প্রসঙ্গ ঋতুপর্ণঃ শিরোনামের খেরোখাতা ও “তিতলি”

মেঘ পিওনের ব্যাগের ভেতর
মন খারাপের দিস্তা
মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়,
ব্যাকুল হলে তিস্তা।
মন খারাপের খবর আসে
বন পাহাড়ের দেশে
চৌকোনো সব বাক্সে
যেথায় যেমন থাক সে
মন খারাপের খবর পড়ে দারুণ ভালবেসে।

প্রথম হিমালয় দর্শন নেপালে। কত চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তবে না সেই স্বর্ণমুকুট পরিহিত সুপ্রাচীন শুভ্র রাজনের সাক্ষাত! বন্ধুরা মিলে যাওয়া, সকলেই গানের মানুষ। সাথে ছিল স্প্যানিশ গিটার আর হারমোনিকা। ঐ পরিবেশ আর পাকদণ্ডী পথে অমন হালকা যন্ত্রানুষঙ্গ প্রাসঙ্গিক ও বহনযোগ্য দুই-ই ছিল। মাঝে জুড়ে গেলেন স্থানীয় এক বাঁশিওয়ালাও। একটা অপার্থিব পাহাড়ি সুরে সে বাজাত। দারুণ জমেছিল গানের আসরগুলো। আর তাই সিনেমার কোন গানের দৃশ্যে যদি দেখি যে, পাহাড়ের পথ বেয়ে চলা গতি আর ঘটনার পাক খেয়ে ওঠার আভাস, তখন গিটার, হারমোনিকা আর পাহাড়ি সুরের অনুষঙ্গে গাওয়া গান প্রচণ্ড স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। নিমেষে তৈরি করে অভিযাত্রীর পথচলা আর গন্তব্যের আবহ। চলচ্চিত্রের দর্শক, অভিযাত্রীই তো! পরিচালকের আঁকা পথে গন্তব্যের দিশায় ধাবমান। “তিতলি” ছবির শীর্ষসঙ্গীত যার অংশবিশেষ লিরিকালি উপরে বয়ান করা রয়েছে, তেমনি এক দারুণ দ্যোতনা। জয়তু ঋতু, জয়তু দেবজ্যোতি!

কোন ছবি নিয়ে লিখলে সেটার কাহিনি নিয়ে বলাটা অনুচিত। কিন্তু মাঝে মাঝে উপায়ও থাকেনা। আলোচনার খাতিরেই কিছুটা আভাস দিতে হয়। যেহেতু অনেকগুলো বছর আগের ছবি আর বেশিরভাগ আগ্রহী দর্শকেরই দেখা হয়ে গেছে, তাই স্পয়লারের দায় কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলেই বলা যায় ২০০২ সালে রিলিজ হওয়া ঋতুপর্ণ ঘোষের “তিতলি”-এর পটভূমি দার্জিলিংয়ের কাসলটন চা বাগান। সে বাগানের ম্যানেজার অমর চ্যাটার্জি (দীপংকর দে), স্ত্রী উর্মিলা চ্যাটার্জি (অপর্ণা সেন) আর একমাত্র কন্যা তিলোত্তমা চ্যাটার্জি (কঙ্কণা সেন শর্মা), যার ডাকনাম তিতলি। টিনএজার তিতলি বয়সের স্বাভাবিক ধর্মেই মোহগ্রস্ত। সিনেমায় তার মোহ মুম্বাইয়ের ফিল্মস্টার রোহিত রায় (মিঠুন চক্রবর্তী)-কে নিয়ে। রোহিতের প্রতিটি সিনেমা তিতলির অনেকবার করে দেখা। পত্রিকায় বের হওয়া রোহিতের প্রতিটি ছবি আর খবরের পেপারকাটিং জমিয়ে রাখে সে, নিয়মিত লেখে ফ্যানমেল। যদিও আজ অব্দি সেগুলোর উত্তর মেলেনি। এমনকি নিজের মাকে সে জানায় যে, রোহিতকে বিয়ে করতে চায়।

পোস্টারে তিতলি

কুয়াশামোড়ানো এক সকালে তিতলি আর উর্মিলা জিপ নিয়ে রওনা দেয় বাগডোগরা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে, মুম্বাইফেরতা অমরকে রিসিভ করতে। পথে ঘটে এক অভাবনীয় ঘটনা। এয়ারপোর্ট যাবার পথে গাড়ি নষ্ট হওয়ায় তিতলিদের গাড়িতে লিফট নেয় একজন, তার নাম রোহিত রায়। ফিল্মস্টার মশাই এদিকেই এসেছিলেন একটা ছবির শুটিং করতে। মুহূর্তেই তিতলি যেন বাস্তব থেকে পৌঁছে যায় এক স্বপ্নদৃশ্যে। যাত্রাবিরতিতে সুযোগ মত তিতলি ছুটে যায় কাছাকাছি কোন এক বাজারে, রোহিতের জন্য কিছু কিনতে। আর তখন দর্শক জানতে পারেন, রোহিতের সাথে উর্মিলার উঠতি যৌবনের সম্পর্কের কথা। নিম্নবিত্ত, বাঙ্গাল পরিবারের তৎকালীন বেকার সন্তান রোহিতের সাথে উর্মিলার যে প্রেম বিয়েতে গড়ায়নি। বাজার সেরে ফেরার পথে তিতলিও শুনে ফেলে নিজের মায়ের সাথে রোহিতের কথোপকথন। জেনে ফেলে সবকিছু। তারপর? থাক না, কিছুটা দর্শকের অভিজ্ঞানে।

একটি দৃশ্যকাব্য, তিতলির

ফিরে আসি শীর্ষসঙ্গীতে। তিন পাগলের মেলা বলব, নাকি বলব তিন মায়েস্ত্রোর খেলা? ঋতুপর্ণের সেই মিঠে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় মকশো করা হাতের আটপৌরে অথচ ছুঁয়ে যাওয়া লিরিক, দেবজ্যোতি মিশ্রের অসাধারণ সুর ও সঙ্গীত আর সাথে শ্রীকান্ত আচার্যের মধুমাখা সুরেলা কণ্ঠ! সব মিলিয়ে গানটা হিমালয়ের মতোই বেশ একটা মুকুট পরে বসলো। এবং এই গান সিনেম্যাটিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাও তৈরি করে ফেলল। সেগুলো কি?

চরিতমানসঃ
পাঁচালিপাঠ মনে পড়ে? কিংবা মঞ্চনাটকের মূল বইখানা? শুরুতেই ঘটনার চরিত্রগুলোর একটা বর্ণনা থাকে। খুব বেশি পরিচয় হয়না তাদের সাথে, তবে একটা আভাস পাওয়া যায়। যাকে বলে সাবটেক্সট। তিতলির শীর্ষসঙ্গীতের কথা, সুর আর ভিস্যুয়ালে ঠিক এমনই একটা আভাস পাওয়া যায় চরিত্রদের আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের। এটা যেহেতু আভাসমাত্র, তাই বিস্তারে নাইবা গেলাম।

মেঘপিওন এবং কালিদাসঃ
কালিদাস সংস্কৃতে বেশ কিছু কাব্য লিখেছিলেন। “শকুন্তলা” তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিডিয়াবাজি করলেও, “মেঘদূতম” কে ফেলে দেওয়া যাচ্ছেনা একদমই। প্রাচীন টীকাকারদের মতে, মেঘদূতম বা মেঘসন্দেশ কালিদাস রচিত কেলিকাব্য, ক্রীড়াকাব্য, খণ্ডকাব্য বা মহাকাব্য; আধুনিক গবেষকরা একে আবার বলেন “বর্ষাকাব্য”, “বিরহকাব্য” বা “গীতিকাব্য”।

অতি প্রাচীনকালেই জনপ্রিয়তার শিখরে স্থান পাওয়া মেঘদূতের মূল উপজীব্য রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত এক অভিশপ্ত যক্ষের প্রিয়াবিরহ। কাব্যটি “পূর্বমেঘ” ও “উত্তরমেঘ”- দুটি অংশে বিভক্ত। রামগিরিতে আষাঢ়ের প্রথম দিনে নববর্ষার মেঘ দেখে তারই মাধ্যমে অলকাপুরীর রম্য প্রাসাদে নিজের বিরহী প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বার্তা প্রেরণ করে এক বিরহী যক্ষ। বিরহের আতিশায্যে জড় ও জীবের ভেদাভেদজ্ঞান লুপ্ত হয়ে মেঘকে তিনি জানাতে থাকেন, অলকায় পৌঁছানোর পথ। সবশেষে মেঘকে অনুরোধ করেন, প্রিয়তমার নিকটে নিজের কুশল সংবাদ নিবেদন করতে।

অবন ঠাকুর এঁকেছিলেন বিরহী যক্ষের চিত্র

এবারে বুদ্ধদেব বসুর লেখা “কালিদাসের মেঘদূত” বইখানির কথা ধরা যাক। সেখানে মেঘদূতের অনেক কিছুর মধ্যে দুটো বিষয় নিয়ে বাংলা আধুনিক কবিতার মহত্তম বিশ্লেষকের অত্যুত্তম দু’টি বিশ্লেষণ ছিল। প্রথমটি হলো, সংস্কৃত ভাষা বা সাহিত্য হিসেবে কখনোই আমজনতার হয়ে উঠতে পারেনি। তৎসম বা তদ্ভব শব্দের বহুল ব্যবহার সত্ত্বেও ইতিহাসের হোঁচট, দর্শনের গোলকধাঁধা আর ব্যাকরণের হাঁপানির কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় সংস্কৃত শব্দকে সকলেই খানিকটা এড়িয়ে চলে। যেমন সদন, ভবন বা গৃহ জাতীয় শব্দগুলো কেবল রবীন্দ্র সদন,সংসদ ভবন বা পিতৃগৃহ জাতীয় ভারিক্কি কাজেই ব্যবহৃত হয়। দৈনন্দিন ব্যবহারে বাড়ি, বাসা, কুটির এমনকি ভিলাও চলে।

এবং দ্বিতীয়টি হলো, আধুনিক ভারতে সংস্কৃতচর্চা একটি বিলাতফেরত সামগ্রী, ভারতের পাট যেমন শ্বেতাঙ্গরা বিবিধ প্রস্তুত পণ্যের আকারে ভারতের হাটেই ফের চালিয়েছে, তেমনি তাদের বুদ্ধির প্রক্রিয়ায় সংস্কৃত বিদ্যাও রূপান্তরিত হয়েছে নানারকম ব্যবহারিক বিজ্ঞানে।

এত তাত্ত্বিক আলোচনা কেন? কারন হল “মেঘপিওন”। উত্তরকলোনি জীবনধারায় দূত থেকে পিওন শব্দটি বড্ড চেনা চেনা। যেমন: “ডাক হরকরা” থেকে “ডাকপিওন” আমরা বেশি চিনি। তাইতো ঋতুপর্ণ কালিদাস থেকে নিলেন বটে কিন্তু উপস্থাপন করলেন আমাদের মত করে। মেঘদূত হয়ে গেলেন মেঘপিওন। আর তারপরের কথাগুলো ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিল, ওই দূরের পাহাড়ে কেউ একজন আছে যে যক্ষের মতই সতত বিরহী প্রহর গুণে যাচ্ছে।

তিতলির আরও একটি দৃশ্যকাব্য

আছেই তো, তিতলি রোহিতকে ভেবে যাচ্ছে; উর্মিলা, নিজের স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় আছে কিংবা হয়ত মেয়ের জেদে প্রতিদিন সেলুলয়েডে দেখা রোহিতের জন্য শূন্যতা তাকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। কিংবা বিশাল পাহাড় মহাকাল জুড়ে রয়েছে নিঃসঙ্গতার একাকী মূর্তি হিসেবে। পুরো বিষয়টাই তাই সেই মেঘছুঁয়ে আসা চিঠি। এরকম আরেকটা শব্দ বাংলা সাহিত্যে প্রচণ্ড জনপ্রিয় করেছেন কবি জয় গোস্বামী। শব্দটি “মেঘবালিকা”। অবশ্য জয় গোস্বামীর অন্য একটি কবিতা “নন্দর মা” থেকে বিস্তার করে ঋতু পরে আরেকটি ছবি বানিয়েছেন, সেটির নাম “সব চরিত্র কাল্পনিক”।

ফিরে এসো চাকাঃ

বিনয় মজুমদারের বিখ্যাত কবিতার সাথে আলোচ্য গান বা ছবির কোনটিরই সংশ্লিষ্টতা নেই। যদিও বক্ষ্যমান নিবন্ধের আলোচিত প্রসঙ্গের শিরোনাম এটিই। তিতলির শীর্ষসঙ্গীতটা যতজনকে শুনিয়েছি সেটার পরে প্রত্যেককে প্রশ্ন করেছি, আচ্ছা এই গানটা দেখা ও শোনার পর কেমন লাগে? মজার ব্যাপার হচ্ছে সবাই বলেছে নস্ট্যালজিক লাগে। সম্পূরক প্রশ্ন, কেন? উত্তর পাইনি। যদিও আমার কাছে একটা উত্তর আছে। দৃশ্যটা আরেকবার ভাবা যাক। পাহাড়ি রাস্তার আঁকাবাঁকা পথ ধরে একটা জিপ চলেছে। পাশ দিয়ে চলেছে একটা ট্রেন। একটা গান হচ্ছে গিটার আর হারমোনিকাতে। মনে পড়ে কিছু? হ্যাঁ পড়ে।

১৯৬৯ এর আরাধনা ছবির সেই সুপারহিট গান। শচীন দেববর্মনের সুরে আর কিশোর কুমারের দরাজ গলায় গাওয়া, “মেরে সাপনো কি রানী কাব আয়েগি তু”। রাজেশ খান্না চলেছেন ট্রেনের পাশে পাশে জিপ নিয়ে।

আরাধনা ও রাজেশ খান্নাকে ছোট্ট ট্রিবিউট দিয়েছেন পরিচালক ঋতু

তো এর সাথে তিতলি ছবির সম্পর্ক কি? আছে। কিশোর বা কিশোরীকালে সবারই কোন না কোন নায়ক বা নায়িকাকে নিয়ে ফ্যান্টাসি থাকে। তিতলির যেমন রয়েছে রোহিতকে নিয়ে। এয়ারপোর্ট যাবার পথে জিপে তিতলি তার মাকে জিজ্ঞেস করে যে, তার প্রিয় নায়ক কে ছিল? মা জানায়, রাজেশ খান্না। এরপর তিতলি গাড়ির ক্যাসেট প্লেয়ারে ঐ গানটা ছাড়ে। আমরা দেখি উর্মিলাও উচ্ছ্বসিত হয়ে সাথে সাথে গানটা গাইতে শুরু করে। বোঝা যায় যে কৈশোরের সেই ফ্যান্টাসি মুছে যায়না কখনো। ঋতুও ভুল করেনা তার শীর্ষসঙ্গীতে মনোবিদ্যার এই আপ্তপাঠটুকু যুক্ত করতে।

মাঝে মাঝে খুব মন খারাপ করে। “সিনেমাওয়ালা”র নতুন নিবেদন আর আসবেনা। আরেকটা দুর্দান্ত ঋতুরাগের দেবজ্যোতিতে শিরোনামের গান দিয়ে একটা ছবি শুরু হবেনা। কেন এমন “খেলা খেলা দিয়ে শেষ?”

প্রথম কিস্তি পড়ুন:

প্রসঙ্গ ঋতুপর্ণঃ শিরোনামের খেরোখাতা