পৃথিবীতে প্রথম কৃষিকাজের পত্তন নারীদের হাতে। কালের আবর্তে কৃষিকাজ অবশ্য ‘মরদ’ লোকের কাজ হয়ে উঠে, নারীর ভূমিকা হয়ে পড়ে গৌন। ঠিক একইভাবে কিছু কিছু একেবারেই ‘পুরুষালী’ খেলার জন্ম তাদের হাত দিয়ে। ইতিহাসবিদদের একটি অংশের ধারণা, পনের শতকের দিকে দক্ষিন-পূর্ব ইংল্যান্ডে শিশু ও নারীদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় একধরনের খেলা ক্রেকেট থেকেই এসেছে আজকের ক্রিকেট। যদিও অনেকেরই তাতে দ্বিমত আছে।
ইংল্যান্ডের নারীদের প্রতিযোগীতামূলক ক্রিকেটের হদিস পাওয়া যায় সতরো শতক থেকেই। আর ক্রিকেটের সবচেয়ে যুগান্তকারী পরিবর্তনটি ঘটেছিল ক্রিস্টিনা উইলিস নামের এক নারীর হাতেই (আক্ষরিক অর্থেই)। নিয়মিতই ছেলেদের সাথে বিশেষত ভাই জন উইলিসের সাথে ক্রিকেট খেলতেন তিনি। সে যুগে আন্ডারআর্ম বা হাত না ঘুরিয়ে বোলিংয়ের চল ছিল যদিও ক্রিস্টিনা নিজের স্কার্ট সামলানোর জন্য শুরু করেন ওভারআর্ম বা হাত ঘুরিয়ে বোলিং। তাঁর আগে হ্যামবোল্ডন ক্লাবের টম ওয়াকার প্রথম ওভারআর্ম বোলিং করলেও এই পদ্ধতির বোলিং কৌশলের দারুণ উন্নতি ও ক্রিকেটে সেটাকেই নিয়মে পরিণত করার কৃতিত্ব ক্রিস্টিনার।
অবশ্য, আধুনিক একদিনের ম্যাচও খেলেছে মেয়েরাই প্রথম। ইংল্যান্ডের প্রথম শ্রেণির নারী দলগুলো ১৯৬২ সালে একদিনের ম্যাচ খেলে আর যার নয় বছর পর পুরুষেরা খেলতে শুরু করে ওডিআই। এমনকি বিশ্বকাপও হয়েছে নারীদেরই প্রথম। তারা প্রথম বিশ্বকাপ খেলে ১৯৭৩ সালে, পুরুষদের থেকে দুই বছর আগে। অবশ্য সে বছর প্রাইজমানি হিসেবে চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড নারী দলের খেলোয়াড়রা একটি টাকাও পাননি।
অস্ট্রেলিয়ার বেলিন্ডা ক্লার্ক প্রথম মানুষ হিসেবে ওডিআইতে দ্বিশত রানের ইনিংস খেলেন সেই ১৯৯৭ সালে আর সেটার তের বছর পরে শচীন টেন্ডুলকার প্রথম পুরুষ হিসেবে সেই কীর্তি করেন। নিউজিল্যন্ড দল ১৯৯৭ সালে পাকিস্তানের সাথে ওডিআই ইতিহাসে প্রথম ৪০০ রান পার করে আর এর ঠিক এক দশক পর প্রথম পুরুষ দল হিসেবে ভারত সেটি করে ২০০৭ বিশ্বকাপে বারমুডার বিপক্ষে।
এবছর এগারোতম ( ছেলেদেরও এগারোটা বিশ্বকাপ হয়েছে এ যাবত) আসরে এসে অবশেষে ২০ লাখ ডলার প্রাইজমানি ঘোষিত হয়েছে আর বিজয়ী দল ইংল্যান্ড পেয়েছে সেটির তিনভাগের একভাগ, ছয়লাখ ষাট হাজার ডলার।
এগারোতম নারী বিশ্বকাপের প্রতিটি খেলা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে। ভারত, যারা অল্পের জন্য ফাইনালে হেরে যায়, তাদের প্রত্যেক সদস্যকে বিসিসিআই ৫০ লাখ রুপি পুরষ্কার দিয়েছে। এ আসরের প্রতিটি ম্যাচে দর্শক বেড়েছে গত আসরের প্রায় দ্বিগুন হারে।
এসেছে নতুন তারকা। সেমিফাইনালে ১৭১ করা হারমানপ্রীত কাউর, ফাইনালের নায়ক এনিয়া শ্রুবসোল, লেগ স্পিনার পুনম যাদব উঠে এসেছেন এই আসরেই। ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে থাকা ভারতের অধিনায়ক মিতালী রাজ ও ঝুলন গোস্বামী, দুজনেই পরিণত হয়েছেন লাখো লাখো নারীর আইডলে।
একটা সময় টেনিস খেলোয়াড়দের বেতনের ব্যাপারে লৈঙ্গিক বৈষম্য হলেও এখন তা নেই, এবং ফেদেরারদের সাথে সেরেনারাও এখন সার্কিটে সমান জনপ্রিয়। দাবার জুডিথ পোলগার বা গলফের এনিকা স্টরেনস্ট্রমরা পুরুষদের সাথে খেলে নিয়মিত জিতেছেন। যদিও ঝুলনদেরকে নিয়মিত পুরুষদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে আরো বহুদূরের পথ পাড়ি দিতে হবে।
তবে সেটা ভবিষ্যতের বিষয়, এই বিশ্বকাপ নিয়ে আগ্রহ ভারত আর বাংলাদেশের মতো দেশের সমাজে একটা ইতিবাচক প্রভাব রাখতে শুরু করেছে। মিতালী রাজের মতো ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়া নারীও একসময় বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিংয়ে অস্বস্তিবোধ করতেন পুরুষদের অশ্লীল মন্তব্যর ভয়ে। যদিও, খেলাটার প্রতি আরো আগ্রহ, মিতালীদের প্রতি সম্মান আরো বাড়াবে, অশ্লীল পুরুষদের আচরণে প্রতিবাদ বাড়বে-সবস্তর থেকেই। আর্মচেয়ার নারীবাদীদের হাজার হাজার তত্ত্বের চেয়ে একজন দুর্দান্ত নারী ব্যাটসম্যান বা বোলার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ভেঙ্গে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা জাগাতে বেশি ভূমিকা রাখবেন।
ঝুলন, মিতালী, বেলিন্ডাদের পরবর্তী প্রজন্মের সেজন্য আরো সুযোগ পাওয়া জরুরি। অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের পথ ধরে প্রতিটি দেশে বিভিন্ন ঘরোয়া লিগ শুরুর হলে বা ভারতের মতো আইপিএলের আদলে নারীদের ক্রিকেট লিগ চালু হলে নারী ক্রিকেট আরও প্রসার লাভ করবে। এই নারীদের ক্রিকেট দিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটের মানচিত্রে বড় বিপ্লব ঘটানো সম্ভব যেমনটা আমেরিকাতে ফুটবলের ক্ষেত্রে হয়েছে, নারীদের ফুটবল দিয়ে। কয়েক বছর আগেও গড়পড়তা মার্কিনিদের ধারণা ছিল ফুটবল নাকি নারীদেরই খেলা, কেননা ওদেশে পুরুষের তুলনায় নারীরাই এটি বেশি খেলে। পুরুষদের ফুটবলে আমেরিকা যেখানে একেবারেই আলোচনায় করার মানের দল না, সেখানে নারীদের আসরে তারা অবিসংবাদিতভাবে সেরা। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফুটবলে তাদের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী কারা? চীন! বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ চীন! সে দেশেও ফুটবলের প্রসার হয়েছে নারীদের খেলাকে ঘিরেই।
এই মডেল ক্রিকেটেও কাজ করতে পারে কারণ আইসিসি বহুবছর ধরে ক্রিকেটের বিশ্বায়নের চেষ্টা করে চললেও সাফল্য সীমিত। ফিফার দুর্নীতির মডেল না শিখে রফতানি মডেল থেকে শিক্ষা নিয়ে ক্রিকেটও এই পথে গেলে সামগ্রিক ভাবে ক্রিকেটের বিশাল উন্নতি হওয়া একদমই অসম্ভব না!