সন্ত্রাসবাদ রুখতে আসুন গেয়ে উঠি ভালোবাসার জয়গান

অবর্ণনীয়, অচিন্ত্যনীয় অজস্র সুখবিলাসের বার্তা পবিত্র গ্রন্থ মারফত পাওয়াই আছে মুসলিমদের। এই ক্ষণস্থায়ী লৌকিকতা সাঙ্গ হলেই তো আর সব শেষ নয়। এরপর সেই চিরস্থায়ী জীবন। ওই জীবনে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যেই মুসলমানেরা নির্ধারণ করে নিজস্ব জীবনাচার। যদিও গালিবের মতো কিঞ্চিত দুষ্টুপ্রকৃতির খোদার বান্দারাও ছিল সবসময়ই। টুক করে বলে দেয় ওসব নাকি শুধু নিজেকে বুঝ দেয়ার চেষ্টা- হামকো মালুম হ্যায় জান্নাত কি হক্বিকৎ লেকিন/দিল কো খুশ রাখনে কো গালিব ইয়ে খ্যায়াল আচ্ছা হ্যায়

কী দুষ্টু, কী দুষ্টু। সুরাপানের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত দুর্বলতাটুকু না থাকলে মির্জা গালিবকে কালজয়ী শায়ের নয়, দার্শনিক হিসেবেই মনে রাখতো ইতিহাস।

সে যাই হোক। অনেকে বলেন স্রেফ প্রোপাগান্ডার জোরে মুসলিম মানেই এক্সট্রিমিস্ট এই ধারণাটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে ওয়েস্টে। যে ইমেজ সংকটে বহুদিন ধরে ভুগছে বিশ্বের একাংশের শান্তিকামী মুসলিমরা। হাজারবার “মাই নেম ইজ খান, অ্যান্ড আ’য়াম নট আ টেরোরিস্ট” আওড়ানোর পরও কিছুতেই যে কিছু হচ্ছে না।

অথচ এই চিত্রটার দায়ভার যে মুসলিম উম্মাহ্’র উপর কোনোভাবেই বর্তায় না। ইসলাম একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। শর্টকাট জান্নাতের ওই সো-কল্ড অন্ধকার পথে কালাশনিকভ আর একে ফোরটি সেভেনের ঝলকানি দিয়ে কোনোদিনও পথের দিশা পাওয়া সম্ভব না। সাউথ এশিয়া ও মিডল ইস্টের মুসলিম কমিউনিটি আপাতত এই কোর মেসেজটাকে আঁকড়ে ধরে উম্মাহর ইমেজ বিল্ডআপের চেষ্টায় রত। ঠিক এই কনসেপ্টের উপর দাঁড়িয়েই মিডল ইস্টের প্রভাবশালী টেলিকম কোম্পানি ‘জাইন’ গত ২৬ মে, রমজানের শুরুতে তিন মিনিটের একটি বিজ্ঞাপন রিলিজ করে। জাইন-এর উদ্দেশ্য সফল বলতে হবে। ইতিমধ্যেই ভাইরাল ভিডিওটি। ইউটিউবে প্রায় চার মিলিয়ন বার দেখা হয়ে গেছে। মানুষের মন্তব্যে বেশিরভাগ ইতিবাচকতারই ছড়াছড়ি। এমনকি অন্য ধর্মের অনুসারীরাও সাধুবাদ জানিয়েছে এ প্রচেষ্টাকে। কী এমন বার্তা ছড়ানো হয়েছে যাতে এত মানুষ একাত্ম হয়েছেন এর মেসেজের সাথে?

প্রথমত, পুরো বিষয়টিকে একটি ভিন্ন অ্যাংগেল থেকে দেখানোর চেষ্টা। আর সেটাও সমান্তরালভাবে দু’টো বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে। ভিডিওটির শুরু হয় স্কুলের এক শিশুর কণ্ঠে সন্ত্রাসবাদীদের উদ্দেশ্য করে বলা বক্তব্য দিয়ে: “আমি অবশ্যই খোদাকে স-ব জানাবো। জানাবো তুমি কীভাবে প্রিয় স্কুলঘর খালি করে আমাদের মতো শিশুদের দিয়ে কবরস্তান ভরে তুলেছো। সবই জানাবো।” এই কথাগুলো শুনতে শুনতেই আমরা দেখতে পাই এক টেরোরিস্টকে। যে কি না লোকচক্ষুর আড়ালে একটি ঘরে বসে একটি সুইসাইড বেল্ট তৈরি করছে। তার চোখে জিহাদী নেশা আর জান্নাতের হাতছানি। এরপর সে একটি বাসে উঠে পড়ে। উন্মত্ত হয়ে সৃষ্টিকর্তার নাম আওড়ে যে-ই না বিস্ফোরন ঘটাতে যাবে তখনই একটি শিশুকে কোলে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসেন এক বৃদ্ধ। হামলাকারীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “যে আল্লাহর নাম নিয়ে ধ্বংসের নেশায় তুমি মেতেছো, জেনে রেখো, তাঁর কাজ কিন্তু সৃষ্টি করা।” প্রথমবারের মতো ভীতির ছাপ দেখা দেয় আতঙ্কবাদীর চেহারায়। ধাক্কা খেয়ে বসে পড়ে বাসের সিটে। সেখানে তার উল্টোদিকে আবিষ্কার করে সিরিয়ার আলেপ্পোতে ২০১৬’র আগস্টে ঘটা হামলায় বিশ্ব মিডিয়ায় আলোড়ন তৈরি করা ছাইমাখা শিশুটিরই হুবহু প্রতিরূপকে। আত্মঘাতী ব্যক্তিটি বুঝে উঠতে পারে না এই আকস্মিক ঘটনায়।

সিরিয়ার আলেপ্পো শহরে উদ্ধার পাওয়া শিশু ওমরান। যার ছবি নাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্ব বিবেক।

শুধু সিরিয়ান শিশুটিই নয়। কখনও আল-কায়েদা, কখনও আই এস-এর ব্যানারে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে হওয়া সন্ত্রাসী হামলার শিকার হওয়া স্থান আর মানুষগুলো একে একে ভেসে উঠতে থাকে ভিডিওটিতে। এই জায়গাগুলো, ওই মানুষগুলো, এঁরাই তো ইসলামের নামে হওয়া সহিংসতার বলি। যেখানেই ঘটনা ঘটুক না কেনো, মানুষগুলো তো সব একই। ইরাক, কুয়েত, সিরিয়া, সব হামলাতেই প্রাণ হারিয়েছে নিরীহ মানুষেরাই।

আরেকটি ব্যাপার যেটা মনে দাগ কাটার তা হচ্ছে- পুরো ভিডিওর মাধ্যমে একটাই বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আর সেটি হচ্ছে- প্রার্থনার রাস্তা আতঙ্ক-ঘৃণা আর মৃত্যুভয় ছড়ানোর মধ্য দিয়ে নয়, খোদার উপাসনা মানুষকে ভালোবাসায়। সেটা শুধু মুসলিমদের জন্য নয়, সকলের জন্য। এমনকি সেটা ভীতসন্ত্রস্ত আতঙ্কবাদীর জন্যেও। ভিডিওটির এক পর্যায়ে শান্তির বার্তা নিয়ে আসেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিখ্যাত গায়ক হুসেইন আল জাসমি। ভীতিকর সব দৃশ্য দেখে বিহ্বল টেরোরিস্টের জন্যেও বাড়িয়ে দেন সম্প্রীতির হাত। গানের সুরে জানান, “খোদার উপাসনা করো ভালোবাসার সাথে।” উইথ লাভ, নট টেরর।

প্রায় সবই বলে দিলাম। যদিও বলে দিলেও নিজে না দেখলে অনেকটাই ভাসা-ভাসা থেকে যাবে। এমনি এমনিই তো আর বিশ্বজুড়ে সবার প্রশংসা কুড়ায়নি। তাই বাকিটা নিজেই দেখুন এখানে। শেষটাও কিন্তু বেশ সুন্দর।