ভাবুন তো, অ্যাপ-হীন একটা পৃথিবীর কথা!

প্রায় এক দশক আগের কথা। এক ম্যাগাজিনে টুকটাক প্রদায়কের কাজ করি। ফ্যাশনেবল মোবাইল ফোন নিয়ে সেখানে ফিচার লিখেছিলাম। এতোদিন মনে থাকবার মতো লেখা নয়। কিন্তু ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটায় লেখাটার কথা এখনো মনে আছে। যদ্দূর মনে পড়ে সেটার ইন্ট্রোর মূল বক্তব্য ছিলো এমন- আমাদের এই লাইফ ইন আ মেট্রোতে মোবাইল ফোন ছাড়া একটা দিন থাকার মানে শহরের কোলাহলের মধ্যেও একদিনের জন্য রবিনসন ক্রুসো কিংবা কাস্ট অ্যাওয়ে-র রাসেল ক্রো বনে যাওয়া। হ্যাঁ, রাসেল ক্রো-ই লিখেছিলাম। টম হ্যাঙ্কস আর রাসেল ক্রো-কে প্রায়ই গুলিয়ে ফেলতাম (এখনও ফেলি)। তাই ভুল করে টমের জায়গায় লিখে দিয়েছিলাম রাসেলের নাম। বড়সড় একটা ব্লান্ডারই বটে। যদিও ‍সাব-এডিটরসহ অনেকের চোখ এড়িয়ে ওভাবেই ছাপা হয়ে গিয়েছিলো। কয়েকদিন বাদে নিজেই ভুলটা আবিষ্কার করি। ঘটনাটা মনে থাকার এটা পয়লা নম্বর কারণ। তবে ওর পেছনে আরো একটা আশ্চর্যবোধক কারণ বিদ্যমান। ফিচারটি ছাপা হবার বেশ কয়েক মাস পর ওই পত্রিকার সুবাদে পরিচিত এক ভাই তখনকার দেশীয় এক ইংরেজি ম্যাগাজিনের চলতি সংখ্যার একটা পাতা খুলে দেখিয়ে পড়তে বলেন। পড়ে প্রথমে অবাক, পরে হতবাক। দেখলাম সেটা ‘ফ্যাশনে মোবাইল ফোন’ নিয়ে আমার বাংলা ফিচারটিরই লাইন বাই লাইন দাড়ি-কমাশুদ্ধ মিলে যাওয়া একটি অনুবাদ। এমনকি সেটাতে রাসেল ক্রো-র নামটাও একই জায়গায় উল্লেখ করা আছে। আরো আছে লেখার শেষে ‘লেখক’ হিসেবে অনুবাদকের নামটাও। যিনি কষ্ট করে ক্রসচেকের ঝামেলাতে যাবার প্রয়োজনও বোধ করেননি।

যাই হোক, সেসব ভিন্ন প্রসঙ্গ। সেই ইংরেজি ম্যাগাজিন এখন দৃশ্যপটে নেই আর মোবাইল ফোনতো এখন লাইফস্টাইলের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। আরো নির্দিষ্ট করে বললে স্মার্টফোন। সেটা এমনই অপরিহার্য যে সাথে শুধু মোবাইল ফোন থাকলেই হচ্ছে না। তাতে থাকতে হবে দ্রুতগতির ইন্টারনেট আর অবশ্যই অবশ্যই থাকতে হবে খুব দরকারি, কম দরকারি এবং একেবারেই অদরকারি, কিন্তু না থাকলেই নয় এমন গাদাখানেক অ্যাপ। অ্যাপ-এর এমনই কেরামতি, এখন ফোনে অ্যাপ না থাকলেই বরং নিজেকে রবিনসন ক্রুসো বা ‘রাসেল ক্রো’ বলে মনে হবে। ছেলে থেকে বুড়ো সবার জীবন আজ মোটামুটি অ্যাপ-কে কেন্দ্র করে আবর্তিত। কাজের ডেস্ক আর দেয়াল থেকে ঘড়ি, ক্যালেন্ডার তো কবেই সরিয়ে দিয়েছে অ্যাপ। এরপর একে একে নোটবুক, ডায়েরি, মোটা মোটা ডিকশনারি, বিশালাকার ম্যাপ/গ্লোব, দরকারি বইও সরিয়ে দিলো। এখন তো যা-ই করুন, পারলে সবকিছুর সাথেই অ্যাপ জড়িত। ছবি তোলা, চেক-ইন, শেক-ইন তো সো লাস্ট এরা। অ্যাপ থাকলে ইদানিং আরো অনেক রাজা-উজির স্মার্টফোন হাতে নিয়েই মারা যায়। শপিং, ব্যাংকিং, গাড়ি ভাড়া, বাড়ি কেনা, ক্যালরি মাপা, পছন্দের পাত্র-পাত্রী খোঁজা কী না করা যায় অ্যাপ দিয়ে। আর কিছু্ই করার না থাকলেও গান শোনা, ভিডিও দেখা, চ্যাটিং কিংবা ভার্চুয়াল পশুপালন, কৃষিকাজ, ক্যান্ডি ভাঙচুর বা পাশের রাজ্যে হামলা চালানোর রণকৌশল তৈরির মতো জরুরি কাজে মনোযোগ দেয়াই যায়। এই যে সারাদিনে পথেঘাটে, বিবিধ লোকেশনে দেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার জনসাধারণ অবনতমস্তক বিনয়ী অবতারে বিচরণ করে, সে সব তো অ্যাপ-এরই খেল!

তো এই যে দিনজুড়ে ‘অ্যাপ ছাড়া আমাদের চলেই না’ জীবন, কেমন হবে যদি সে অ্যাপগুলো হঠাৎ করেই ‘নেই’ হয়ে যায়? কী হতে পারে তখন? ভাবতেই কি গা শিউরে উঠছে না বলুন? সেই ভীতিকর পরিস্থিতির কথাই কল্পনা করেছে ‘অ্যাপল’-এর নতুন বিজ্ঞাপনে। প্রেক্ষাপট অ্যাপল-এর বার্ষিক ওয়ার্ল্ডওয়াইড ডেভলপার্স কনফারেন্স। মোবাইল ফোন থেকে অ্যাপ ভ্যানিশ হয়ে গেলে যে কেয়ামতের অবতারণা হবে তার নামটাও দিয়েছে জমাটি-‘অ্যাপ-ও-ক্যালিপস’ (Appocalypse)।

এমন কিন্তু নয় যে অ্যাপ নাজিল হবার আগে জীবন অন্ধকার যুগে পড়ে ছিলো। তবে ভুলে যাবেন একটা সময় আপনি প্রয়োজনীয় ফোন নাম্বার মুখস্থ রাখতেন, হাওয়াইয়ের রাজধানী খুঁজতে কাগজের ম্যাপের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। জোকস অ্যাপার্ট। আপগ্রেডেড থাকাটা আসলে বিলাসিতা নয়, সময়ের দাবি। সাথে কনভিনিয়েন্স, স্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদি বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে।

আপনার পাশের সেলফিবিলাসী মেয়েটা নিজের নানা অ্যাঙ্গেলে, নানা পোজে তোলা ছবির প্রিন্টআউট নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সামান্য একটু অ্যাপ্রিসিয়েশন পাবার জন্যই তো।

অ্যাপল-এর তিন মিনিট লম্বা বিজ্ঞাপনটার শুরু হয় অ্যাপল ড্যাটা সেন্টারের মেইন সার্ভার রুমে নিয়োগপ্রাপ্ত নতুন রিক্রুটের বেখেয়াল কাণ্ড দিয়ে। নিজের অজান্তেই ভদ্রলোক অ্যাপের সার্ভার বন্ধ করে দেন। আর তারপরই পৃথিবীজুড়ে নেমে আসে বিভীষিকা। অন্ধকার মেঘের মতো ছেয়ে ধরে এক অনাকাঙ্ক্ষিত গ্লোবাল ক্রাইসিস- ভয়ঙ্কর ‘অ্যাপ-ও-ক্যালিপস’। ভাবুন খালি একবার। প্রয়োজনীয় অ্যাপের অভাবে শহরময় মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক। আপনার পাশের সেলফিবিলাসী মেয়েটা নিজের নানা অ্যাঙ্গেলে, নানা পোজে তোলা ছবির প্রিন্টআউট নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সামান্য একটু অ্যাপ্রিসিয়েশন পাবার জন্যই তো। অথচ পছন্দ হবার রিঅ্যাকশন দূরে থাক, কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। উহ্ কী ভয়ঙ্কর! কিংবা ধরুন জিপিএস-এর সিস্টেম ডাউন থাকায় কেউ জানতেও পারছে না নিজের লোকেশন, উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরছে দিগ্বিদিক। কিংবা কিংবা পছন্দের গবাদি পশুর কেনাবেচার জন্য যেতে হচ্ছে নোংরা চোরাই বাজারে। না না আর ভাবতে পারছি না আমি। চাই না আমার চরমতম শত্রুকেও তেমনটা ভাবতে হোক। চাই না অ্যাপ-ও-ক্যালিপস দেখতে হোক পৃথিবীর কাউকে। তাইতো বেঁচে থাকুক অ্যাপ। তৈরিও হোক নতুন নতুন। উৎসাহ দিতে হবে অ্যাপ ডেভেলপারদের কল্পনাশক্তি, নতুন ইনোভেশন আর খোদ ইনোভেটরকে। যার প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্ল্ডওয়াইড ডেভেলপার্স কনফারেন্স। বিজ্ঞাপনটি দেখুন এখানে-

 

রাইট-লেফট সোয়াইপের পরিবর্তে টিন্ডারে যেভাবে হচ্ছে ডেটিং

অ্যাপল-এর মার্কেটিং টিম এ মৌসুমে বেশ দৌড়ের উপর আছে বলা যায়। আইফোনের বিভিন্ন ফিচার নিয়ে গেলো সপ্তাতেই একগাদা বিজ্ঞাপনের সিরিজ রিলিজ করেছে। আইপ্যাড প্রো’র লঞ্চ নিয়েও ছেড়েছে সিরিজ বিজ্ঞাপন। ঘোষণা এসেছে ম্যাকবুক প্রো আর হোম-পডের লঞ্চেরও। আবার গত ক’বছর ধরে অ্যাপল টিভি শো’র বাজারেও ঢুকি ঢুকি গুঞ্জন সেটাও সত্যি হয়ে গেছে এ সপ্তায়। শুরু হয়েছে অ্যাপ-বেজড নতুন বিজনেস ভেঞ্চার নিয়ে রিয়্যালিটি শো ‘প্ল্যানেট অব দ্য অ্যাপস’। গতবছর অ্যাপল-এর বিশ্বব্যাপী বাজারের সামান্য মন্দা পুষিয়ে নিতে বেশ জোরেশোরেই কাজ করছে তারা। প্ল্যানেট অব দ্য অ্যাপস নিয়ে প্রত্যাশার পারদ বেশ চড়া ছিলো বলতে হবে। অ্যাপ এন্ট্রাপ্রেনারদের বিজনেস প্ল্যানের ভবিতব্য যাচাই বাছাই করবেন হলিউড সেলিব্রেটি জেসিকা অ্যালবা, গিনেথ প্যালট্রো, বেস্টসেলার লেখক-বিজনেস বক্তা-উপদেষ্টা-উদ্যোক্তা গ্যারি ভেনারচাক এবং মিউজিশিয়ান উইল-আই-এম। দেখানো হবে প্রতি মঙ্গলবার অ্যাপল মিউজিকে।

যদিও প্রথম এপিসোডের রিভিউ যথেষ্ট খারাপ। তারপরও বলি, অ্যাপ-ই যেহেতু ভবিষ্যৎ, অ্যাপ-ই বর্তমানের নিয়ন্ত্রক, সামনের পর্বগুলো জমে উঠতেও পারে। অনেক অ্যাপ-ই কিন্তু রাতারাতি জনপ্রিয় হয়নি, ধীরে ধীরে হয়েছে। তাই বিজ্ঞাপনটির সুরে বলতে হয়, অ্যাপ বানাতে থাকুন। জীবন বদলাতে থাকুন। কারণ অ্যাপ ইন, তো জীবন আপদহীন। অ্যাপ ভালো তো জগৎ ভালো।