ঘাটে পা রাখতেই অবাক শরিফুল। দিন সাতেকের ছুটি কাটিয়ে বাবা-মা-বোনের কাছ থেকে বিদায়-টিদায় নিয়ে ব্যাগসমেত রিকশায় আসতে আসতে শহরের ভাড়া বাসাটার কি অবস্থা, কিংবা ঈদের পর প্রথম অফিসে নতুন পাঞ্জাবিটা পরে যেতে পারবে কি না এসব চিন্তা বাদ দিয়ে শরিফুল ভাবছিলো প্রথমেই লোকে-লোকারণ্য ঘাটের কয়টা ছবি তুলে রাখবে। তারপর তুমুল ধস্তাধস্তি করে জীবনবাজি রেখে চড়াদামে টিকিট-শিকিট কেটে সদ্য বিয়ে করা বউ সোমাকে নিয়ে লঞ্চের কেবিন, ফার্স্ট ক্লাস কিংবা যেটাই পায় সেটায় বসে সেলফি-টেলফি অ্যাড করে মানুষ উপচে পড়া ঘাটের ছবি দিয়ে চেক-ইন দেবে- “ফ্রেন্ডস, এমন ঘাটই কি আমরা চেয়েছিলাম?” ফিলিং- ডোন্ট ওয়ান্ট টু কাম ব্যাক টু দ্য যান্ত্রিক শহর। কিন্তু ঘাটে নেমে শরিফুল আর সোমা দুজনেই হতবাক। যেমনটা সচরাচর দেখে থাকে আজ তার পুরো উল্টো চিত্র। কী সুন্দর পরিচ্ছন্ন ঘাট। এই যে আষাঢ় মাসে হুটহাট বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট জলে ভিজে কাদা হয়ে থাকে, তারপরও সেখানে এক চিলতে কাদা নেই। ঠিক যেন হাতে করে গুছিয়ে রাখা। রিকশা, অটো, স্কুটার সব একপাশে সুন্দর করে সাজানো। পরিপাটি চালক সম্প্রদায়। নতুন বিয়ে করা বউয়ের সামনে ইজ্জত পুরা দুই লেভেল বেড়ে গেলো শরিফুলের।
লঞ্চে পা দিয়ে তো আরো অবাক হবার জোগাড়। শরিফুলের শার্টের হাতা টেনে বিস্মিত সোমা জিজ্ঞেস করে, “এই কোম্পানির লঞ্চেই না ঢাকা থেকা আসলাম?” শরিফুল উত্তর দেবে কি! বাকরুদ্ধ তো সে নিজেও। ঝাঁ-চকচকে কম্পাউন্ড। ফেরিওলারা ঠেলে-ধাক্কিয়ে দু’টো কাস্টমার বেশি বাগানোর চেষ্টা করছে না। চিপস, ঝালমুড়ি, ডালভাজার প্যাকেট মেঝেতে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বাহ, একটা বড়সড়ো ডাস্টবিনও রয়েছে দেখছি। টিকিটের জন্য যাত্রীদের হুড়োহুড়ি নেই। বাড়তি ক্যাওয়াস নেই। পাশাপাশি কয়েকটি লাইন ধরে টিকিট কাটছে। আর লাইনের একদম সামনে ট্যাব হাতে স্যুটেড বুটেড একজন কর্মী। হাতে রাখা ট্যাবে যাত্রীদের বিভিন্ন সিটের ডেমো দেখিয়ে টিকিট হস্তান্তর করছে। রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা কার্ডের মাধ্যমে পেমেন্টের ব্যবস্থাও। একদম যা ন্যায্য ভাড়া তাই-ই। কোনো বাড়তি বখশিশ-টখশিশের ব্যাপার নেই। ডেকের মধ্যে এমনকি একটা এটিএম বুথও দেখা যাচ্ছে। এক হপ্তার মধ্যে কী এমন ভোজবাজি হলো। শরিফুল ওসব দেখে-টেখে বউয়ের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসি দেয়। হাসির মধ্যে একটা গর্বের ছাপও আছে। যার অন্তর্নিহিত অর্থ দাঁড়ায়- “দেখলা, মোগো দ্যাশ কত্ত উন্নত। কত্ত আউগায় গ্যাছে! এক্কেরে ডিজিটাল।” লাইনে একসময় শরিফুলেরও নম্বর আসে। মুহূর্তের মধ্যে টিকিট আর কেবিনের চাবি পেয়ে আপ্লুত শরিফুল আশেপাশে টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান খোঁজে। হাসিমুখে আঙুলে বিজয়ের ‘ভি’ সাইন দেখিয়ে পোজ দিতে তার খুব ইচ্ছে করছে। ক্যাপাসিটি ফুল হয়ে যাওয়ায় একটি লাইনের কর্মী বিনীত হেসে যাত্রীদের পরের লঞ্চে যাবার অনুরোধ করে। আর কী আশ্চর্য! যাত্রীরাও মেনে নিয়ে হাসিমুখে এক এক করে বেরিয়ে গেলো। কেউ উচ্চবাচ্য করলো না। একজনও তার ঠিকুজি-বংশ বুঝিয়ে দেবে বলে লঞ্চের কর্মীদের শাঁসালো না। কী আজব! কী আজব! শরিফুল এসব দেখতে দেখতে তার জন্য বরাদ্দ ২০৩ নম্বর কেবিনে যাবার উদ্দেশ্যে বউসমেত সিড়ি দিয়ে উঠতে থাকে। সাথের লাগেজ-টাগেজ আগেই টোকেন লাগিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দেয়া হয়েছে। একদম বিমানের ফ্লাইটের মতো।
কেবিনের দরজায় চাবি ঢোকাতে হয়না। দরজার নবের সামনে একবার ঘুরিয়ে আনলেই অটো খুলে যায়। হাইটেক সিস্টেম। বাব্বাহ এসি কেবিন। ছোট্ট একটা ফ্রিজও আছে, সাথে এলসিডি টিভিও। পরিষ্কার পানির জগ, মিনারেল ওয়াটার, কি নেই। সোমা তো বেজায় খুশি। স্ত্রীর হাসিমুখ দেখে শরিফুলও খুশি হয়ে ওঠে। এই যাহ্। এই যে এত আজিব আজিব ঘটনা ঘটলো, একটারও তো ছবি তোলা হলো না। ছবি তোলার কথা ভেবে বাইরে পা বাড়ানোর আগে কেবিনের পরিবাটি বিছানাটা দেখে আটকে যায় সে। একটু গা এলিয়ে দেয়ার কথা ভাবে। ভাবে, ছবি পরে দেয়া যাবে খন। শুয়ে শুয়ে আপাতত পুরো ঘটনাটা স্ট্যাটাসে বসিয়ে দিই। বন্ধুরা জানুক, কী যুগান্তকারী পরিবর্তন এসে গেছে পৃথিবীর এ প্রান্তে। লিখতে লিখতে প্রবল উত্তেজনা ভর করে শরিফুলের মাথায়। মাথাটা কি একটু ভারি ভারিও লাগছে? সে কী! চোখ জড়িয়ে আসছে কেনো? সব দেখি ঝাপসা দেখাচ্ছে। ফোনটা তো ধরেও রাখা যাচ্ছে না।
টিরিং! টিরিং!! টিরিং!!!
শরিফুলের মোবাইলের ক্লাসিক টেলিফোন সেটের রিংটোনটা বড়ই কর্কশ। অফিসে যখন আচমকা বেজে ওঠে সবার কাজের মনোযোগ ছুটে যায়। আর আজকে ছুটে গেলো শরিফুলের নিজের তন্দ্রা। ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠে শরিফুল। ভেবে পায় না ২০৩ নম্বর কেবিনের সামনের ওইটুকুন জায়গায় খবরের কাগজ বিছিয়ে রাজ্যের বস্তা ব্যাগ আর লঞ্চভর্তি মানুষের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া আর হৈচৈ আওয়াজের মাঝে বেকায়দা বসেও কীভাবে সে এক ঘুম দিয়ে দিলো। পাশে স্ত্রীকে দেখে মায়াই লাগলো। প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলো ঈদ করতে। আসার পথে এই বিড়ম্বনা, আর তাকে ওভাবে রেখে শরিফুল নাকি ঘুমিয়েছে বেঘোরে। লজ্জায় তাকাতে পারছিলো না। ওকে কি একটু বিরক্ত দেখাচ্ছে। দেখাবেই তো। যে বিরক্তিকর রিংটোন। বিরক্ত আশেপাশের বারান্দা-সিটিং যাত্রীরাও। ভ্যাপসা গরমে বিরক্তি-ঘেমে একাকার শরিফুলের হুশ হয়। ফোনটা পকেট থেকে বের করে আনে। ওহ্, বাড়িওয়ালার কল। রিসিভ করতেই সদরঘাটে এত এত সব মানুষের গুঞ্জন-চেঁচামেচির মধ্যেও তার ঝাঁঝালো কণ্ঠ কানে বাজলো। কানে তো বাজলোই, মাথায় বাজও পড়লো। “আপনাদের কি একটু কমন সেন্সও নেই। ঈদের দুইদিন আগে থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি, ফোন বন্ধ বন্ধ বন্ধ (শরিফুলের কি দোষ, বাড়িতে নেটওয়ার্ক আসে-যায় খালি। এর জন্য তো পুরো এক সপ্তায় ফেসবুকে একটা ছবিও আপ করতে পারলো না) …। বাড়ি গেছেন বুঝলাম, ফোন বন্ধ রাখবেন তাও বুঝলাম। কিন্তু কিচেনের পানির কলটা তো বন্ধ করে যাবেন! পুরো ফ্ল্যাট পানিতে ভেসে একাকার। ঈদের দিন একে তো লোক পাওয়া মুশকিল। কোনোমতে হাতে-পায়ে ধরে একজন ম্যানেজ করে পরে তালা ভেঙে কল বন্ধ করেছি। ঈদের দিনে এমন ঝামেলায় না ফেললেই কি হতো না? …”
আর শুনতে চায় না শরিফুল। কল না কেটেই পকেটে রেখে দেয়। খেয়াল হয়, যখন ফ্ল্যাট থেকে বেরোয়, তখন লাইনে পানি ছিলো না। ভুলে পানির ট্যাপ হয়তো খোলা ছিলো, কিন্তু পানি পড়ছিলো না বলে শরিফুল ধরতে পারেনি। না পারুক। ফ্ল্যাট ভেসেছে ভালো হয়েছে। ওসব চিন্তা এখন বাদ। অনেক ঝক্কি করে চার ঘণ্টায় সদরঘাট পৌঁছে আরো চার ঘণ্টা ঘাটে অপেক্ষা করে শেষে লঞ্চে উঠে ঈদের ছুটিতে নতুন বউকে নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলো। তারপর প্রায় এক সপ্তাহ বাবা-মা-ভাই-বোন-স্বজন-বান্ধব নিয়ে ভালোই সময় কেটেছে। মধুর সময় কাটিয়ে শেষে এই পোড়াশহরে নামার আগেই ওই টুকরো টুকরো সুখস্মৃতির গায়ে কোনো জলকাদার ছাপ ফেলতে দেওয়া উচিত হবেনা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সোমার দিকে চেয়ে কিছু হয়নি মার্কা মুচকি হাসি দেয় শরিফুল। ততোক্ষণে লঞ্চের হুইসেল বেজে উঠেছে। সদরঘাটে ভিড়েছে লঞ্চ। সাথে সাথে শুরু হয়ে গেছে উপচে পড়া মানুষের হুটোপুটি। নাহ্ এক ঘণ্টার আগে নামার কোনো উপায় নেই। পকেটে ডেকের দু’টো টিকিট আছে কি না দেখে নেয় শরিফুল। নামার সময় দেখানো লাগবে। এই ডেকের টিকিটও প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে কাটতে হয়েছে। তারপরও বসার সিট মেলেনি।
এই রে, আষাঢ় মাসের বিচ্ছিরি বৃষ্টিটাও শুরু হয়ে গেলো। এই বাড়ি যাবার, থুক্কু ঢাকায় থাকার ভাড়ার ফ্ল্যাটে যাবার সময়েই বৃষ্টিটা নামতে হলো? ভিড় ঠেলে বহুকষ্টে ঘাট পেরিয়ে রাস্তায় ওঠে। রাস্তা কই? দেখাও তো যাচ্ছে না। জলকাদায় সয়লাব। সিএনজি, রিকশা, সব তিনগুণেরও বেশি ভাড়া চাইছে। বৃষ্টিতে ভিজে-টিজে শেষে যখন একটা রিকশা পেলো কমলাপুর যাবার জন্য ততোক্ষণে পাক্কা বিয়াল্লিশ মিনিট পার।
ঝুম বৃষ্টির মধ্যে রিকশা এগোতে থাকে। রিকশায় দু’জন। সাথে দু-দু’টো বড় ব্যাগ। একটা হাবিজাবি বস্তুতে ঠাসা বস্তা। অতোসব নিয়ে হুডতোলা রিকশায় নীল পলিথিন পর্দাটা ধরে রাখতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। উপরন্তু রাস্তার ঝাঁকুনি। পলিথিনের উপর পানির বড় বড় ফোঁটা দেখতে দেখতে হঠাৎ শরিফুলের চোখ চকচক করে ওঠে। সোমার দিকে তাকিয়ে মীরাক্কেলে শোনা গানটা ওদেরই স্টাইলে গেয়ে ওঠে আচমকা- “ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে …, আগে তো নিয়ে আয় তালা।” সোমা হেসে পারলে গড়িয়ে পড়ে। শরিফুলটা যে কী!
ঠিক ওই সময় সোমার রোমান্টিক হাজবেন্ডের মাথায় আসে, বাসায় ঢোকার আগে নতুন একটা তালাও কিনতে হবে। আগেরটা তো বাড়িওয়ালা বরবাদ করে দিয়েছে।