জঙ্গিদের ত্রাসের নাট্যমঞ্চ

আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানী ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় অতর্কিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। সেদিন রাত পৌনে ৯টার দিকে রেস্তোরাঁটিতে প্রবেশ করে ২০ বিদেশি নাগরিকসহ ৩০ থেকে ৩৫ জনকে জিম্মি করে রাতভর হত্যাযজ্ঞ চালায় জঙ্গিরা। পরদিন সকালে রেস্তোরাঁয় জিম্মিদের উদ্ধারে কমান্ডো অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অবশ্য তার আগেই জঙ্গিদের সঙ্গে গোলাগুলিতে ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাউদ্দিন খান নিহত হন।

অভিযান শেষে বিদেশি নাগরিকসহ মোট ১৩ জনকে জীবিত এবং মোট ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। অভিযানে নিহত ছয়জনের মধ্যে নিবরাজ ইসলাম, মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওই হামলায় অংশ নিয়েছিল বলে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে পুলিশ।

নিহত ২০ জন জিম্মির মধ্যে দু’জন বাংলাদেশি, ১ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান, ৯ জন ইতালিয়ান, ৭ জন জাপানি ও ১ জন ভারতীয় নাগরিক ছিলেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে অভূতপূ্র্ব এ জঙ্গি হামলার ঘটনায় দু’দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও ন্যাক্কারজনক এ জঙ্গি হত্যাযজ্ঞের এক বছর পূর্তিতে স্বজনহারা সকলের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছে আইস টুডে পরিবার।

জঙ্গিদের ত্রাসের রাজনীতি নিয়ে লিখেছেন বহুল পঠিত স্যাপিয়েন্স বইয়ের লেখক ইউভাল নোয়াহ হারারি। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় আলোচিত এই কলামটি প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের ৩১শে জানুয়ারি। প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় আইস টুডের পাঠকদের জন্য এটির অনুবাদ প্রকাশ করা হল।

টেররিজমের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে টেরর বা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা। টেররিজম বা জঙ্গিবাদ হচ্ছে এমন এক সামরিক কৌশল যা প্রথাগত উপায়ে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি করার বদলে ভয় ছড়িয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে। দুর্বল সংগঠনগুলো, যাদের প্রতিপক্ষের জানমালের ব্যাপক আকারের ক্ষতি করার সামর্থ্য নেই, তারাই প্রায় সর্বদাই এই কৌশল গ্রহন করে। প্রতিটি সামরিক অভিযানই কোন না কোন ভাবে জানমালের ক্ষতি করে কিন্তু প্রথাগত যুদ্ধে ভীতি হচ্ছে এই ক্ষতির একটি উপজাত মাত্র এবং যা নির্ভর করে জানমালের ক্ষতির মাত্রার উপর।

কিন্তু জঙ্গিবাদের বেলায় এই ভয়ই হচ্ছে একমাত্র কাহিনী এবং তাদের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি করার তুলনায় ভয় ছাড়ানোর মাত্রাটা অবিশ্বাস্যরকম বেশি। কেননা সংঘাতের মাধ্যমে রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন খুব সহজ ব্যাপার না।

ফ্রান্সের সোম নদীর তীরে জার্মান বাহিনীর সাথে যুদ্ধে ১৯১৬ সালের পয়লা জুলাই প্রায় ১৯ হাজার বৃটিশ সৈন্য নিহত হয় এবং প্রায় ৪০ হাজার আহত হয়। যতোদিনে এই যুদ্ধ শেষ হয়, অর্থাৎ নভেম্বর নাগাদ যুদ্ধে দশ লাখের বেশি হতাহত হন যার মধ্যে নিহতই হন তিন লাখ। অথচ এই অবিশ্বাস্য হত্যাযজ্ঞের পরেও ইউরোপের রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। আরো দুই বছরের যুদ্ধ এবং আরো প্রায় দশ লাখ মানুষ হতাহতের পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কিছু প্রভাব দেখা যায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথা পুরোটা বাদ দিলেও, সোমের সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের তুলনায় সংখ্যার বিচারে জঙ্গিবাদ তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপার। কেননা বেশিরভাগ জঙ্গি হামলায় হতাহত হয় গুটিকেয়ক লোক।

জঙ্গিবাদের তুলনায়, যেকোন দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক বেশি মানুষ মারা যায়, বজ্রপাতের কারণেও মৃত্যু ঘটে অনেক বেশি মানুষের। বস্তুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জঙ্গি হামলার থেকে তিনগুন বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে বাথটাবে পা পিছলে।

কিছু কিছু জঙ্গি হামলা যেমন ১৯৮৮’র লকারবি প্যান এম ফ্লাইট ১০৩-এ বোমা হামলায় কয়েকশ’ মানুষ মারা গিয়েছিলেন এবং ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ার হামলায় প্রায় তিন হাজার মানুষ নিহত হন, কিন্তু এই সব মৃত্যুর ঘটনাও প্রথাগত যুদ্ধের ক্ষতির তুলনায় কিছুই না। যদি ১৯৪৫ সাল থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত ইউরোপে বিভিন্ন ধরনের জঙ্গি হামলা, মানে- জাতীয়তাবাদী, ধর্মীয়, বাম ও ডানপন্থী সংগঠনগুলোর হামলা মিলিয়ে যত লোক হতাহত হয়েছে তার সংখ্যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ছোটখাট যেকোন লড়াই, যেমন এইনের তৃতীয় যুদ্ধ (হতাহত দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার) অথবা ইসোনজোর ১০ম যুদ্ধ (দুই লাখ পঁচিশ হাজার) থেকে কম।

তাহলে জঙ্গিরা কিভাবে আশা করে যে তারা বিরাট প্রভাব ফেলবে?  

জঙ্গিরা যাদের শত্রু মনে করে তাদের ওপর হামলার পরেও কিন্তু সেসব শত্রুদের সমান সংখ্যক সৈন্য, ট্যাঙ্ক এবং রনতরী থাকে। জঙ্গিদের শত্রুদের যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাস্তা আর রেলওয়েও প্রায় অটুট থাকে। কলকারখানা, বন্দর বা সামরিক ঘাঁটিগুলোর উপরেও প্রায় কোন আঘাতই আসে না। কিন্তু শত্রুপক্ষের উপর প্রায় আঁচড়ই ফেলতে না পারলেও জঙ্গিরা আশা করে যে ভয় ও দ্বিধার কারণে তাদের শত্রুরা নিজেদের শক্তির অপব্যবহার করবে।

জঙ্গিরা মূলত: তাই-চি গুরুদের মত- তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে শত্রুদেরকে তাদেরই শক্তি দিয়ে বধ করা। যেমন, বলা যায় যে ফরাসিরা ১৯৫০ এর দশকে আলজেরিয়াতে এফএলএন বা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রণ্টের কাছে পরাস্ত হয়নি বরং তারা পরাজিত হয়েছিল ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রণ্টের জঙ্গিবাদের জবাব দিতে গিয়ে নিজেদের বিভ্রান্ত প্রতিক্রিয়ার জেরে। ইরাকে আর আফগানিস্তানে আমেরিকার বিপর্যয়ের কারণ তাদের নিজেদের শক্তির বিপুল অপব্যবহার, আল-কায়েদার পেশিশক্তি নয়।

জঙ্গিরা হিসেব করে যে, তাদের ক্রোধান্বিত শত্রুরা যখন বিপুল শক্তি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাবে তখন ব্যাপক সামরিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম হবে যা জঙ্গিদের নিজেদের পক্ষে কখনো তৈরি করা সম্ভব না। প্রতিটি অস্থিরতার সময় নানা ধরণের অযাচিত ঘটনা ঘটে। ভুল হয়,  অত্যাচার হয়, জনমত বিক্ষুদ্ধ হয়, প্রশ্নের জন্ম হয়, নিরপেক্ষরা নিজেদের অবস্থান বদলে ফেলে এবং এতে করে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তিত হয়। জঙ্গিরা আগেই বলতে পারে না যে, আসলে কি হবে কিন্তু রাজনীতির সাগর শান্ত থাকার চেয়ে বরং বিক্ষুদ্ধ হলেই তাদের মাছ শিকারের বেশি সুযোগ তৈরি হয়।

পাশার দান উলটে দেয়া

সামরিক কৌশল হিসেবে জঙ্গিবাদ খুবই অনাকর্ষণীয় কেননা এতে সমস্ত জরুরি সিদ্ধান্তের ভার বিপক্ষের উপর ছেড়ে দেয়া হয়। যেহেতু জঙ্গিরা নিজেরা খুব বড়রকমের জানমালের ক্ষতি করতে পারে না ফলে হামলার আগে যেমনটা, তেমনি হামলার পরেও প্রতিক্রিয়া কি হবে সেটা সম্পূর্ণ তাদের শত্রুদের প্রতিক্রিয়ার উপরেই নির্ভর করে। প্রথাগতভাবে সামরিক কৌশলগুলো এইধরণে পরিস্থিতি যেকোন মূল্যে এড়িয়ে চলে। যখন জঙ্গিরা আক্রমণ করে তখন তারা সাধারণত শত্রুদের আক্রমণে উদ্ধুদ্ধ করে না বরং চেষ্টা করে শত্রুদের শক্তিক্ষয় করতে এবং বিশেষত তাদের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্রগুলোকে ধ্বংস করে দিতে চেষ্টা চালায়।

উদাহরণস্বরুপ বলা যেতে পারে, জাপানিরা ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় ঘাঁটি পার্ল হারবার আক্রমণ করে তখন তারা একটা বিষয়ে নিশ্চিত ছিলো যে, আমেরিকানরা যেই সিদ্ধান্তই নিকনা কেন ১৯৪২ সালে তাদের পক্ষে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় রনতরী পাঠানো অসম্ভব।

যখন আর কোন উপায় থাকে না তখন শত্রুর অস্ত্রশস্ত্রের কোনরকম ক্ষতি না করে তাকে আক্রমণে প্ররোচিত করা একধরনের মরিয়া চেষ্টা। যখন সত্যি সত্যি বিপক্ষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করার ক্ষমতা থাকে তখন কেউ কেবল জঙ্গিবাদের কথা ভাবে না। যদি ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে পার্ল হারবার অক্ষত রেখে যুক্তরাষ্ট্রকে প্ররোচিত করতে জাপান যদি একটি মার্কিন বেসামরিক জাহাজে টর্পেডো হামলা করতো তবে সেটা হতো পাগলামির সামিল।

কেউ কেউ জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে কারণ তারা জানে যে, তাদের পক্ষে যুদ্ধ লাগানো সম্ভব না, এই কারণে তারা একটি নাটকীয় দৃশ্যের জন্ম দিতে চায়। জঙ্গিরা সামরিক বড়কর্তাদের মতো ভাবে না বরং ভাবে নাটকের পরিচালকদের মতো করে।

৯/১১ এর জনস্মৃতির কথাই ধরা যাকঃ যদি মানুষেকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ কি হয়েছিল, বেশিরভাগই বলবে যে, আল-কায়েদা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার ধ্বংস করেছিল। অথচ সেই আক্রমণ কেবল টাওয়ারগুলোর উপরেই হয়নি; আরো দুইটি আক্রমন হয়েছিল, বিশেষত পেন্টাগনের উপরেও হয়েছিল একটি সফল হামলা। তবু কেন এত কম সংখ্যক মানুষ এটি খেয়াল করে? যদি ৯/১১ কোন প্রথাগত সামরিক অভিযান হত তবে পেন্টাগনের আক্রমণই বেশী দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। সেই আক্রমনে আল-কায়েদা শত্রুর মূল ঘাঁটির একটি অংশ ধ্বংস করতে সক্ষম হয়, সিনিয়র কমান্ডার ও অ্যানালিস্টদের হতাহত পর্যন্ত করে। কেন জনস্মৃতি দুইটা বেসামরিক দালান আর বীমা কোম্পানির দালাল ও হিসাবরক্ষকদের হত্যাটাই কেবল মনে রাখে?

এর কারণ পেন্টাগন মোটামুটি সাদাসিধে ধরনের একটি ইমারত অথচ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার একটি লম্বা, ফ্যালিক টোটেম ধরনের ইমারত যা এক নাটকীয় দৃশ্যর মাধ্যমে ধসে পড়ে। যারা এই ধসে পড়ার দৃশ্যটি দেখেছেন তারা কখনো সেটি ভুলতে পারবে না। আমরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে বুঝি যে, জঙ্গিবাদ আসলে নাট্যমঞ্চ এবং একারণে একে বস্তুগতভাবে না দেখে আবেগ দিয়ে দেখি। ধারণা করা যায় যে, ওসামা বিন লাদেন হয়তো পেন্টাগনে হামলা না চালিয়ে আরো বেশি দর্শনীয় লক্ষ্যবস্তু যেমন স্ট্যাচু অফ লিবার্টিতে হামলা চালাতে বেশি উৎসুক ছিলেন। এটা সত্য যে, এতে অনেক অল্প লোক মারা যেত এবং সামরিক সম্পদের কোনই ক্ষতি হতো না। কিন্তু ভাবুন, কি মারাত্মক রকমের নাটকীয় দৃশ্যর অবতারণা করতো সেটি।

জঙ্গিবাদীদের মতো, যারা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তাদেরও আর্মি জেনারেলদের মতো না ভেবে নাটকের পরিচালকদের মতো ভাবা উচিত। সর্বোপরি, আমরা যদি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কার্যকরীভাবে লড়াই করতে চাই তবে আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে, জঙ্গিরা যাই করুক আমাদের হারাতে পারবে না। কেবলমাত্রই আমরা নিজেরাই নিজেদের হারাতে পারি যদি আমরা জঙ্গিদের প্ররোচনায় ভুলভাবে অতিপ্রতিক্রিয়া দেখাই।

জঙ্গিরা এক অসম্ভব লক্ষ্যে ছোটেঃ জঙ্গিদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তারা রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে নিজেরাই একটি অসম্ভব চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় আর তা হচ্ছে রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হবে যে, সে তার সমস্ত নাগরিককে যেকোন সময় যেকোন জায়গায় রাজনৈতিক সংঘাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম। জঙ্গিরা আশা করে যে রাষ্ট্র এই অসম্ভব লক্ষ্যের পেছনে ছুটতে গিয়ে রাজনীতির দাবা খেলায় এমন কিছু ভুল চাল চালবে যা থেকে জঙ্গিরা ফায়দা তুলতে পারে।

এটা সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কঠোরভাবে জঙ্গিদের দমন করতে সমর্থ হয়। তবে অনেক সময় অতি-কঠোরতা ভিন্নরকম ফল বয়ে আনে, এবং সে কারণে জঙ্গিরা এই জুয়া খেলার উৎসাহ পায়।

একজন জঙ্গি হচ্ছে জুয়া খেলার সময় বাজে তাস পাওয়া একজন জুয়াড়ির মতো যে অন্যদের রাজি করাতে চেষ্টা করে যে তাসগুলো নতুন করে বেঁটে খেলা হোক। এতে তার কিছু হারানোর নেই, বরং পাওয়ার আছে পুরোটাই।

বিশাল ফাঁকা কলসিতে ছোট্ট একটি পয়সা

কিন্তু রাষ্ট্র কেন নতুন করে তাস বাঁটতে রাজি হবে? যেহেতু জঙ্গিবাদের ফলে ক্ষতি হওয়া জানমালের পরিমাণ নগন্য তাত্ত্বিকভাবে রাষ্ট্র হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে অথবা ক্যামেরার চোখ আর মাইক্রোফোন এড়িয়ে এদের কঠোরভাবে দমন করতে পারে। কিন্তু প্রায়ই রাষ্ট্র তার মেজাজ হারিয়ে ফেলে এবং জনসম্মুখেই অযাচিত শক্তি প্রদর্শন করে, ফলে জঙ্গিদের হাতের পুতুল হয়ে ওঠে।

কিন্তু জঙ্গিদের প্ররোচনায় রাষ্ট্র এতো সংবেদনশীল কেন? কারণ আধুনিক রাষ্ট্রের বৈধতা নির্ভর করে নিজের জনগণকে রাজনৈতিক সংঘাত থেকে মুক্ত রাখার প্রতিজ্ঞা করার উপর।

কোন একটি শাসনামল মারাত্নক দুর্যোগ সামলে এমনকি একে উপেক্ষা করেও টিকে থাকতে পারে যদি তার বৈধতা সেটিকে প্রতিহত করার উপর ভিত্তি করে না হয়। অন্যদিকে একটি শাসনামল ছোট্ট একটি সমস্যার কারণেই ধসে যেতে পারে যদি তার উপরেই এর বৈধতা নির্ভর করে। চতুর্দশ শতকে ইউরোপের এক-চতুর্থাংশ লোক ব্ল্যাক ডেথ বা প্লেগে মারা যায় কিন্তু যদিও কোন রাজা এটিকে ঠেকানোর তেমন কোন উদ্যোগ নেননি তথাপি এদের একজনও এই কারণে ক্ষমতা হারাননি। কেউ সে সময় ভাবতোই না যে প্লেগ ঠেকানো রাজার কর্তব্য। অন্যদিকে যেসব শাসকেরা তাদের রাজ্যে প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধ মত প্রকাশের সুযোগ দিতেন তাদের অনেকেই কেবল সিংহাসনই নন গর্দানের উপরের মাথাটাও খোয়াতেন।

আজকের দিনে একটি সরকার গৃহস্থলী বা যৌন নির্যাতনের ব্যাপার উপেক্ষা করতে পারে কেননা তাদের বৈধতা এর উপর নির্ভর করে না। যেমন, ফ্রান্সে প্রতি বছর হাজারের উপর ধর্ষণ মামলা হয় এবং আরো অনেকগুলো তো রিপোর্টও হয়না। ধর্ষক আর অত্যাচারী স্বামীরা যেহেতু রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি না, কেননা ঐতিহাসিকভাবে রাষ্ট্র যৌন নিপীড়ন নির্মূল করবে এই প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে নির্মিত নয়। বিপরীতে,  তুলনায় অনেক কম সংগঠিত জঙ্গিবাদকে জীবনের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা হয়। কেননা গত কয়েক শতকে আধুনিক পশ্চিমা রাষ্ট্র ধীরে ধীরে তাদের বৈধতা নির্মান করেছে এই বিষয়ে উপর যে তারা তাদের সীমানার ভেতর রাজনৈতিক সংঘাত শূণ্যতে নামিয়ে রাখবে।

মধ্যযুগে জনজীবনে রাজনৈতিক সংঘাতের ছড়াছড়ি ছিলো। শুধু তাই না সংঘাত করতে পারার ক্ষমতাই ছিলো রাজনৈতিক মাঠে প্রবেশের চাবিকাঠি এবং যার সেটিতে কমতি ছিলো তার রাজনৈতিক ভাবে মতামত দেয়ার কোন অধিকারই থাকতো না। কেবল কিছু অভিজাত পরিবারই অস্ত্র আর বাহিনী পুষতো না; শহর, গঞ্জ, গির্জা এবং উপাসনালয়েরও ছিল নিজস্ব বাহিনী। যদি কোন ধর্মগুরু মারা যেতেন এবং তার উত্তরাধিকার নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব হতো এবং আকছার বিষয়টার নিষ্পত্তি হত অস্ত্রের ব্যবহারে।

ঐ ধরণের দুনিয়ায় জঙ্গিবাদের কোন জায়গা ছিলো না। যারা ব্যাপকভাবে জানমালের ক্ষতি করতে না পারতো তাদের কোনো গুরুত্বও ছিলো না। যদি ১১৫০ সালে কিছু উগ্রপন্থী মুসলমান জেরুজালেমের গুটিকতক বেসামরিক লোককে হত্যা করে দাবি করতো যে ক্রুসেডারদের পবিত্র ভূমি ছেড়ে চলে যেতে হবে তবে সে দাবি ত্রাস হিসেবে নয়, হাস্যকর আবদার হিসেবে ব্যঙ্গ হিসেবেই বিবেচিত হতো। দাবিটার গুরুত্ব বোঝাতে হলেও অন্তত দুই-একটা কেল্লা দখল জরুরি ছিলো। জঙ্গিবাদের মতো ব্যাপার নিয়ে আমাদের মধ্যযুগীয় পূর্বপুরুষেরা মাথা ঘামাতেন না কারণ তাদের এর থেকে অনেক গুরুতর ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হতো।

আধুনিক যুগে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রগুলো নিজেদের সীমানার ভেতর রাজনৈতিক সংঘাত হ্রাস করেছে এবং অন্তত গত কয়েক দশকে পশ্চিমা দেশগুলো একে প্রায় শূণ্যের কোটায় নিয়ে গেছে। তাদের জনগণ শহর, সংগঠন এমনকি সরকারেরও নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে কোন পেশিশক্তির প্রদর্শণ ছাড়াই। একটিও গুলি না ছুঁড়ে শত শত কোটি টাকা, হাজার হাজার সৈন্য, জাহাজ, বিমান এবং নিউক্লিয়ার বোমার নিয়ন্ত্রণ চলে যেতে এক দল রাজণীতিবিদ থেকে আরেক দলের হাতে। মানুষ দ্রুত এতে মানিয়ে নিয়েছে এবং একে তার স্বাভাবিক অধিকার বলেই ভাবে। ফলশ্রুতিতে বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক সংঘাতে যদি গুটিকয়েক মানুষ মারাও যায় তবে সেটি রাষ্ট্রের বৈধতা এমনকি অস্তিত্বের হুমকি হিসেবেই দেখা হয়। একটি বড় ফাঁকা কলসে ছোট্ট একটি পয়সা ফেললেও অনেক বেশি আওয়াজ হতে পারে।

এটিই জঙ্গিবাদকে এতো সফল করে তোলে। রাষ্ট্র রাজনৈতিক সংঘাত শূন্যতার এক বিশাল ফাঁকা স্থান তৈরি করেছে। এই স্থানটিই ছোট্ট আওয়াজকেই বিশাল আওয়াজে পরিণত করে। একটি রাষ্ট্রে যতো কম রাজনৈতিক সংঘাত হয় জঙ্গিবাদ তার জনগণের মধ্যে ততো বেশি ভীতির সঞ্চার করতে পারে। প্যারিসে ১৭ জনের হত্যাকান্ড তাই অনেক বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাইজেরিয়া বা ইরাকের শত শত হত্যাকান্ডের থেকে। অর্থাৎ আধুনিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংঘাত এড়নোর সাফল্যই একে জঙ্গিবাদের জন্য অরক্ষিত করে তোলে। যে ত্রাস মধ্যেযুগের কোন রাজত্বে তেমনভাবে কেউ খেয়ালই করতো না, সেটি অনেক বেশী শক্তিশালী আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে।

যেহেতু নাগরিকেরা রাজনৈতিক সংঘাত শূণ্যতায় অভ্যস্ত তাই ত্রাসের নাট্যমঞ্চ তাদের ভীত করে তোলে সামাজিক ব্যবস্থা ধসে পড়লো বলে।

শতাব্দীর পর শতাব্দী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর আমরা সংঘাতের কৃষ্ণ গহ্বর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়েছি কিন্তু এখনো আমরা টের পাই যে, সেই গহ্বর এখনো বিদ্যামান আর সেই অনুভূতি আমাদের ভীত করে তোলে। কিছু নিদর্শন দেখেই আমরা কল্পনা করে নেই যে সব কিছু ভেঙ্গে পড়ছে।

এই ভয়কে দূর করার জন্য রাষ্ট্র তার নিজের নিরাপত্তার নাট্যমঞ্চে জবাব দিতে চালিত হয়। জঙ্গিবাদের সবচেয়ে কার্যকরী উত্তর হচ্ছে দক্ষ গোয়েন্দাবাহিনী এবং যেই নেটওয়ার্ক ও অর্থ জঙ্গিবাদকে লালন করে এদের বিরুদ্ধে নীরবে অভিযান চালানো। কিন্তু সেটা তো জনগণ টেলিভিশনে দেখতে পাবে না। যখনই জনগণ টেলিভিশনে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধসে যাবার জঙ্গিবাদী নাটক দেখে তখনই রাষ্ট্র তাড়িত হয় একইরকম দর্শনীয় এক প্রতিনাটকের যাতে আরো বেশি আগুন আর আরো বেশি ধোঁয়া হবে। ফলে নীরবে ও কার্যকরভাবে অভিযানের বদলে এটি এক ঝড় তোলে যা আদতে জঙ্গিবাদীদের সবচেয়ে আকাঙ্খিত লক্ষ্যটাই পূরণ করে দেয়।

এই লেখাটির অনুবাদক ইউভাল নোয়াহ হারারির বিখ্যাত স্যাপিয়েন্স বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন যা অচিরেই প্রকাশিত হবে।