সাতাশ রোজার দিন সকাল। মুঠোফোনে অপারেটরের রেকর্ডেড কল। ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদগানটিকে ওয়েলকাম টিউন করতে প্রেস করুন এই নম্বরে। অভ্যস্ত হাতে ডিলিট করতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠি।
বাঙালির ঈদ আদপে শুরু হয় শেষ রোজার সন্ধ্যায় চিকন কাস্তের মতো একফালি চাঁদ দেখে। চাঁদ দেখা কমিটির ঘোষণা আসে বিটিভির স্ক্রিনে। অবগুণ্ঠনমুক্তা হয়ে আনন্দিত সংবাদপাঠিকা বলেন, ঈদ মোবারক। শুরু হয় এক অতিপরিচিত কোরাস। সোহরাব হাসান-খায়রুল আনাম শাকিল হয়ে এখন আরেফিন রুমিরাও দরদ দিয়ে গান ধরেন ‘তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ/ দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ।’
ছোটবেলা থেকে চাঁদরাতের উত্তেজনার পাশাপাশি খুশির ঈদের গান শুনতেও কম উত্তেজনা ছিলো না। এরপরে ঈদের দ্বিতীয় দিনে ইত্যাদির ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে প্রতিবছর এই গানটির গ্র্যান্ড অর্কেস্ট্রেশনও কম রাঙায়নি ছেলেবেলার ঈদ। গেল শত বছরে যে গানের আদর কমেনি, কমেনি গ্রহণযোগ্যতা। কেমন করে হলো সে গান?
উদ্যোগটা ছিল বাংলার পল্লীগীতির পুরোধা পুরুষ আব্বাস উদ্দীন আহমেদের। তিনিই ধরেছিলেন তাঁর কাজীদাকে। কাজী নজরুল ইসলাম তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। মনিমুক্তোর মত রোজ লিখছেন চার্টবাস্টার্স। তাঁর লেখা একটা শ্যামাসংগীত কিংবা গজলের জন্য গ্রামোফোন কোম্পানির সেরা গাইয়েরা লাইন ধরে গান নিচ্ছেন। তো আব্বাস উদ্দীন ধরলেন কবিকে, কবি বললেন কোম্পানির অনুমতি নিতে। মাস ছয়েক অবশ্য লেগে যায় গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল-ইনচার্জ ভগবতী ভট্টাচার্যকে কনভিন্স করতেই। তবে তিনি রাজি হওয়ার পরে রেকর্ডের দু’মলাটের গান দু’টি লিখে বিদ্রোহী কবি সুর করেছিলেন মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই। দরজা বন্ধ করে পান আর চা খেতে খেতে মাত্র আধঘণ্টায় কবি লিখেছিলেন ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’। তখনই সুর সংযোগ করে শিখিয়ে দিলেন শিল্পীকে। পরের দিন ঠিক একই সময়ে আসতে বললেন স্নেহের আব্বাসকে। পরের দিন লিখলেন, ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর’। গান দু’খানা লেখার ঠিক চার দিন পরই রেকর্ড করা হল। রেকর্ডিংয়ের সময় যন্ত্র ব্যবহৃত হলো শুধু হারমোনিয়াম আর তবলা। রেকর্ডিংয়ের সময় গান দু’খানা পুরো মুখস্থ হয়নি বলে নিজেই লিখেছেন শিল্পী। মাইকের পাশ দিয়ে হারমোনিয়ামের ওপর ঠিক গায়কের চোখ বরাবর হাত দিয়ে কবি নিজেই সেই কাগজখানা ধরলেন, যাতে গাইতে আব্বাস উদ্দীনের সমস্যা না হয়।
ঈদ-উল-ফিতরকে নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম এ গানটি রচনা করেন ১৯৩১ সালে। লেখার মাত্র চারদিন পর শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের গলায় গানটি রেকর্ড করা হয়। রেকর্ড করার দুই মাস পর ঈদের ঠিক আগে আগে এই রেকর্ড প্রকাশ করে গ্রামোফোন কোম্পানি। এরপর বাকিটা ইতিহাস।
ইসলামি গান দিয়ে নজরুল ঘুমন্ত বাঙালি মুসলমানের চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যে ঘরে কোনদিন সুরের বাণী পৌঁছায়নি সেখানেও গানের ডালি নিয়ে হাজির হয়েছেন তিনি। ব্যক্তিজীবনে আজীবন সাম্যবাদী নজরুল তাইতো লিখেছিলেন ‘যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী/ সেই গরিব ইয়াতিম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ…/তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয়ে মনে উম্মীদ।/ ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। গত শতক জুড়েই নজরুলের বহু গান হারিয়ে গেছে অবহেলায় আর কালের কল্লোলে কিন্তু অজর রয়ে গেছে এই গানটি, যে সুর আগমনী গানের মতো বারতা দেয় খুশির, সাম্যের।
আদি রেকর্ডিংটি শুনুন:
গ্রামোফোন কোম্পানির প্রথম ইসলামি রেকর্ডটি প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। রেকর্ডের অপর গান ছিল কবির লেখা ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর, বদনসীন আয়, আয় গুনাহগার নতুন করে সওদা কর।‘ হিজ মাস্টার্স কোম্পানির রেকর্ড নম্বর ছিল এন- ৪১১১।