সক্কাল সক্কাল বাংলাদেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমের টপ নিউজ- তামিম ইকবাল। জাতীয় দলের ড্যাশিং এই ওপেনার এসেক্সের হয়ে বিলেতের ঘরোয়া লিগে মাত্র একটা ম্যাচ খেলেই দেশে ফিরছেন।
হুট করে মৌসুমের শুরুতেই দেশে ফেরার কারণ ইংল্যান্ডে তার স্ত্রীর উপর বর্ণবাদী হামলা! তামিমের স্ত্রী হিজাব করেন এবং সাম্প্রতিক সময়ে ইংল্যান্ডে বাদামী চামড়ার, বিশেষত মুসলিমদের উপর একাধিক সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে।
অবশ্য তামিম এখনও (এই লেখা শেষ হওয়া পর্যন্ত) বর্ণবাদী কোন দুর্ঘটনার কথা গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেননি। তাঁর ভেরিফায়েড অফিসিয়াল ফেসবুক পেজের ভাষ্য হচ্ছে, একান্ত ব্যক্তিগত কারণে পরিবার অর্থাৎ স্ত্রী ও পুত্র নিয়ে দেশে ফিরেছেন তিনি। সুতরাং এই ব্যাপারে অন্য কোন কিছু না খোঁজাই আপাতত সমীচীন। কিন্তু ভদ্দরলোকের খেলা হিসেবে পরিচিত ক্রিকেট কি আসলেই বর্ণবাদ-বৈষম্য থেকে মুক্ত?- আসুন না জেনে নিই সত্যিকারের কিছু গল্প।
ক্রিকেটের সাথে অন্য সব খেলার পার্থক্য হচ্ছে সর্বতোভাবেই ক্রিকেট রাজকীয় এক খেলা। ভিক্টোরিয়ান বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের উজ্জ্বলতম প্রতীক- ক্রিকেট। জাহাজে করে নিজেদের প্রতিটি উপনিবেশেই চুরি-জোচ্চুরি সাথে সাথে ক্রিকেটকেও বয়ে নিয়ে গেছে তারা। একজন আদর্শ বৃটিশ ভদ্রলোকই খাঁটি ক্রিকেটের দর্শনকে ধারণ করতে পারেন-এই ছিল তাদের দাবি। সাদা চামড়ার মানুষেরা বাদে নওয়ানগড়ের জামসাহেব কিংবা পতৌদির নবাবের মতো রাজানুগ্রাহী উঁচু জাতের মানুষই কেবল যে খেলা খেলতে পারে।
ক্রিকেটে খেলোয়াড়কে হতে হয় স্থিতধী, ভুল শুদ্ধ যাই হোক কর্তৃপক্ষ ( আম্পায়ার) এর সিদ্ধান্ত মেনে নেয়াটা যে, আদর্শ ক্রিকেটারের সবচেয়ে বড় গুণ ঠিক যেমনভাবে একজন আদর্শ নাগরিক রানী বা শাসকের সিদ্ধান্ত মেনে নেন।
ক্রিকেটে দরকার ধৈর্য্য, ৫ দিন ধরে টিকে থাকা, খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলে প্রতিপক্ষের সাথে হাতাহাতি তো দূরে থাক শরীরের স্পর্শও হবে না। আক্রমণের হাতিয়ার হবে হাতের ব্যাট বা বল। খেলাটার গতি ধীর, মাঝখানে লাঞ্চ হবে, টি ব্রেক হবে, ওভারে ওভারে থাকবে কিছুটা বিরতি। অধিনায়ক যুদ্ধক্ষেত্রের সেনাপতির মতো দলকে নেতৃত্ব দেবেন। একেবারে বৃটিশরা যে ধরনের গণতন্ত্র, ঝালহীন চিকেন খেতে চায় তার আদর্শ প্রতিচ্ছবি হচ্ছে ক্রিকেট মাঠ।
ক্রিকেট খেলাটা আসলে জন্ম থেকেই বর্ণবাদী। সেজন্যই বৃটিশরা খেলাটিতে অন্য ‘ছোট জাত’-দের সুযোগ দিতে চাইতো না। শুধু তাই না, নিজেদের মধ্যেও ‘এলিট’ বা ‘জেন্টলম্যান’রা করতো ব্যাট আর যারা ‘ওয়ার্কিং ক্লাস’ বা ‘প্রফেশনালস’ তারা করতো বল। সে যাই হোক, সে বিশাল আলাপ। এই তালে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, দুনিয়ার সর্বপ্রথম ‘মেগা সেলিব্রেটি’ ক্রিকেটার ডব্লিউ জি গ্রেস ছিলেন ‘জেন্টলম্যান’, সন্দেহ নেই যে গ্রেস যেকোন বিচারেই ক্রিকেট ইতিহাসের সেরাদের একজন, কিন্তু প্রশ্ন জাগে, যদি তিনি ‘প্রফেশনাল’ হতেন তবে কি এতটা খ্যাতি পেতেন? উত্তরটা বন্ধু দুরূহ।
ক্রিকেট খেলাটাতে এত বর্ণবাদের গন্ধ মাখা থাকলেও মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ক্রিকেটই আবার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদীদেরকে সুযোগ দিয়েছে। ফুটবল খেলাটা যতোই জনপ্রিয় হোক না কেন, দিনশেষে ‘লর্ড’ বা অভিজাতগোছের লোকেরা খেলাটা খেলে না বা খেলতে পারে না। বৃটেন বা অন্য দেশে দিনশেষে ফুটবল ‘শ্রমিকশ্রেণি’-র খেলা। হয়ত তাই কেম্ব্রিজের বিখ্যাত ঐতিহাসিক জি এম ট্রেভেলিন বলেছিলেন, ফরাসি অভিজাতদের যদি তাদের প্রজাদের সাথে ক্রিকেট খেলার অভ্যাস থাকতো তবে ১৭৮৯ সালে তাদের কেল্লাগুলো পুড়িয়ে দেয়া হতো না। কারণ ক্রিকেটের মাঠ গরিবদেরও কালেভদ্রে সুযোগ দেয়।
প্রথম দিকে নিজ দেশেই বা কলোনি, অবৃটিশ বা অশ্বেতাংগরা ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেতনা। যদিও পরে ক্যারিবীয় কালো মানুষ বা ভারতের বাদামী চামড়ার মানুষ শুধু খেলেইনি, সময়ে সময়ে কলোনিয়াল প্রভুদের হারিয়েও দিয়েছে। এই দু’ অঞ্চলেই জাতীয়তাবাদ আর স্বাধীনতা আন্দোলনে তথাকথিত ‘নেটিভ’ ক্রিকেটারদের এই সাফল্য জনতাকে উৎসাহ জুগিয়েছে। সেসব আন্দোলনের মূল সুর ছিলো,‘বৃটিশ খেলা ক্রিকেটে যদি আমরা বৃটিশদের সাথে জিততে পারি, আমরা কোন দিক দিয়ে কম? একজন ভারতীয় কোনভাবেই একজন বৃটিশের চেয়ে কম নয়।’
বিংশ শতকের অন্যতম সেরা দার্শনিক সি.এল.আর জেমস ‘বিয়ন্ড দ্যা বাউন্ডারি’ বইতে ক্রিকেট খেলা নিয়ে কালো মানুষের লড়াই, তাদের বঞ্চিত করা,আবার এই রাজার খেলা ক্রিকেটে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন বহন করা তথাকথিত রাজার জাতকে একটা কঠিন বার্তা দেয়া। সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান জর্জ হেডলি বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তী লিয়ারি কন্সট্যানটাইন কখনোই অধিনায়কত্ব পাননি স্রেফ গায়ের রঙ কালো বলে। অবশ্য অবশেষে ষাটের দশকে প্রথমবারের মতো একজন কালো মানুষ, ফ্রাঙ্ক ওরেল দলের নেতা হন, এর দুই দশকের মধ্যে উইন্ডিজ দুনিয়ার সেরা দলে পরিণত হয়।
ক্রিকেট ঐতিহাসিক রমাচন্দ্র গুহ তেমনি বলেন ‘অচ্ছুত’ পালওয়াঙ্কার বালুর কথা। ‘চামার’ এই লোকটি কিভাবে তাঁর জাদুকরি বোলিং দিয়ে মাঠে কেবল বৃটিশদের হারাতো তাই না, জাতপাতের বিরুদ্ধে ভারতে মহাত্মা গান্ধীর আগে সম্ভবত তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটি ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। যাদের ছোঁয়াতেই নাকি অন্যরা অপবিত্র হয়ে যায় সেই অচ্ছুতদের একজন যখন সর্বভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয়দের একজন হন, তখন জাতের এই ফালতু ট্যাবু জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে পড়ে। আর সেটা না হলে ভারতবাসীর একজোট হওয়াও হয় না, স্বাধীনতার লড়াইও জমে ওঠে না। বালু অবশ্য শেষমেশ অধিনায়ক হতে পারেননি ওরেলের মতো, তবে হিন্দু দলের (সেসময়ে ভারতে খেলা হতো ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মাঝে) নেতা হন বালুর ভাই পালওয়াংকার ভিত্তাল। ক্রিকেটই সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল।
যেমনটা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানে সাদা মানুষদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে রঙ্গিন মানুষ (ইংরেজি কালার্ডের বাংলা অশ্বেতাংগ হওয়াই উচিত কিন্তু রঙ্গিন মানুষ বলার লোভ সামলানো দায়!) আর কুকুরদের প্রবেশ নিষেধ ছিলো। ব্যাসিল ডি অলিভেরা ছিলেন তেমনি একজন রঙ্গিন মানুষ, ক্রিকেটের পাশাপাশি দারুণ ফুটবলও খেলতে পারা ব্যাসিল দক্ষিন আফ্রিকায় বর্ণবাদের শিকার হয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন ৩০ বছর বয়সে। ৩৫ বছর বয়সে ( তবে তাঁর জীবনীকার বলেন তাকে বুড়ো বলে বাদ দেবে এই ভয়ে তিনি তিন বছর কমিয়ে বলেছিলেন) ইংল্যান্ডের হয়ে ডেবু করেন এবং ছয় বছর খেলে ৪০ গড়ে ২৪৮৪ রান করেন ও ৪৭ উইকেট পান। তবে ব্যাসিল বেশি বিখ্যাত অন্য কারণে। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের জন্য ১৯৬৮ সালে তাকে দলে নেয়া হয় কিন্তু বর্ণবাদী আইনের কারণে খেলার অনুমতি মেলেনি। সবমিলিয়ে সেই সফর পরিত্যক্ত এবং ঐ ঘটনার জেরেই ১৯৭০ সাল থেকে পরবর্তী ২০ বছর দক্ষিণ আফ্রিকাকে ক্রিকেটে নিষিদ্ধ করা হয়।
এই যুগে এসে বর্ণবাদের কালো ছায়া অনেকটাই অপসৃত হলেও সারা দুনিয়াতে হানাহানি আর জাতিগত বিদ্বেষ এতটুকুও থেমে নেই। বিশ্বায়নের এই যুগে বর্ণবাদ নিয়েছে নিজস্ব নানা আকার, শরণার্থীরা তাই এখনো রাজকীয় বৃটিশ সংবাদ মাধ্যমের ভাষায় মাইগ্রান্ট থুক্কু আশ্রয়প্রার্থী, টেররিস্ট অ্যাটাক আর ইনসিডেন্ট এখনো বড় বেশি ধর্মভিত্তিক।
দিনশেষে রাজার জাতের খেলা কিন্তু গরিবেরাই দখলে নিয়েছে। বর্ণবাদ আর আভিজাত্যের অ্যাশেজ এখন শংকর অজিদের বাঁধা ট্রফি, ব্যাক টু ব্যাক বিশ্বকাপ জিতে এখন এম্পায়ার ইজ স্ট্রাইকিং ব্যাক।