একলার উৎসব

এ বছর জার্মানিতে সম্ভবত ছুটির দিনে ঈদ। অদ্ভুত! হিসেব কষছি ঈদে ছুটি থাকবে নাকি থাকবে না! অথচ বেড়ে উঠেছি এই জেনে যে, ঈদ মানেই ছুটি। দেশে সবাই যখন ঈদের কেনাকাটা বা রান্না নিয়ে ব্যস্ত, আমি তখন ব্রাউন ব্রেড আর এক স্লাইস চিজ টিস্যুতে মুড়ে নিয়ে রাস্তায় খেতে খেতে কাজে দৌঁড়াই, মেয়েকে নার্সারিতে ফেলে।

বার্লিন, বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত শহর। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই ব্যস্ত শহরে অবলীলায় একের পর এক ঈদ কাটাচ্ছি, ব্যস্তভাবে। মেহমান, রান্না, কেনাকাটার ব্যস্ততা নয়, এখানে থাকে কেবল কাজের ব্যস্ততা; এবং সেটাই একমাত্র বাস্তবতা। ঈদে কোন অফিশিয়াল ছুটি নেই এই শহরে, বর্ণিল সাজে সাজেও না কংক্রিটেরা তবে রমজানের আমেজ বেশ বোঝা যায়। তুর্কি আর আরব আধিক্যের কারণে। এখনতো রমজান, ঈদ সম্পর্কে এখানের ভূমিপুত্রেরাও ওয়াকেবহাল। সেটার অবশ্য রাজনৈতিক- বর্ণবাদী- সাম্রাজ্যবাদী বিস্তর ব্যাখ্যা আছে।

রমজানের মাসজুড়ে দিনের বেলা সব তুর্কি-আরব খাবারের দোকান খা খা করলেও ইফতারের সময় হতে হতে বেচাকেনা জমে যায় উৎসবের আমেজে। বার্লিনে প্রতিবছর রমজান মাসে শহরে একদিন ইফতারের আয়োজন করে এক এনজিও। যা সবার জন্য উন্মুক্ত, শহরের মেয়র নিজে উপস্থিত থাকেন মেহমানদারি করতে। একবার দুবার সেদিকেও যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এসবই বড় বেশি সাজানো, গোছানো মানে এককথায় প্ল্যান্ড। তবুও কোথায় যেন এক অতৃপ্তি কাজ করে, কোথায় যেন কাজ করে এক না পাওয়া, হতাশার ছাপ। কোথায় যেন নিজেকে বড় অযাচিত মনে হয়, খাপছাড়া খাপছাড়া মনে হয়। নিজের ছোট বেলা, নিজের দেশ ঘুরে ফিরে মনে আসে বারবার। সেটা কাটাতেই আয়োজন হয় ইফতারের, আশপাশের প্রিয়রা আমাকেও মেয়েসমেত জুটিয়ে নেন।

এবারের রমজানে বার্লিনে পৌছেছে কাঁঠাল

যেবার প্রথম দেশ ছেড়ে, পরিবার ছেড়ে বার্লিনে ঈদ কেটেছিল, মনে হয়েছিল শুন্যে ভাসছি, কিছু শুনতে পাই না, কিছু দেখতে পাই না। অনুভুতিহীন দিন কেটেছে, বছর পেরিয়েছে। আস্তে আস্তে বদলে গেছে অনেককিছু, হয়ত সামলেও নিয়েছি নিজেকে। কিন্তু বিন্দুমাত্র বদলায়নি ঈদ ব্যাপারটা। যারা দেশ ছেড়ে থাকি তাদের সদাই ব্যস্ত জীবনে, কারো সাথে দেখা বা কথা বলার সুযোগ এত কম যে ঈদ আমাদের এক করে, ফিরিয়ে নিয়ে যায় দেশে। মসজিদে ঈদের জামাতে দেখা না হরেও অন্তত ঈদ মোবারক বলবার জন্যে হলেও একে অপরকে ফোন করে।

বার্লিনের ঈদের জামাত

সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ঈদ পরলে  দু’মাস ধরে লম্বা প্ল্যান হয়।  বার্লিনে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট আছে বেশ কিছু। মালিকরা উদ্যোগী হয়ে নিজের রেস্টুরেন্টের স্পেসটা ছেড়ে দেন একদিনের জন্যে। যাতে সবাই এক হয়ে ঈদ করতে পারে।

ঈদের ওয়ান ডিশ ডেলিকেসি

সেখানে সবাই যে যার মতো রান্না করে নিয়ে আসে, এবং অবশ্যই হিন্দু- মুসলিম বলে আলাদা কিছু থাকে না। মাথায় থাকে শুধু দেশ। এই একলা মনখারাপের মাঝে সেদিন যেন বাংলাদেশ উঠে আসে বার্লিনের বুকে। তাই একলা থাকাটাও শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠেনা।