দিচ্ছেন তাদের দুঃখ হয়তো দূর করা যাবে না তবে কিছুটা মলম লাগিয়ে সাময়িক উপশম দেয়া যাবে।

চলুন, চলে যাই হংকংয়ে। ঘনবসতি এক অঞ্চল। ঢাকায় থেকে যারা কপাল চাপড়ান তারা হংকংয়ে গেলে যে কি চাপড়াবেন! সেখানে এত মানুষ যে থাকার জায়গা নিয়ে রীতিমত হাহাকার চলছে। বাড়ির কথাতো বাদই দিলাম! সামান্য ১৫০ স্কয়ারফিটের একটা যেনতেন রুমের ভাড়াও ২০০ থেকে ২৫০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় ধরলে ১৬ থেকে ২০ হাজার টাকা প্রতি মাসে।

বাক্সে বাক্সে বন্দি

ভাবছেন কীভাবে সম্ভব? ১৫০ স্কয়ারফিটও অনেক হংকংবাসীর কাছে বিলাসিতা। তাদের জন্য রয়েছে ১৫ স্কয়ারফিটের কফিন কিউবিক্যাল। আজ রবিবার নাটকের বড় চাচার কথা মনে আছে? ওই যে কফিনে শুয়ে থাকতেন যিনি। দর্শকের জন্য সেটা হাসির খোরাকি দিলেও হংকংয়ে সেটাই বেশ স্বাভাবিক। তবে কফিন বলতে আসলে কফিন নয়, কফিনের মতই থাকার জায়গা। আলো বাতাস নেই, জানালা নেই। আছে শুধু আসা যাওয়ার দরজা।

এইসব ১৫ থেকে ১০০ স্কয়ারফিটের ভেতর বাস করছেন হংকংয়ের দুই লাখেরও বেশি মানুষ। যাদের মধ্যে ৪০ হাজার শিশুও রয়েছে। অবাক ও অমানবিক বিষয়টি নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। ৭৫ লাখ লোকের বাস হংকংয়ে। যেখানে পা রাখারই আর জায়গা নেই সেখানে বাড়ি বানাবেন কি করে? আর তাই থাকার জায়গা নিয়ে রীতিমত কাড়াকাড়ি চলছে সে শহরে। মানুষের মাথা গোঁজার জায়গা করে দিতে আর এর বিনিময়ে টু পাইস কামিয়ে নিতে বাড়িওয়ালারা ৪০০ স্কয়ারফিটের একটি বাড়িতে পার্টিকেল বোর্ড দিয়ে দেয়াল তুলে প্রায় ২০টি রুম করে ফেলছেন। যার মধ্যে একটা করে ছোট সিঙ্গেল বেড ধরবে। আর এর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জিনিস-কাপড় চোপড় রাখার জন্য কয়েকটা বেড। ঠিকভাবে দাঁড়ানোরও জায়গা পাবেন না। ১৫০ স্কয়ারফিটের একটা রুম তো মাত্র ছয় কদম হাঁটলেই শেষ!

শূন্যের মাঝার দোতলা ঘর

আর এসবই কিন্তু অবৈধ। প্রায় সময়ই অভিযান চালায় সরকারি লোকজন। কিন্তু তারাও তো জানে যে এসব লোকজন নিরুপায় হয়েই থাকছে এসব কবরে। আর সমস্যাটা এমন জটিলতায় এসে ঠেকেছে যে সমাধানও খুব তাড়াতাড়ি মিলছে না।

ভাবছেন হংকংয়ে সবারই বুঝি এই অবস্থা। তাহলে অত যে জৌলুশ দেখা যায় টিভিতে, ছবিতে, সিনেমায়, সেগুলো কোথায়? আছে সে জৌলুশ আছে। তবে যারা এই স্কয়ারফিটে মাপা জীবনে থাকছেন তাদের বেশিরভাগই হতদরিদ্র। রেস্টুরেন্টে কাজ করে চলেন বা ডেলিভারি ম্যান, হকার। রাতে শুধু ঘুমানোর জায়গা দরকার। আবার অনেকেই বৃদ্ধ, বেকার। বাধ্য হয়েই থাকছেন এসব কফিনে।

হাগজ আর ন্যাপকিন-সবই বড় কাছে

একটু বড় রুম অর্থাৎ ১৫০ স্কয়ারফিটে পাওয়া যায় রান্নার জায়গা। কারো আবার রান্নাঘর আর বাথরুম একইসাথে! তবে ১৫ থেকে ৩৫ স্কয়ারফিটের কফিনগুলোতে রান্না বান্নার কোন ব্যবস্থা থাকে না। আগুন জ্বালানো নিষেধ। কারণ এই পার্টিকেল বোর্ডে ঘেরা বদ্ধ রুমে আগুন ছড়িয়ে পড়লে পুড়ে মরা ছাড়া উপায় থাকবে না। তাই বাইরে থেকে খাবার নিয়ে এসে খেতে হয় এখানে। বাথরুম একটাই, কমন। পালা করে ব্যবহার করেন সবাই।

কি তারপরও বলবেন ঢাকা বড় গায়ে গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে? এক বাড়ির বারান্দা থেকে আরেক বাড়ির বেডরুম দেখা যায়, প্রাইভেসি নেই! তবু তো হাত-পা ছেড়ে বসতে পারছেন। ফুটবল খেলার জায়গা না থাকুক অন্তত হাঁটাচলার জায়গাটুকু তো আপনার আছে। সেটুকুও তো নেই হংকংয়ের লাখখানেক মানুষের।