নষ্ট এ শহরে, লোকাল বাসের ভিড়ে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাওয়ার সময় প্রায়ই দেখা যায় বাসের হেলপার তীব্র আপত্তির সাথে ততোধিক তীব্রভাবে নারীদের বাসে উঠা থেকে বিরত রাখেন, ‘লেডিস সিট নাই’ বলে। অবশ্য পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার, ব্যাটিং স্কিলের চেয়ে ‘মাচোম্যান’ পরিচয়ে অধিক পরিচিত শহীদ আফ্রিদি ভাবেন যে, নারীর কাজ কেবল ঘরে বসে রান্না করা। দ্রুততম সময়ে সাজঘরে ফেরার জন্য পরিচিত এই অলরাউন্ডার বাংলাদেশের অগণিত বস্ত্রবালিকাদের দেখলে কি বলতেন কে জানে!
শুনতে আশ্চর্য মনে হলেও সত্য, অনেকেই এখনও ভাবেন যে নারীরা অনেক কিছুতে সমান হলেও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ব্যাপারে সামান্য পিছিয়ে। এনারা, ‘মাইয়া মানুষ তর্কে পারে না, কাইন্দা জিততে চায়’ জাতীয় আলাপে উৎফুল্ল বোধ করেন, বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গাতে নারীরা পুরুষের সাথে পাল্লা দিলে- সেটা নিয়ে নানা ধরণের কদর্য ইঙ্গিত করেন!
এই গোত্রের জন্য যুতসই জবাব হবে এটা বলা যে, দাবার মতো একটা বুদ্ধিবৃত্তিক খেলায় একজন নারী সর্বকালের সেরা সব পুরুষ খেলোয়াড়দের হারিয়েছেন, নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন সর্বকালের সেরাদের একজন হিসেবে। সেই মানুষটির নাম, জুডিথ পোলগার।
এমনকি তিনি যাদের হারিয়েছেন তাদের কয়েকজনের বক্তব্যও ছিলো যে, ‘দাবা খেলা বুদ্ধিশুদ্ধির কারবার, এইগুলা বেডি মাইনষের কারবার না’। আর বলবে নাই বা কেন! দাবা খেলার সেরাদের বলা হয় ‘গ্র্যান্ড মাস্টার’, শব্দটাই তো পুরুষবাচক। আর সেই ‘পুরুষ’গুলোর শেষ গর্বটাও ভেঙ্গে দিয়েছিলেন জুডিথ পোলগার।
জুডিথের জন্ম হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক হাঙ্গেরিতে, ১৯৭৬ সালে। বাবা লাজলো ছিলেন এক আশ্চর্য মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকে বিশেষভাবে শিক্ষা দিলে তারা যেকোন বিষয়ে সেরা হবে। মানতেন ‘প্রতিভা জন্মায় না, লালন পালনের মাধ্যমে তৈরি হয়।’ স্ত্রী ক্লারাকে সাথে নিয়ে নিজেদের তিন মেয়ে সুজান, সোফি এবং জুডিথকে স্কুলে না পাঠিয়ে দাবা ও কৃত্রিম ভাষা এসপারান্টো শেখান। শুধু মেয়েদের দাবা না, ছেলেদের সাথে সমানতালে খেলানোর প্রস্তুতি নেয় তিন পোলগার কন্যা। তবে হাঙ্গেরির দাবা ফেডারেশন ঝামেলা কম করেনি। সুজান যদিও প্রথম ট্যাবু ভেঙ্গে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক মাস্টার হইয়েছিলেন কিন্তু কর্তৃপক্ষের লাগাতার অসহযোগিতায় গ্র্যান্ডমাস্টার হতে পারেননি।
এদিকে জুডিথ মাত্র ১৫ বছর ৪ মাস বয়সে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে বিশ্বরেকর্ড গড়ে গ্র্যান্ড মাস্টার হন। এর আগে যে রেকর্ডটি ছিলো কিংবদন্তী দাবাড়ু ববি ফিশারের (বর্তমানে রেকর্ডটি সের্গেই কারজাকিনের দখলে, যিনি মাত্র ১২ বছর ৭ মাস বয়সে সেটি অর্জন করেন)।
যদিও এসবের অনেক আগে মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৯৮৯ সালে সবচেয়ে কনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে জুডিথ ফিদের সেরা ১০০’র তালিকায় স্থান পান। আজ পর্যন্ত তিনিই একমাত্র নারী যিনি ২৭০০ র্যাঙ্কিং পার হয়েছেন এবং ক্যারিয়ারের একটা পর্যায়ে তিনি ছিলেন বিশ্বের আট নম্বর র্যাঙ্কিংধারী।
সেই ১৯৮৯ সালে নিজের শুরু থেকে ২০১৫ সালে যখন তিনি অবসর নেন, তখন পর্যন্ত ছিলেন নারীদের মধ্যে সেরা। যদিও মাত্র ১৪ বছর বয়সে জুডিথ নিজের বড় দুই বোনের সাথে মিলে হাঙ্গেরি নারী দলের হয়ে অলিম্পিকে দলীয় সোনা জেতেন এবং তার পর থেকে তিনি আর কখনো নারীদের কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নেননি।
একে একে বড় বড় সব টুর্নামেন্ট, যেমন ১৯৯৩ সালে হেস্টিংস, ৯৪ সালে মাদ্রিদ, ৯৬ সালে লিও এবং ১৯৯৮ সালে গৌরবজনক ইউএস ওপেন জেতেন তিনি। এমন আরো অন্তত চারটি বড় টুর্নামেন্ট জেতা ছাড়াও তিনি গুনে গুনে ১১ জন পুরুষ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে হারিয়েছেন যার মধ্যে সবচেয়ে বড় জয়টি ছিল তৎকালীন বিশ্বের এক নম্বর খেলোয়াড় ও অনেকের মতে সর্বকালের সেরা দাবাড়ু গ্যারি কাসপারভকে হারিয়ে পাওয়া। জুডিথের শিকারের তালিকায় আছেন বিশ্বনাথন আনন্দ, ম্যাগনাস কার্লসেন, আনাতোলি কারপভ, ভ্লাদিমির ক্রামনিক, বরিস স্প্যাসকি, ভাসিলি স্মিসলভ, ভ্যাসেলিন টোপালোভ, রুজলান পোনোমারিওভ, আলেক্সান্ডার খালিফম্যান ও রুস্তম কাসিমজানভেরা।
এই তাবত বিশ্বসেরারা ‘বাঘিনী’ জুডিথের কাছে হেরেছিলেন। প্রচণ্ড অগ্রাসী খেলোয়াড়ি স্টাইলের জন্য জনপ্রিয় জুডিথের সাথে পাঁচ ঘণ্টার স্নায়ুযুদ্ধের ম্যাচে হেরে মার্কিন চ্যাম্পিয়ন জোয়েল বেঞ্জামিন বলেছিলেন, ‘দাবার বোর্ডে জুডিথ একটা বাঘিনী। ও আপনাকে সমানে আক্রমণ করে যাবে এবং আপনার সামান্যতম ভুলেও একেবারে ছিঁড়ে ফেলবে।’
অবসর নেওয়া জুডিথ এখন স্বামী গুস্তাভ ফন্ট এবং দুই সন্তান অলিভার ও হানাকে নিয়ে ব্যস্ত। খেলোয়াড়ি জীবন শেষে তিনি ছিলেন হাঙ্গেরি পুরুষ দাবা দলের অধিনায়ক ও কোচ।
আজ ২৩শে জুলাই, নারী-পুরুষের অসাম্যের মিথ ভেঙ্গে দেওয়ার ভয়ংকর সুন্দর উদাহরণ জুডিথ পোলগারের ৪১তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন, লড়াকু মানুষ।