বছর দেড়েক আগে জয়া আহসান একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে কাজ করেছিলেন। অবশ্যই কলকাতায়। নাম ভালোবাসার শহর। পরিচালনা করেছেন ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী। লম্বা সময় পরে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেল গত মাসের শেষ দিনে, ৩০ জুন। বাংলাদেশ-ভারতে ইউটিউবে। অন্যান্য দেশে আরেক ভিডিও শেয়ারিং সাইট ভিমিও-তে।
![](http://icetoday.net/wp-content/uploads/2017/07/1.jpg)
কথায় ও কাজে মনোযোগের দাবিদার এই চলচ্চিত্রটির কাহিনির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকও আছে। প্রথমত, ভালোবাসার শহরের কাহিনিতে জাতি-ধর্মের বিভেদ ঘুচিয়ে দেয়া হয়েছে। নায়ক-নায়িকা ভিন্ন ভাষী, তথা ভিন্ন জাতির, এবং একই সাথে ভিন্ন ধর্মেরও বটে। নায়কের নাম আদিল হায়দার, মুসলমান, হিন্দিভাষী। আর নায়িকার নাম অন্নপূর্ণা দাশ, বাংলাভাষী, হিন্দু। চলচ্চিত্রটির মূল বক্তব্য অন্য হলেও, কাহিনি এই দুজনের প্রেমকে কেন্দ্র করেই এগিয়েছে।
সেই কাহিনিতে উঠে এসেছে মাতৃশক্তির অসাধারণ এক রূপও। অন্নপূর্ণার স্বামী নিখোঁজ। জাতি-ধর্মের বেড়াজাল ছিন্ন করে বিয়ে করতে গিয়ে ছেড়ে আসতে হয়েছে তার নিজের পরিবারকেও। তাই অন্নপূর্ণা ওরফে বুড়িকে একা একাই মৃত্যুর সাথে লড়তে থাকা নূরীকে নিয়ে সংগ্রাম করতে হয়। তাতে আদিলের বৃদ্ধ বাবা সহায়তা করতে চাইলেও, পেরে ওঠেন না। নিজেকেই নিজের সহায় হয়ে উঠতে হয় অন্নপূর্ণার।
![](http://icetoday.net/wp-content/uploads/2017/07/3.jpg)
শুধু তাই নয়, অন্নপূর্ণার মতো নিজেই নিজের সহায় হয়ে ওঠার সংগ্রামে রত নারীদের জন্য সভ্য সমাজে কেমন সব অসভ্য বাস্তবতা বিরাজ করছে, তারও উপস্থাপন আছে ভালোবাসার শহরে। এসব সংগ্রামের গল্প বলতে গিয়ে, আদিল-অন্নপূর্ণার প্রেমকাহিনির বদলে, ভালোবাসার শহর আসলে অন্নপূর্ণার গল্পই বলে। মানে, নারীদের গল্প বলে। ফলে এটি হয়ে উঠেছে একটি নারীপ্রধান চলচ্চিত্র।
এই ভালোবাসার গল্পটা কলকাতার, আবার ঠিক কলকাতার নয়। গল্পটা ছড়িয়ে গেছে কলকাতা-দিল্লি হয়ে সিরিয়ার দুই সহস্রবর্ষীয় নগর হোমস অব্দি। আবার গল্পটা কলকাতা থেকে শুরু হলেও, গল্পটা নির্দিষ্ট করে কলকাতারও নয়। গল্পটা ঢাকারও হতে পারত, হতে পারত মুম্বাইয়ের, কিংবা লাহোরের। গল্পটাই এমন, তা যে কোনো সত্যিকারের ভারতীয় শহরের জন্যই সত্য।
![](http://icetoday.net/wp-content/uploads/2017/07/কাহিনিতে-উঠে-এসেছে-মাতৃশক্তির-অসাধারণ-রূপ।.jpg)
সত্য ছিল হোমসের জন্যও, বছর সাতেক আগেও। কিন্তু গৃহযুদ্ধের বলি হয়ে শহরটার বড় অংশই এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত। অন্য সব শহরে যেমন প্রতি সন্ধ্যায় লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরে ফেরে, ফিরে আসে প্রিয়জনের কাছে, বছর সাতেক আগেও তেমনটা ঘটত হোমসেও। পুরো শহর জুড়ে লক্ষ লক্ষ ঘরে লক্ষ লক্ষ ঘরে ফেরার গল্প তৈরি হতো প্রতিদিন। কিন্তু এখন শহরটা শূন্য, শহর জুড়ে খাঁ খাঁ করে কংক্রিটের ধ্বংসাবশেষ।
হোমস শহরের এই গল্প ফুরিয়ে যাওয়ার গল্পটাই মূলত চলচ্চিত্রটির উপজীব্য। আর তাই হোমসের ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডে বেদনামথিত নারী কণ্ঠে রঙ্গিলা রঙ্গিলা রঙ্গিলা রে, আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কৈ রইলা রে গেয়ে ওঠে, তখন আর আদিল-অন্নপূর্ণার বেদনাবিধুর পরিণামের জন্য মন খারাপ লাগে না। বরং হোমসের জন্য, হোমসের মানুষগুলোর জন্য মনটা হাহাকার করে ওঠে। সেই শহরের সাথে সাথে যে এমন লাখ লাখ ভালোবাসার গল্পকে করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়েছে, সে চিন্তায় মন আচ্ছন্ন হয়ে পরে।
![](http://icetoday.net/wp-content/uploads/2017/07/4.jpg)
এই মন কেমন করে তোলাটা, মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলাটাই চলচ্চিত্রটির মুখ্য উদ্দেশ্য- মানুষকে যুদ্ধের ভয়াবহতা মনে করিয়ে দেয়া। যুদ্ধ ভয়ংকর, এই সহজ সত্যটাই চলচ্চিত্রটির মূল বক্তব্য। সেই বক্তব্যটা যাতে দর্শকদের সত্যিই নাড়া দিতে পারে, সেজন্যই সে বক্তব্যটাকে ভালোবাসার গল্পের পাশে এমন রূঢ়ভাবে দাঁড় করানো হয়েছে।
চলচ্চিত্রটির শুরুতেই দর্শকদের দুয়ারে দু’হাত পেতেছেন নির্মাতা ইন্দ্রণীল রায় চৌধুরী। এই ধরনের চলচ্চিত্রের আর্থিকভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা যে খুব জরুরি সেটা মনে করিয়ে দিয়ে সকলকে আহ্বান করেছেন ইচ্ছা ও সামর্থ্য অনুযায়ী চলচ্চিত্রটির পাশে দাঁড়াতে।
পুরো সিনেমাটি দেখুন: