রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। এই চিরচেনা লাইনের সঙ্গে একটা বাড়তি অথচ খুবই প্রাসঙ্গিক একটা বিষয় আমরা যোগ করতে ভুলে যাই—এলো দুর্ঘটনার মহোৎসব। ঈদের সঙ্গে আসে দুর্ঘটনা। প্রতি বছর, নিয়ম করে, ঈদের আনন্দের সঙ্গে যোগ হয়ে চলছে মৃত্যুর এই মিছিল। এ ‘ঐতিহ্য’ আমাদের বহুদিনের। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি এবং ঈদ মানে দূর্ঘটনায় মৃত্যু।
লটারির টিকেট জেতার অনুভূতি নেওয়ার এক অল্টারনেটিভ আছে। ঈদের সময় বাড়ি ফেরার টিকেটটা দিনরাত লাইনে দাড়িয়ে যারা পেয়েছেন, পান এবং ভবিষ্যতে পাবেন—তারা এই টিকেটটা হাতে পেলে এমনই এক আনন্দ পান। এই আনন্দ চরম বেদনায় রূপ নিতে পারে, সে ধারণাটা হয়ত কারোই সঙ্গে সঙ্গে মাথায় থাকে না। তবে আমরা সব সময়ই এই বেদনার খবর নিয়ম করে পাই প্রতি ঈদের সময়।
টেলিভিশনে, পত্রিকায়, এখন তো আরো বেশি পাই অনলাইনে। এত এত মৃত্যুর খবরে আমরা সম্ভবত অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই নতুন করে ভাববারও ফুরসত হয় না। নিউ মিডিয়ার রকেট স্পিডের যুগে মুহূর্তের ফেরে জুটে যায় ভাবনার নিত্যনতুন খোরাক।
কেবল গত বছরের কথাই বলা যাক। দৈনিক সমকালের গত বছরের প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, গেল বছরের ঈদের ছুটি ছিল ৯ দিনের। ছুটির প্রথম দিন সড়ক দুর্ঘটনায় চারজন নিহত ও ৯৪ জন আহত হন। এর পরের দিন সড়ক দুর্ঘটনায় ২২ জন নিহত ও ৫৩ জন আহত, তার পরের দিন ৯ জন নিহত ও ৪৪ জন আহত, তার পরের দিন ১০ জন নিহত ও ৩৯ জন আহত, তার পরের দিন ১০ জন নিহত ও ১৭ জন আহত, তার পরের দিন ১৯ জন নিহত ও ৫১ জন আহত, তার পরের দিন ছয়জন নিহত ও১৩ জন আহত, তার পরের দিন ২৩ জন নিহত ও ১১৩ জন আহত, তার পরের দিন…
হাঁপিয়ে উঠছেন? জেনে রাখুন, এ স্রেফ মহাসড়কের কথা। নদীপথের ট্রাজেডি হিসেব করতে গেলে আরও গলা শুকিয়ে আসবে। এ বছরে তো আবহাওয়াও ক্ষণে ক্ষণে ঝড়বৃষ্টি বয়ে আনছে। অথচ সে হিসেবে আমাদের সতর্কতা কতটুকু?
সমকালে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে এই দুর্ঘটনার কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়েছিল। বিভিন্ন মহাসড়ক ও ফেরিঘাটে তীব্র যানজটের কারণে ব্যয় হওয়া দীর্ঘ সময় পুষিয়ে নিতে ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, দীর্ঘ ছুটির কারণে সড়ক – মহাসড়কে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা, গন্তব্যে দ্রুত পৌঁছাতে যাত্রীদের তাগিদের কারণে চালকের অন্যমনস্কতা, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ সামাল দিতে বাড়তি ট্রিপ দেওয়ায় চালকের সাময়িক শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্যহীনতা এবং ওভারটেকিংয়ের ক্ষেত্রে চালকদের ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করার প্রবণতা। এগুলোই কি শুধু কারণ? আপামর সাধারণ মানুষ এবং সরকারের দায়হীন আচরণ আর অবহেলার যে বহু বছরের ধারাবাহিকতা, সেটি কি গণনায় আসবে না? আমরা আর কত বছর ধরে এই লাশের মিছিল, পত্রিকার শিরোনামের আতংক বয়ে বেড়াব?
এই প্রশ্ন বা পরিস্থিতির কোনো উত্তর বা সমাধান তো আমাদের দেওয়া অসাধ্য। ঈদের ছুটিতে যেসব সংবাদকর্মীরা অফিসে কাজ করেন, তাদের নির্ধারিত একটি কাজই থাকে দুর্ঘটনার খবরগুলো কাভার করা। সত্যি বলতে, এত বেশি দুর্ঘটনার খবর থাকে যে মৃতের সংখ্যা গণনা আর শিরোনাম নির্ধারণে নতুনত্ব তৈরিতে অনেকেই বিরক্ত হয়ে যান। এটাই বাস্তব, খুব অস্বস্তিকর এক বাস্তব।
আমাদের আর কিই বা করার, এই অস্বস্তিকর বাস্তব কাঁধে নিয়ে বরং ‘ঈদ’ নাকি ‘ইদ’ হবে; এমন আলোচনা নিয়েই সময় কাটাই। সড়ক সমুদ্র পাড়ি দিয়ে জীবন নিয়ে বাড়ি ফেরা যদি সম্ভব হয় এ যাত্রা, সেটুকুই সৌভাগ্য, বিশেষ সৌভাগ্য।