‘ছোটলোকের বাচ্চা’, তোমাকে শ্রদ্ধা

মাইকেলের মেঘনাদবধে রাম নয়, নায়ক ছিলেন রাক্ষস রাবণ। ভালো-মন্দ বিলেতি হলেই চলে এমন মনোভাবের দত্তকুলোদ্ভব মধুসূদন ক্রিকেট খেলতেন কিনা জানি না, তবে ক্রিকেটের মহাকাব্য লিখলে নিশ্চিত তার নায়ক হতেন ক্রিকেট ইতিহাসের চরম ঘৃনিত, নিন্দিত এক ক্রিকেটার। যাকে দানব, রাক্ষস, খুনি এসবের পাশাপাশি, বোলিং রানআপে দৌড়ানোর সময় অন্তত চল্লিশ হাজার দর্শক তারস্বরে গালি দিয়েছে, “বেজন্মা, বেজন্মা, বেজন্মা” বলে, আর সেটি উপেক্ষা করে গতির ঝড় তুলছেন তিনি। সেই গতির ঝড়ে মাঠ ছাপিয়ে ক্রিকেট কূটনীতির ভিত পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। আজ থেকে ৮৫ বছর আগে ১৯৩২-৩৩ সালে হওয়া সেই অ্যাশেজ সিরিজ নিয়ে যেই পরিমাণ উত্তেজনা হয়েছিল, তা নিয়ে যে পরিমাণ লেখালেখি হয়েছে, তার একশো ভাগের এক ভাগ আজ পর্যন্ত ক্রিকেটের অন্য কোন সিরিজ নিয়ে হয়নি। সেই সিরিজটার একটা বিশেষ নামই হয়ে গেল-বডিলাইন। আর এর যে মূল চরিত্র, সেই নিন্দিত বোলার, তিনি হ্যারল্ড লারউড।

কাপ্তান ডগলাস ভদ্দরলোক জার্ডিন

অভিজাতদের খেলা ক্রিকেট শুরুর থেকেই দু’ভাগে বিভক্ত। অভিজাতেরা ব্যাট করবে আর ‘ছোটলোকেরা’ ছুড়বে বল। অভিজাতদের বলা হতো ‘জেন্টলম্যান’ আর শ্রমিক শ্রেণির খেলোয়াড়দের বলা হতো ‘প্লেয়ার’। ফলে ১৯০৪ সালে নটিংহ্যামে খনিশ্রমিকের ঘরে জন্ম নেয়া লারউডের বোলার হওয়াই ছিলো নিয়তি। অবশ্য মাত্র ১৩ বছর বয়সেই খনির গহীন অন্ধকারে কাজ করতে বাধ্য হওয়া লারউডের কাছে ক্রিকেট নেহায়েত শৌখিনতা ছিলো না, মাটির তলের আঁধার পেরিয়ে মুক্ত বাতাসে প্রভাত পাখির গান শোনার সুযোগ ছিল ক্রিকেট।

ফলে ছোটখাট ( প্রাপ্তবয়স্ক লারউডের উচ্চতা ছিলো ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি, একেবারেই পেসারসুলভ না) হলে কি হবে, পারতেন টানা বল করতে আর বলে বলে কেবলই বাড়তো গতি। ক্লাবে, তারপরে কাউন্টিতে নাম করে মাত্র ২২ বছর বয়সে টেস্টে ডেব্যু। ঘরের মাঠে ১৯২৬ সালে ইংল্যান্ডকে অ্যাশেজ জিতিয়ে। ১৪ বছর পরে ট্রফি জেতে সেবার ইংল্যান্ড।

ওল্ডফিল্ডের মাথা ফাটিয়েছিলেন লারউড

টানা প্রতি ঘরোয়া মৌসুমে অন্যতম সেরা বোলার হিসেবে বিবেচিত হয়ে পরের অ্যাশেজ, মানে ১৯২৮ এর অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে প্রথম টেস্টেই স্বাগতিক অজিদের ৬৭৯ রানে হারায় ভিজিটররা, যেটি অদ্যাবধি অ্যাশেজে সর্বোচ্চ রানের ব্যবধান। লারউড আট উইকেট নেন ঐ টেস্টে, আর একই ম্যাচে দু’ ইনিংসে মাত্র ১৮ আর ১ রান করে পরের টেস্টে দল থেকে বাদ পড়েন ডন ব্র্যাডম্যান। কেইবা বুঝেছিলো যে, এই ডন একদিন বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা বলে বিবেচিত হবেন আর লারউডের সাথে তার সম্পর্ক হবে রাম-রাবণের!

অবশ্য ডনকে বুঝতে বেশি সময় লাগেনি, পরের ম্যাচে বাদ পড়লেও শেষ তিন টেস্টে ব্র্যাডম্যান দুইটি সেঞ্চুরি সহ ৪৪৯ রান করেন ‘ব্র্যাডম্যানীয়’ গড়  ৮৯.৮ এ!  অবশ্য তারপরেও অস্ট্রেলিয়া জেতে কেবল শেষ টেস্টটা, সে যাত্রায় জয় লারউডের।

খনি শ্রমিক থেকে গতিদানব-লারউড

তবে ১৯৩০ সালে ইংল্যান্ডে হওয়া সিরিজে পুরো বিপরীত চিত্র! ব্র্যাডম্যান এমন অকল্পনীয় ব্যাটিং করলেন যে পুরো ক্রিকেট বিশ্ব হতবাক হয়ে গেল! একই  সিরিজে ১৩১, ২৫৪, ৩৩৪ আর ২৩২ রানের চারটা ইনিংস। ব্রিটিশ বৃষ্টিতে দুটো টেস্ট ভেসে গেলেও সফরকারীরা জিতলো ২-১ ব্যবধানে। আর ব্র্যাডম্যানের চাবুক সবচেয়ে বেশি খেলেন সেই লারউড। ডনের সেই ব্যাটিং এ যুগের টি-টুয়েন্টির ভাঁড়েরাও কল্পনা করতে পারবে না। একদিনে ৩০০ তোলা ডন নাকি সামান্যতম লুজ বলকে চাবুকের মতো পিটিয়ে মাঠ পার করিয়েছিলেন। আর যেই বোলার লারউড ছিলো ব্যাটসম্যানের ত্রাস, যার বল খেলার সময় ব্যাটসম্যানের মনে হতো ‘শত শত লোক একসাথে পাথর মারছে’, তিনি নিজ দেশে সমর্থকদের সামনে হলেন চরমভাবে লাঞ্ছিত। লারউড তখন ‘অচল’, ‘বাতিল’।

এদিকে ইংরেজ ক্রিকেট কর্তাদের মাথা খারাপ! কিভাবে আবার অ্যাশেজ ফিরিয়ে আনা যায়! যে ক্রিকেট বৃটিশ সাম্রাজ্যের প্রতীক তার সবচেয়ে বড় মর্যাদার লড়াইয়ে এমন হার! অধিনায়কত্ব পেলেন, তিন পুরুষ ভারতে বৃটিশ রাজের কর্মচারী, অক্সফোর্ডের আইন পড়ুয়া জেন্টেলম্যান, ডগলাস জার্ডিন। লারউড যদি হন বডিলাইনের মূল নায়ক তবে জার্ডিন সে চলচ্চিত্রের পরিচালক।

তিন স্যার; লিলি, ডন ও লারউড

জার্ডিন সেই যুগের সীমিত প্রযুক্তি দিয়েই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আবিষ্কার করলেন যে, লারউডের যে বলগুলো ব্র্যাডম্যানের মাথা বরাবর ছিলো তাতে মায়েস্ত্রো বেশ বিব্রত বোধ করছেন। সিরিজ জিততে হবে সুতরাং জার্ডিন সিদ্ধান্ত নিলেন যে ‘লেগ থিয়োরি’ ব্যবহার করবেন। অর্থাৎ বোলার ব্যাটসম্যানের মাথা-শরীর সই করে বল করবে আর লেগ সাইডে সাত-আটজন ফিল্ডার ক্যাচের জন্য তৈরি থাকবে।

কিন্তু যেনতেন গতিতে বল করলে তো হিতে বিপরীত হবে, ব্যাটসম্যান হুকে-পুলে রানের বন্যা বইয়ে দেবে। দরকার একজন ভীষণ গতির বোলার, তাই তিনি তাঁর সমস্ত পরিকল্পনা সাজালেন সেই খনি শ্রমিক, লারউডকে ঘিরে।

এরপরে বডি লাইন সিরিজে যা হলো তা তাবত ক্রিকেটপ্রেমী কম বেশি জানেন। যাদের বই বা আর্টিকেল পড়ার সময় কম তারা ১৯৮৪ সালে নির্মিত সাত পর্বের টিভি সিরিজ বডিলাইনও দেখে নিতে পারেন।

এক কথায় বললে, সিরিজে ব্র্যাডম্যানের গড় ৫০ এর ঘরে, শুধু দ্বিতীয় টেস্টের খটখটে পিচে অস্ট্রেলিয়া জিতে আর বাকিগুলোতে হারে। তবে লারউডের গোলার আঘাতে অজিদের ব্যাটিং লাইনআপের সারা শরীরময় দাগ হয়ে যায়।

বডিলাইন ইন অ্যাকশন

অ্যাডিলেডে হওয়া তৃতীয় টেস্টটিকে ক্রিকেটের ‘বাইবেল’ উইজডেন আখ্যা দেয় সবচেয়ে অরুচিকর খেলা হিসেবে। লারউডের একটা বল অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপ্টেন উডফুলের বুকে লাগে আর তিনি কয়েক মিনিটের জন্য পুরোপুরি অবশ হয়ে যান, তবে তার থেকেও ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটে যখন উইকেটকিপার বার্ট ওল্ডফিল্ডের মাথার খুলিতে গিয়ে বল লাগে। বেচারা ওল্ডফিল্ড সাথে সাথে লুটিয়ে পড়েছিলেন। প্রথমে মনে হচ্ছিল ওল্ডফিল্ড মারাই গেছেন। ভাগ্য ভালো থাকায় তাই খুলির ভেতরে ফাটলের কারণে পরের ম্যাচ খেলতে না পারলেও সে যাত্রা বেঁচে যান তিনি।

(লারউডের আঘাতে লুটিয়ে পরা ওল্ডফিল্ড)

সেই খেলায় ইংল্যান্ড জেতে ৩৩৮ রানে, ওল্ডফিল্ড ছিলেন শেষ ব্যাটসম্যান। তাকে আউট করতেও এই দানবীয় আচরণ! দর্শক ফুসে উঠলো! ইংল্যান্ডের পতাকা পুড়িয়ে দেয়া হলো, পুলিশি প্রহরায় ভিজিটরেরা হোটেলে ফিরলেন।

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড ইংলিশ ক্রিকেট তথা বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক এমসিসির কাছে প্রতিবাদ জানালো। কিন্তু জিততে থাকা এমসিসি পাল্টা জানালো যে, তাদের অধিনায়ক ও খেলোয়াড়দের ওপর তাদের আস্থা আছে। বরং জার্ডিনের হুমকির চাপে পড়ে টেলিগ্রামের অখেলোয়াড়সুলভ কথাটাও উইথড্র করলো অস্ট্রেলিয়ান বোর্ড। জার্ডিন বলেছিলেন, আমরা নিয়ম মেনেই খেলছি, আইনের বাইরে কিছু করছি না, আমাদের অখেলোয়াড়সুলভ বললে আমরা সেটা মেনে নেব না।

এর মধ্যে অবশ্য একটা ছোট্ট মজার ঘটনা ঘটে। অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিক হিউ ব্যাগিস টেস্ট ম্যাচের দিন টেলিগ্রাম করে রিপোর্ট পাঠাতে চাইছিলেন তার অফিসে কিন্তু বেচারার কাছে যথেষ্ট টাকা ছিলো না। শব্দ কমাতে গিয়ে তিনি in the line of the body এর বদলে লিখলেন bodyline. ব্যাস, এই নামটা চালু হয়ে গেল। যদিও জার্ডিন বা লারউড কেউই কখনো এটা পছন্দ করেননি।

পরের টেস্ট জিতে ইংল্যান্ড অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করলো। লারউড যথারীতি ভয়ঙ্কর, তবে সেই টেস্টের নায়ক ছিলেন এডি পেন্টার। খেলার প্রথম দিন প্রচণ্ড টনসিল আর জ্বরে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া পেন্টার হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে ৮৩ রান করেন। অধিনায়ক হিসেবে জার্ডিনের চরিত্র কেমন ছিলো সেটার দেখা মেলে শেষ টেস্টে। নিজের পুরোটা নিংড়ে লারউড দলকে অ্যাশেজ জিতিয়ে ঐ ম্যাচে বিশ্রাম চাইলেন। কাপ্তান জার্ডিন রাজি হলেন না। বোলিংয়ে চার উইকেট নিলেন ৯৮ রানে কিন্তু তারপরেও অস্ট্রেলিয়া করলো ৪৩৫।  ইংল্যান্ড জবাবে ১৫৩-২। এবার জার্ডিন বললেন, লারউড তুমি ব্যাটিংয়ে যাও! বেচারা তো বিস্মিত! সে কেন চারে ব্যাট করবে!!! লারউড ৯৮ করে ফেললেন! দল লিড পেলো। কিন্তু মানুষের শরীর তো! অস্টেলিয়ার তীব্র গরম, শক্ত পিচ ও মাঠে টানা বল করে যিনি প্রায় প্রতিদিন নিজের রক্তাক্ত পায়ের শুশ্রুষা করতেন, দ্বিতীয় ইনিংসের একাদশতম ওভারে এসে টের পেলেন পায়ের হাড্ডি মটমট করছে। এক বিন্দু শক্তি অবশিষ্ট নেই! দুই বল করার পর রানআপেই হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। জার্ডিন এসে বললেন, উঠে দাঁড়াও। লারউড বললেন, স্কিপার আমি আর পারছি না। জার্ডিন বলেন, ঢং বাদ দাও, ওভার শেষ কর। জায়গায় দাঁড়িয়ে লারউড ওভার শেষ করলেন! অবশ্য উডফুলকেও সেক্ষেত্রে স্যালুট দিতে হয়, তিনি আহত লারউডের চারটি বল স্রেফ ব্লক করে ছেড়ে দিলেন।

তারপরেও অনুমতি মেলেনি প্যাভিলিয়নে ফেরার কারণ স্কিপার জার্ডিন বলেছেন যতক্ষণ এই ছোট্ট জারজটা (ব্র্যাডম্যানকে তিনি ঐ নামেই ডাকতেন) আউট না হবে তুমি মাঠে থাকবে।

হেডলি ভেরিটির স্পিনে ব্র্যাডম্যান আউট হলেন। লারউডের যাওয়ার অনুমতি মিললো। রাম আর রাবণ একসাথে, একজন ভগ্ন মনে আরেকজন ভগ্ন শরীরে একসাথে হেঁটে প্যাভিলিয়নে ফিরছেন! ক্রিকেট রোমান্টিকদের জন্য সে এক দৃশ্য বটে! কিন্তু কে জানতো ঐটাই লারউডের শেষ!

লারউড

জার্ডিনের দলকে নিয়ে ইংল্যান্ডে তখন মহা উচ্ছ্বাস, এমনকি দুনিয়ার সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় ক্রিকেট লেখক নেভিল কার্ডাস পর্যন্ত বলে বসলেন যে, লারউডের মূর্তি লন্ডন শহরে স্থাপন করা হোক।

কিন্তু দিন বদলালো, ইংল্যান্ডেই ‘ভদ্রলোকেরা’ ব্যাটসম্যানদের বাঁচানোর আইনের ব্যাপারে উৎসাহী হলেন। অস্ট্রেলিয়ার সাথে কূটনীতির ব্যাপার তো ছিলোই, ফলে ‘বডিলাইন’ ঠেকানোর আইনও হলো। নিয়ম হলো লেগ সাইডে ব্যাটসম্যানের পেছনের অংশে দুজনের বেশি ফিল্ডার থাকতে পারবে না।

শুধু তাই না, লারউডকে ক্ষমা চাইতে বলা হলো। ‘ভদ্রলোক’ ক্যাপ্টেনের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে, নিজের সবটুকু দিয়ে দেশকে জেতানো লোকটিকে নতজানু হতে বলা হলো। নিজেদের ‘আভিজাত্য’ বজায় রাখতে বলি করা হবে ‘ছোটলোক’-টাকে। লারউড নির্ঘাত রবীন্দ্রনাথ পড়েননি, না পড়লেও দুই বিঘা জমির উপেনের মতো হয়তো বলেছিলেন,

আমি শুনে হাসি,  আঁখিজলে ভাসি, এই ছিলো মোর ঘটে-

তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে

উপেনের ভাগ্যে কি হয়েছিল জানা নেই, কিন্তু লারউড তো পেসার, উদ্ধত শির, সে রাবণ, সে নতজানু হবে না। মাপ চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। লারউড আর এর পরে টেস্ট খেলেননি।

পেটের দায়ে অবশ্য গরিবের ছেলেটাকে ক্রিকেট খেলে যেতে হয়েছিল, একটা পর্যায়ে ১৯৫০ সালে, বডিলাইনের ১৮ বছর পর এসএস অরনেটস, যে জাহাজে চেপে জার্ডিনের দলের হয়ে তিনি অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলেন, সেই একই জাহাজ চেপে সেই দেশে রওনা দেন তিনি।

সেই সময়ে তার প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড় ও সাংবাদিক জ্যাক ফিঙ্গলটন তাকে আমন্ত্রণ করেন, এমনকি উডফুল আর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন যার, সেই ওল্ডফিল্ডও তাকে বন্ধুর মতো আগলে রাখেন। তবে ব্র্যাডম্যানের সাথে তার বন্ধুত্ব হয় না।

শেষ জীবনে প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়া মানুষটি মারা যাওয়ার দুই বছর আগে, ৮৮ বছর বয়সে, বৃটিশ রাজের কাছ থেকে এমবিই বা অর্ডার অফ মেরিট খেতাব পান, কিন্তু বডিলাইন সিরিজ নিয়ে যাবতীয় ধিক্কার, সেই সিরিজের যত গ্লানি তার দিকেই ঠেলে দেয় অভিজাতেরা, মূল পরিকল্পনাকারী জার্ডিনের কিস্যু হয় না। ‘ছোটলোকদের’ এইভাবেই দেখা হয়। তাদের কৃতিত্বকেও সবসময় কালি দেয়া হয়। যেই লারউড বডিলাইন না করেও নিজের আমলের সেরা বোলার ছিলেন, তিনি অভিজাত ক্যাপ্টেনকে হুবহু মানার ফল হিসেবে পান টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে মৃত্যুদণ্ড।

ক্রিকেটে অবশ্য এরকম অবিচার বিরল না। আশির দশকে দোর্দন্ড প্রতাপশালী ওয়েষ্ট ইন্ডিজের ফাষ্ট বোলারদের রুখতে বাউন্সার আইন পরিবর্তন হয়। একেতো কালো মানুষের আধিপত্য তায় ব্যাটসম্যানের উপর বোলারের আধিপত্য। বোলাররাতো ঐতিহাসিকভাবেই শ্রমিক, তারা অভিজাতদের উপর আধিপত্য দেখাচ্ছে এটা কি হতে দেয়া যায়!

লারউডের লেখা বই

ঠিক তেমনভাবে ইংল্যান্ডে যখন রিভার্স সুইং করাচ্ছেন বাদামী চামড়ার ওয়াসিম আকরাম আর ওয়াকার ইউনিস সেটিকেও অবৈধ বলা হলো। সাহেবদের উপর তাদের একসময়কার কলোনির মানুষের শ্রেষ্ঠত্বকে কি মেনে নেওয়া যায়! অথচ সবার পক্ষে লারউড, কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাইকেল হোল্ডিং বা পাকিস্তানের ওয়াকার হওয়া সম্ভব না। উডফুলকে তার সহঅধিনায়ক বলেছিলেন, চলো আমরাও বডিলাইন করি। উডফুল জবাবে বলেছিলেন, কাকে দিয়ে করবো? তুমি আর আমি? আমরা বল করলে সেটা কোমর সমান উঠবে। বডিলাইন সফল করতে প্রচণ্ড গতির বোলার দরকার, আমাদের সেই গতির পেসার কই?

এইখানেই, লারউড, হোল্ডিং আর ওয়াকার একাকার হয়ে যান। ইংরেজ হওয়া সত্ত্বেও লারউড যে আসলে ‘ছোটলোক’, তাই অভিজাতরা তাকে ব্যবহার করে ছিঁবড়ে ফেলে দেবে। অপমান করবে। সে হয়ে উঠবে পুরাণের রাবণ।

গত ২২ জুলাই ছিলো, লারউডের ২২তম প্রয়াণ দিবস। ক্রিকেট দেবতাদের আসনে এই অসুরের জায়গা না হোক, জনতার মহাকাব্যে, সে বীর। তোমায় শ্রদ্ধা জানাই ‘ছোটলোকের বাচ্চা’ লারউড।